ব্যাগ গুছিয়ে...
মায়াবতী পথে
রাত প্রায় আটটা। উত্তরের হিমেল হাওয়া বইছে শনশন করে। বন্য ওক, দেওদারের ফাঁকে ফাঁকে বিজলি বাতিগুলো কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে অবিরত। আলোর উজ্জ্বলতা কমেছে। লাঠি ঠুকে ঠুকে উঠে যাচ্ছি আস্তে আস্তে। আশ্রমের অতিথি আবাস ছেড়ে দু’পাশে বনাঞ্চলের মাঝ বরাবর পাকা পাকদণ্ডী এঁকেবেঁকে উঠে গেছে ওই উপরে, যার সাময়িক সমাপ্তি প্রার্থনাকক্ষের চৌহদ্দির সামনে। আলো-আঁধারি, জোনাক-জ্বলা অরণ্যের ভিতর সমবেত লোরেং-এর ক্রমাগত গুনগুনে (ঝিঁঝিঁ পোকা) যেন সন্ধ্যারতি চলছে প্রকৃতির মাঝে।
সোজাসাপটা বাঁধানো রাস্তায় লাঠি ঠুকে আসার প্রয়োজন অবশ্যই আছে।
সারা কুমায়ুনেই লেপার্ডের দাপাদাপি। যদিও করবেট যুগ আর নেই। মাংসাশী শ্বাপদের সংখ্যাও কমেছে সভ্যতার অত্যাচারে, তবু সাবধানের মার নেই। ২০০৬-এই এখানকার আশ্রমের গোশালা থেকে লেপার্ড তুলে নিয়ে গিয়েছে তার চেয়েও ভারী এক গরুকে। পাগমার্ক বা বাঘের পায়ের ছাপ ছাঁচে ফেলে স্মারক হিসেবে রাখা আছে যত্নে। লন্ডন থেকে আমেরিকা ছুঁয়ে যখন দেশে ফেরার কথা স্বামী বিবেকানন্দের, তখনই তাঁর অনুগামী, শিষ্য ক্যাপ্টেন সেভিয়ার দম্পতি ও মিস হেনরিয়েটা মুলার স্বামীজির জন্য সুইৎজারল্যান্ডে তাঁর ছোট্ট অবকাশের ব্যবস্থা করলেন। আর সেখানে থেকে আপ্লুত স্বামীজি। বললেন, “এখানে বরফের উপরই সব। আমার ভারতে বরফ ছুঁতে চাইলে হিমালয়ের কাছে যেতে হবে।” স্বামীজি দেখিয়েছিলেন, ভাবতে শিখিয়েছিলেন, সারা পৃথিবীতে যা আছে তার সবটাই কিছু না কিছু আমাদের ভারতে আছে। টলে গেল তাঁর মন। সেই মন হিমালয়ের কোলে খুঁজতে লাগল আল্পসের মতো সবুজের সঙ্গে শ্বেতশুভ্র তুষারের মেলবন্ধন। যেখানে তিনি গড়তে পারবেন তাঁর স্বপ্নের আশ্রম। যেখানে থাকবে সাধনাকক্ষ, দাতব্য চিকিৎসালয়, ফার্ম হাউস। অপার হিমেল হিমালয়কে সঙ্গে নিয়ে যেখান থেকে তিনি ও তাঁর অনুগামীরা, তাঁর শিষ্যরা সেবা করতে পারবেন আশেপাশের হতদরিদ্র পাহাড়িয়াদের। লালন করতে পারবেন হিমালয়ের প্রকৃতি, ফুলফল আর বন্যপ্রাণকে। অধুনা ‘মাইপং’, জেলা চম্বাবত-এ খুঁজে পেলেন তাঁর ঈপ্সিত জায়গা। নাম রাখলেন ‘মায়াবতী’, যার মানে মায়ের পীঠ। বর্তমানে এটি লোহাঘাট জেলায়।
অরণ্যপ্রকৃতির মধ্যে, বেশ কিছুটা নীচে অতিথি নিবাসের পাশেই ‘মাদার্স সেভিয়ার্স’ বাংলো। যেখানে ভগিনী নিবেদিতা, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর মতো নমস্যরা বাস করেছিলেন। স্মৃতিবিজড়িত সেই ঘরেই শিহরিত রাত যখন ভোর হল, তখনও অনন্য অনুভূতি। বাংলোর বাইরে পা রাখতে সেই বিস্ময়! পাইনের ফাঁক দিয়ে জেগে উঠছে ত্রিশূল, নন্দাদেবী, নন্দাকোট, পঞ্চচুল্লি-সহ নানান গিরিশৃঙ্গ। এখান থেকে খুব কাছাকাছি গ্রাম, তা-ও ৪ কিমি দূর তো বটেই। সাবডিভিশনাল শহর লোহাঘাট ৯ কিমি নীচে। তাই চা খেতে হলে বাংলো থেকে এক-দেড়শো মিটার উচ্চতায় আশ্রমের খাবার ঘরই ভরসা। এখানকার স্বামী বোধাশরণানন্দ বলছিলেন, “এটা কোনও তীর্থস্থান নয়, নয় পর্যটন কেন্দ্র। এটা সাধনার জায়গা। এখানে হিমেল হিমালয়কে উপভোগ করতে করতে আশেপাশের পীড়িত, গরিব মানুষগুলোর সেবা ও উন্নতির জন্য সামান্যতম ভাবনা সাদরে গৃহীত হবে। ভালুক বা লোমশ কুকুরের মতো অবয়বে ‘পেঞ্জি’ নামক ফুল দেখে অবাক হতে হয়। ‘আকিরা মহারাজ’ এনেছেন সুদূর জাপান থেকে।”
