সে দিন আর নেই। তেমন বরাতও আর মেলে না। আর্থিক সঙ্কটে জেরবার বলাগড়ের রণপা শিল্প।
এক সময়ে, বিশেষ করে শীতের মরসুম এলেই বলাগড়ের নানা গ্রামে ‘ডকলা’ বাঁশের খোঁজে হন্যে হতেন শিল্পীরা। সেই বাঁশ দিয়ে তৈরি হত রণপা। তা নিয়ে রাজ্যের তো বটেই, দেশেরও নানা প্রান্তে অনুষ্ঠানে হাজির হতেন শিল্পীরা। চলত রণপা নিয়ে হাঁটা, রণপা নাচ। উপার্জনও হত ভালই। কিন্তু সেই শিল্পে এখন ভাটার টান। বলাগড়ের রণপা শিল্পীরা এখন সরকারের মুখ চেয়ে বসে রয়েছেন।
গোবিন্দ মণ্ডল, সুভাষ গোয়েল বা দীপঙ্কর সাধুখাঁর মতো প্রবীণ রণপা শিল্পীরা বলছেন, সরকারি সাহায্য ছাড়া এই শিল্প বাঁচিয়ে রাখা আর সম্ভব নয়। গ্রামের নবীন প্রজন্ম উৎসাহ দেখাচ্ছে না। তাঁরা অন্য পেশা খুঁজে নিচ্ছেন।
হুগলির অতিরিক্ত জেলাশাসক (উন্নয়ন) আবিদ হোসেন বলেন, “পেশা বজায় রাখতে এবং শিল্পকে বাঁচানোর জন্য রণপা শিল্পীরা যদি প্রশাসনের দ্বারস্থ হন, তা হলে কোনও একটি প্রকল্পের মাধ্যমে তাঁদের এই শিল্প বাঁচানোর জন্য সরকারি সাহায্যের ব্যবস্থা করার চিন্তাভাবনা করা যাবে।”
বলাগড়ের নিত্যানন্দপুর-১ পঞ্চায়েতের ডুমুরদহ গ্রামের দাসপাড়া, বাবুপাড়া, মোড়লপাড়া এবং বোর্ডিংপাড়ার কয়েকশো বাসিন্দা বংশানুক্রমিক ভাবে রণপা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। শিল্পীরা জানাচ্ছেন, এলাকার সাধারণ বাঁশঝাড়ের মধ্যেই ‘ডকলা’ বাঁশ মেলে। তবে, তা সংখ্যায় খুবই কম। অন্য জায়গা থেকেও বাঁশ জোগাড় করতে হয়। |
পোড়খাওয়া শিল্পীরা প্রায় ১০ ফুটের বাঁশ ব্যবহার করেন রণপা হিসেবে। অনেকে আবার তুলনায় ছোট মাপের বাঁশ ব্যবহার করেন। ঝাড় থেকে বাঁশ সংগ্রহ করার পরে তা প্রথমে ভাল ভাবে চাঁচা হয়। তার পরে তেল মাখিয়ে, রোদে দিয়ে বাঁশ দু’টিকে মোলায়েম করা হয়। বিভিন্ন শিল্পীরা সেই জোড়া বাঁশের বিভিন্ন উচ্চতায় পাদানি জুড়ে দেন। এর পরে থাকে রং-বেরংয়ের লম্বা জামাকাপড় তৈরির কাজ। সব মিলিয়ে খরচ হয় প্রায় চার হাজার টাকা। মাস তিনেকের মধ্যেই শেষ হয়ে যায় প্রশিক্ষণও।
এর পরে থাকে বরাত অনুযায়ী অনুষ্ঠানে গিয়ে রণপা শিল্পের প্রদর্শন। গোবিন্দবাবুর আক্ষেপ, “বছর দশেক আগে পর্যন্তও শীতের মরসুমে নানা মেলা ও অনুষ্ঠানে প্রায়ই ডাক মিলত। দু’তিন দিনে পাঁচ-ছ’জায়গা থেকেও ডাক এসেছে। কিন্তু এখন সেই বরাত কমে কখনও মাসে একটা-দু’টি অনুষ্ঠানের ডাক মেলে। দু’শো থেকে পাঁচশো টাকা উপার্জন হয়। তা দিয়ে কী আর সংসার চলে?” শিল্পীরা জানাচ্ছেন, আগেও এমন উপার্জনই হত। কিন্তু বরাত বেশি মেলায় আয়ের পরিমাণ বাড়ত।
এই পরিস্থিতিতে ওই এলাকার বর্তমান প্রজন্মের ছেলেরা আর রণপা শিল্পের উৎসাহ দেখাচ্ছেন না। মোড়লপাড়ার বছর সতেরোর সনাতন মাঝি বলে, “বাবা-কাকারা রণপা খেলা দেখিয়ে সংসার চালিয়েছেন। কিন্তু আমরা এই শিল্পে এসে দেখছি ভুল করেছি। তেমন আয় নেই। তাই চাষাবাদ করছি।” গৌতম দাস নামে এক যুবক বলেন, “মাঝেমধ্যে বিজ্ঞাপন বা বড় কোনও অনুষ্ঠানের জন্য ডাক আসে। কিন্তু তেমন টাকা মেলে না। তা দিয়ে আর কী হবে? তাই অন্য পেশা খুঁজছি।”
তবে, এলাকার এই প্রাচীন শিল্প একেবারে হারিয়ে যাক, তা-ও চান না শিল্পীরা। তাই তাঁরা চাইছেন সরকারি হস্তক্ষেপ। |