বিভ্রান্তির জন্য সংবাদমাধ্যমকেই দোষারোপ |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা ও নয়াদিল্লি |
প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে তাঁর মন্তব্য দেশ জুড়ে সমালোচনার ঝড় তুলেছে। সেই সমালোচনার মুখে দাঁড়িয়ে মঙ্গলবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সব দায় চাপিয়ে দিলেন সংবাদমাধ্যমের উপরে!
তাঁর অভিযোগ, মন্তব্যের আদ্যোপান্ত ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কথা বিকৃত করা হয়েছে। এসএসকেএম হাসপাতালে এ দিন এক অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমি বলি এক। আর কাগজ লেখে আর এক!” তিনি যা বলেছিলেন তাতে কোনও ভুল ছিল না বলে মুখ্যমন্ত্রীর দাবি।
মুখ্যমন্ত্রীর এই ব্যাখ্যার পরে তাঁর ‘মানসিক স্থিতি’ নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে বিরোধীরা। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র মুখ্যমন্ত্রীর স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। মুখ্যমন্ত্রীকে স্বাস্থ্যের (যার মধ্যে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক, তিনটি দিকই আছে) যত্ন নেওয়ার ‘পরামর্শ’ও দিয়েছেন চিকিৎসক সূর্যবাবু। প্রায় একই সুরে মুখ্যমন্ত্রীর মানসিক সুস্থতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেছেন, যুব কংগ্রেস কর্মীরা তাঁর দ্রুত আরোগ্য কামনা করছেন! রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন অবশ্য এ ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রীর পাশেই দাঁড়িয়েছেন। মধ্যমগ্রামে এক অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য নিয়ে প্রশ্নের জবাবে রাজ্যপাল হেসে বলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রীই জানেন তিনি কী বলেছেন। তিনি নিশ্চয়ই মজা করেছেন!” |
বিতর্ক দানা বাঁধার পরে মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের ব্যাখ্যা, “আমি বলেছিলাম, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাত-আট বার দেখা করেছি। দেখা করে দাবি জানাতে পারি, মারতে তো পারি না! এর মধ্যে ভুলটা কোথায়?” সাংবাদিকদের প্রতি তাঁর পরামর্শ, “আপনারা ভাষাটা খেয়াল করুন। ‘আমি ভাত’ আর ‘আমি ভাত খাই’ দু’টো এক নয়। মানুষকে বিভ্রান্ত করবেন না! দয়া করে নিজেদের নিরপেক্ষও বলবেন না!”
সোমবার ক্যানিংয়ে এক জনসভায় বার বার কেন্দ্রের কাছে অর্থ সাহায্য চাওয়া প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, “আমি কি প্রধানমন্ত্রীকে গিয়ে মারব? মারলেই তো লোকে গুন্ডা বলবে! এমনিতেই ওরা আমাকে গুন্ডা বলে!” ওই মন্তব্যের পরেই রাজনৈতিক শিষ্টাচার নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। মুখ্যমন্ত্রীর পর পর দু’দিনের বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবুর প্রতিক্রিয়া, “মুখ্যমন্ত্রী একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ওঁর সমস্যা অন্য জায়গায়। তাঁর কথা মতো, উনি দিনে দু’ঘণ্টা ঘুমিয়ে ২৪ ঘণ্টা কাজ করেন। ওঁর স্বাস্থ্য আমাদের কাছে উদ্বেগজনক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-র সংজ্ঞা অনুযায়ী, শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক স্বাস্থ্য নিয়েই সাধারণ স্বাস্থ্য। কারও পক্ষে ২২ ঘণ্টা কাজ করে মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিন! আর মুখ্যমন্ত্রীর স্বাস্থ্য শুধু ব্যক্তিগত নয়। রাজ্যের স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত।”
এত বড় মন্ত্রিসভা, ৭ জন উপদেষ্টা এবং এখন প্রায় মন্ত্রীর মতো পরিষদীয় সচিব নিয়োগের পরেও সব কাজ কেন একা মুখ্যমন্ত্রীকেই করতে হয়, কেন জনসভা পরিচালনা করতে তাঁকেই ঘণ্টা তিনেক সময় খরচ করতে হবে এ সব প্রশ্ন তুলে সূর্যবাবুর মন্তব্য, “মানসিক ভারসাম্য খুব গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। মুখ্যমন্ত্রীর সেটা হারিয়ে ফেলা উচিত নয়!” তা হলে তিনি কি মুখ্যমন্ত্রীকে মানসিক ভারসাম্যহীন বলছেন? সূর্যবাবুর জবাব, “আমি ওঁর দল, সরকার এবং রাজ্যের স্বার্থে তাঁকে স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে বলছি। মুখ্যমন্ত্রীর কিছু হলে রাজ্যের ক্ষতি। এর সঙ্গে জনগণের স্বার্থ অবিচ্ছিন্ন ভাবে জড়িত। আমি ওঁর শুভ কামনা করছি!”
একই সঙ্গে কটাক্ষের সুরে বিরোধী দলনেতা বলেন, “আমরা মনে করি না, উনি প্রধানমন্ত্রীকে মারতে চেয়েছেন। মানুষকে প্রশ্ন করেছিলেন, মারতে যাব কি? পরের কথাগুলো না বললেও পারতেন। উনি পুুলিশের টুপি খুলে নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে, এক বার কামড়াতে গিয়েছিলেন বলেও শোনা যায়। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে মারামারির অভিযোগ কেউ কখনও করেছে বলে শুনিনি!” |
আমি বলেছিলাম, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাত-আট বার
দেখা করেছি। দেখা করে দাবি জানাতে পারি,
মারতে তো পারি না! এর মধ্যে ভুলটা কোথায়?
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, (মুখ্যমন্ত্রী) |
উনি পুলিশের টুপি খুলে নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ
রয়েছে, কামড়াতে গিয়েছিলেন বলেও শোনা যায়।
কিন্তু মারামারির অভিযোগ কেউ কখনও করেনি!
সূর্যকান্ত মিশ্র, (বিরোধী নেতা) |
|
দিল্লিতে এ দিনই প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গে দেখা করেন প্রদেশ কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়া। মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য নিয়ে অবশ্য মনমোহনের সঙ্গে কোনও কথা হয়নি মানসবাবুর। তাঁর কথায়, “এর জবাব দিতে কংগ্রেসই যথেষ্ট!”
মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের ব্যাখ্যা শুনে কলকাতায় প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপবাবুর প্রশ্ন, “ক্যামেরায় সব ধরা আছে। ওই গলার স্বর কি অন্য কারও? মুখ্যমন্ত্রীর পোশাক পরে কি ওখানে অন্য কেউ বক্তৃতা করছিলেন? প্রদীপবাবু বলেন, “এ তো অসুস্থ মানসিকতার উদাহরণ! এ রাজ্যে একটা অসুস্থ সরকার চলছে। যুব কংগ্রেসের কর্মীরা বিভিন্ন জায়গায় ফুল নিয়ে ওঁর আরোগ্য কামনা করছেন!”
শত সমালোচনার মুখেও মুখ্যমন্ত্রী এ দিনও সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে তোপ দাগতে পিছপা হননি। স্বাস্থ্যকর্মীদের বেতন সংক্রান্ত একটি প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি মন্তব্য করেন, “বেতন তো ক্যাশে দিতে হয়। ক্যাশ না-থাকলে আমি কি অ্যাশ (ছাই) দেব?” এর পরেই তাঁর সংযোজন, “আমি এই কথাটা বলছি, ওরা হয়তো লিখবে ওষুধের বদলে রোগীদের অ্যাশ দিতে বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী!” |