আশ্রমের কর্মরত এক পাহাড়িয়া পথ-প্রদর্শককে সঙ্গী করে পথ চলি ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। গোশালা, লেক, ফার্মহাউসকে বাঁয়ে রেখে মাইল দুয়েকের চড়াই। মাথার উপরে দেওদার-পাইনের আচ্ছাদন আর চারপাশে বনজ ও ভেষজ গুল্মের সঙ্গে রডোডেনড্রনের ক্যামোফ্লেজ। মাথার ওপর দিয়ে এক ঝাঁক হিলময়না উড়ে গেল সশব্দে। নিঃশব্দ জঙ্গল ট্রেকিং-এ আমরা ক’জনা হেঁটে চলেছি বিশ্ব পরিব্রাজকের পথ ধরে।
১৯০১-এর সালে ৩ জানুয়ারি যখন দিন পনেরোর জন্য বিবেকানন্দ এখানে আসেন, এই পথ দিয়ে তিনি পৌঁছন গহন জঙ্গলের মধ্যে এক পাহাড়ঘেরা নির্জন জায়গায়। সেখানে তিনি ধ্যানে বসেন। যার নাম হয় ‘ধরমগড়’। ১৯৯৭-এর মে মাসে তাই স্মারকস্বরূপ কটেজের মতো ছোট ঘর তৈরি করেছেন অদ্বৈত আশ্রম। দু’দণ্ড এখানে চুপচাপ বসলেই অদ্ভুত নীরবতার জীবন হয়তো অন্য ভাবে চেনায়। ভাবা যায়?
বার্কিং ডিয়ার, সজারু, বন্য শুয়োরের ভালই আনাগোনা আছে এখনও এ অঞ্চল জুড়ে। নিস্তব্ধ পবিত্র জঙ্গলে ঝরা পাতার উপর এখন শুধু পথ চলার শব্দ। এ পাহাড়ি অনুর্বর জায়গায় কী অসাধারণ আবাদ হতে পারে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। ঘুরতে ঘুরতে মনে হয় একটা কোলে মার্কেট আর চিৎপুর ফলপট্টির যাবতীয় সবজি আর ফলকে বোধহয় সব এক আকাশের নীচে আনা হয়েছে। আপেল, ন্যাসপাতি, আঙুর, মুসম্বি, চেরি, ওয়ালনট, পিচ-সহ নানান গাছের সমারোহ। সবুজ ফার্মহাউসকে ঘিরে আছে পাহাড়, নানান পাখির কিচিরমিচির। তার মাঝে হাওয়ায় তিরতির করে বইছে লেক।
১৮৯৯-এর ১৯ মার্চ শ্রীরামকৃষ্ণদেবের পুণ্য জন্মতিথিতে এই আশ্রমের প্রতিষ্ঠা। তখনকার সময় বিবেকানন্দর ব্যবহৃত ঘরে আজ ধ্যানকথা, লাইব্রেরি। বড় বর্ণময় লাগে ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ পত্রিকা অফিসের সামনে দাঁড়ালে। এখানে রয়েছে সেই বিখ্যাত প্রিন্টিং মেশিন, যা কয়েক শো বছরের স্মৃতিবিজড়িত। ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে সেভিয়ার দম্পতি এখানে নিয়ে এসেছিলেন সেই সময়। তার পরে এখান থেকেই প্রকাশিত হতে থাকে ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ নামাঙ্কিত ইংরাজি মাসিক পত্রিকা।

কী ভাবে যাবেন
কলকাতা থেকে ট্রেনে কাঠগোদাম, সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে লোহাঘাট হয়ে মায়াবতী।
কোথায় থাকবেন

লোহাঘাটে প্রচুর হোটেল আছে।
কখন যাবেন
বর্ষা ও ভীষণ শীত ছাড়া সব সময়।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.