সম্পাদকীয় ১...
নাগরিকতন্ত্র
প্রজাতন্ত্র কথাটির মধ্যে ‘প্রজা’ রহিয়াছে, আর তাহার মধ্যে রহিয়াছে রাজার তুলনায় নিম্ন অবস্থানের দ্যোতনা। রাজাকে বলিয়া-কহিয়া তাঁহার সুমতি জাগ্রত করিয়া নিজ কার্য আদায়ের মধ্যেই যাহার চূড়ান্ত ক্ষমতার প্রকাশ। এই ভঙ্গিতে প্রজাতন্ত্রকে দেখিলে, আমাদের দেশে তাহা চমৎকার প্রতিষ্ঠিত, সন্দেহ নাই। কিন্তু ‘প্রজা’ কথার প্রকৃত তাৎপর্য অনুধাবন করিলে দেখিব, তাহা ‘নাগরিক’ শব্দের সমীপবর্তী। নাগরিক, যিনি একটি জনপদের অধিবাসী ও সেই সূত্রে কর্তৃপক্ষের নিকট যিনি তাঁহার কিছু অধিকার দাবি করিতে পারেন। ভিক্ষা নহে, দাবি। এই নাগরিক সমাজ নিজ অধিকার সম্বন্ধে সম্যক সচেতন ও আগ্রহী, বাস্তবে সে অধিকারের প্রয়োগ ঘটাইতে সতত সক্রিয় ও উদ্যোগী এই দেশে বর্তমান কি? সেই নাগরিক সমাজের জন্ম ও প্রসারের অনুকূল ভূমি রচনা এই দেশের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর কাঙ্ক্ষিত কি? এই দেশে কী হইবে, কী হইবে না, নীতি-নির্ধারণে সাধারণ নাগরিকের আদৌ ভূমিকা রহিয়াছে?
কিছু বর্ষ পূর্বেও একটিমাত্র তিক্ত ও নেতিবাচক বাক্যে সপাটে এই আলোচনার ইতি টানিয়া দেওয়া যাইত। এই দেশে প্রভুরা সাধারণকে নির্মম শুষিয়া থাকেন ও উচ্চ মঞ্চ হইতে ভণ্ড বক্তৃতায় সাধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষার দোহাই পাড়িয়া থাকেন: এই ক্ষোভ ও আর্তনাদ স্বাধীনতার কিছু সময়ের পর হইতেই ভারতবাসীর নিত্যসঙ্গী। শত সাহিত্য-নাট্য-চলচ্চিত্র, প্রখর আন্দোলন ও প্রবল রক্তস্মৃতি, সর্বোপরি কোটি কোটি মৌনী, পরাহত মানুষের বিমর্ষ, ভীত, ম্রিয়মাণ মুখাবয়ব এই ধারাবাহিক অন্যায়ের সাক্ষী। কিন্তু সেই একমাত্রিক চিত্রনাট্য আজ কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত। এক ধর্ষণকাণ্ডে প্রশাসনিক কর্তাদের অপদার্থতা ও ঔদাসীন্যের প্রতিবাদে সাধারণ মানুষ পুলিশের জলকামানের সম্মুখে বুক পাতিয়া দাঁড়াইতেছেন। এক অনামা নেতার দুর্নীতিবিরোধী জেহাদের কথা শুনিয়া আন্দোলন-প্রাঙ্গণে সমবেত হইতেছেন শত শত সাধারণ মানুষ। কেবল এসএমএস বা ফেসবুকে প্রচারিত আহ্বানে সাড়া দিয়া সহসা শুরু হইতেছে বিশাল মিছিল, জন্ম লইতেছে বৃহৎ সমাবেশ। ছয় বৎসর পূর্বে, বামফ্রন্টের কুশাসনের প্রতিবাদে যে মিছিল কলেজ স্ট্রিট হইতে চৌরঙ্গি হাঁটিয়াছিল, তাহাকে ‘সুশীল সমাজ’-এর রাজনীতি-ফ্যান্টাসি বলিয়া ব্যঙ্গ করা হইয়াছিল। যিনি জীবনে কখনও রাজনীতির ধার মাড়ান নাই, তিনি অকস্মাৎ টিফিন-অবসরে একটু ‘শখের প্রতিবাদ’ করিয়া লইলে তাহার কোনও মূল্য বর্তায় না, তাঁহাকে সংগঠিত রাজনীতির অংশ হইয়া তবে নিজ স্বর শুনাইতে হইবে: ফরমান জারি করিয়া বহু বিজ্ঞ ব্যক্তি মুচকি হাসিয়াছিলেন। তাঁহারা এই সাধারণত অসংগঠিত, দ্বিধান্বিত ও ভীরু জনগোষ্ঠীর অপূর্ব উত্থান আঁচ করিতে পারেন নাই। কল্পনা করিতে পারেন নাই, কখনও পথে নামা অভ্যাস নাই বলিয়াই এই স্বতঃস্ফূর্ত জনপ্লাবনের পথে নামিবার সিদ্ধান্ত ও জেদ অপরিসীম অভিঘাত সৃষ্টি করিবে। গত বৎসর পশ্চিম এশিয়ায় একের পর এক স্বৈরাচারীর বিরুদ্ধে মানুষ সফল আন্দোলন করিয়াছেন এবং বহু রাজনৈতিক দল ইহার নেতৃত্ব ও কৃতিত্ব আত্মসাৎ করিবার প্রয়াস সত্ত্বেও এইগুলি নিখাদ জনবিপ্লব হিসাবে সম্মান পাইয়াছে। দিকে দিকে মানুষ আলোড়িত হইতেছেন, দাবি জানাইতেছেন, লাঠির সম্মুখে নিজ অধিকার বুঝিয়া লইতেছেন এবং এই তথ্য দাবানলের ন্যায় অন্য মানুষ-গোষ্ঠীর অনুপ্রেরণা হিসাবে কাজ করিতেছে, প্রযুক্তির গুণে সমগ্র বিশ্ব একটি-দুইটি আয়তাকার পর্দায় জড়ো হওয়ায় মানুষের ভ্রাতৃত্ব নূতন অর্থ পাইতেছে।
কিন্তু দিল্লি, স্বভাবতই, বহু দূর। নিপীড়িত মানব, ধর্ষিতা মানবী সম্পর্কে নিষ্ঠুর নির্বিকার মন্তব্য করা চলিতেছে, নিহত ব্যক্তি সম্পর্কেও ‘আমরা-ওরা’ বিভাজন চলিতেছে, বিরুদ্ধ সমালোচনাকে বাহুবলে দাবাইয়া ‘বেশ করিয়াছি’ মনোভাবের প্রদর্শনী চলিতেছে। ক্ষমতা বিষম বস্তু, তাহা নিজ কর্তব্য পালনকে প্রায়ই কৃপাবর্ষণ মনে করিয়া অহং ফুলাইতে থাকে এবং কর্তব্য পালন না করিলে অন্যায় ঢাকিতে সেই স্ফীতি বর্ধিত হয়! ভরসা ইহাই, দেখিয়া-শুনিয়া নীরব থাকিবার অভ্যাস প্রজারা ত্যাগ করিয়াছে। নিজ শক্তির উন্মেষ তাহাদের আত্মবল শিখাইয়াছে। শাসকেরা তাই, সচেতনতার ফলে না হউক, সিংহাসন উলটাইবার ভীতিতে প্রজার হাত ধরিয়া সমানত্বের তন্ত্র সাধন করিবেন, আশা রহিল।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.