কলিকাতা হাইকোর্টে পুনরায় কর্মবিরতি। সপ্তাহের প্রথম কাজের দিন প্রধান বিচারপতি সহ অন্যান্য বিচারকরা যথারীতি নিজ-নিজ এজলাসে যথাসময়ে গিয়া বসিলেন। দূর-দূরান্ত হইতে হাজির বিচারপ্রার্থীরাও। কিন্তু আইনজীবীরা কেহ আসিলেন না। বিচারকরা সাড়ে তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করিয়া এজলাস বন্ধ করিয়া উঠিয়া গেলেন। প্রধান বিচারপতি কিন্তু আইনজীবীদের আসিতে অনুরোধ করিয়াছিলেন। বিচারপ্রার্থী জনসাধারণের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখিতে কর্মবিরতির সিদ্ধান্ত রদ করার আবেদন জানাইয়াছিলেন। কিন্তু আইনজীবীরা নাকি বড় ক্লান্ত, অবসাদগ্রস্ত ছিলেন। আগের দিনই হাইকোর্টের সার্ধশতবর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানের পর নাচগানের জলসা শেষ করিতে রাত্রি হইয়া যায়। ক্লান্তি ও অবসাদের কারণ সেটাই। ক্লান্তি অপনোদনে তাঁহারা রীতিমত বৈঠক করিয়া কর্মবিরতির সিদ্ধান্ত লন এবং প্রধান বিচারপতিকে তাহা অগ্রিম জানাইয়াও দেন। ভাবিতে অবাক লাগে, ইহা করার সময় এক বারও বিচারপ্রার্থী জনসাধারণের আদালতে আসিয়া নিষ্ফল অপেক্ষা শেষে শূন্য হাতে ফিরিয়া যাওয়ার গ্লানির কথা তাঁহাদের মনে হয় নাই।
পশ্চিমবঙ্গের হাইকোর্টে জমিয়া-থাকা মামলার সংখ্যা এই মুহূর্তে ৩ লক্ষ ৭৪ হাজার, নিম্ন আদালতগুলিতে ২৮ লক্ষ। বকেয়া মামলার পরিমাণ যেখানে এমন পাহাড়প্রমাণ, দিনে দুই-চারিটির বেশি মামলার নিষ্পত্তি যেখানে হয় না, সেখানে আইনজীবীরা ভোজন ও গানের জলসায় সোৎসাহ যোগদান ও আয়োজনে ক্লান্ত হইয়া একটি গোটা কাজের দিন কর্মবিরতি পালনের আবদার করিবেন, ইহা অবিশ্বাস্য। কিন্তু এমন ঘটনাও এই প্রথম নয়। বর্তমান প্রধান বিচারপতি সংবর্ধিত হওয়ার সময় এই আইনজীবীদেরই অনুরোধ করিয়াছিলেন, অনুষ্ঠান যেন আদালতের স্বাভাবিক কাজকর্ম চালাইবার পথে বাধা হইয়া না-দাঁড়ায়। তখনও আইনজীবীরা তাঁহার পরামর্শ অগ্রাহ্য করেন। নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতিকে সংবর্ধনা জ্ঞাপনের উল্লাসে কর্মবিরতি পালনের অনুপম যাপনে ঘরে বসিয়া থাকেন। যে কোনও উপলক্ষকে কর্মবিরতি পালন মারফত উদ্যাপন করা বা স্মরণীয় করিয়া রাখার এই মানসিকতা বঙ্গীয় সমাজের সর্ব স্তরেই ওতপ্রোত। তাই স্বামী বিবেকানন্দের মতো কর্মযোগীর জন্মের সার্ধ শতবর্ষপূর্তি উদ্যাপনেও রাজ্য সরকারের তরফে কর্মবিরতি ঘোষণা করা হয়।
অন্যান্যদের সহিত অবশ্য আইনজীবীদের বিশেষ প্রভেদ থাকার কথা। তাঁহারা সমাজের শিক্ষিত, সচেতন অংশ, দেশের আইনকানুন সম্পর্কে সবিশেষ অবহিত, যেমন অবহিত নিজেদের বিশেষাধিকার সম্পর্কেও। সাধারণ মানুষ তাঁহাদের সমীহ করে, তাঁহাদের কাছেই কার্যত ন্যায়প্রার্থী হইয়া হাজির হয়, পুলিশ তাঁহাদের রীতিমত ভয় করে, আর ‘আদালত অবমাননা’ নামক জুজুর ভয়ে সরকার সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও তাঁহাদের সহসা ঘাঁটায় না। এই সব কারণেই কিন্তু জনসাধারণকে ন্যায়বিচার বুঝাইয়া দিবার ক্ষেত্রেও তাঁহাদের অতিরিক্ত দায়িত্ববোধও থাকা উচিত। যে-ধরনের কর্তব্যনিষ্ঠা থাকিলে বিচারপ্রার্থী জনসাধারণের স্বার্থ যথাযথ রক্ষিত হয়, তাঁহাদের আইনজীবীদের হাজিরার জন্য দিনভর অপেক্ষা করিতে হয় না, এবং বিচারপতিদেরও সেই গরহাজিরার সামনে শূন্য এজলাসে বসিয়া থাকিতে হয় না, তাহার অভাব বড়ই বেদনাদায়ক। দেশের বিচারব্যবস্থার কাণ্ডারীরা বকেয়া মামলার দ্রুত মীমাংসায় তৎপর। ‘ফাস্ট-ট্র্যাক কোর্ট’ চালু করা হইয়াছে, আলাদা করিয়া ধর্ষণের মামলাগুলির দ্রুত মীমাংসার উপর জোর দেওয়া হইতেছে, লোক-আদালতে পারিবারিক বিবাদ মিটাইয়া ফেলা হইতেছে। এই প্রেক্ষিতে কলিকাতা হাইকোর্টের আইনজীবীরা যদি প্রধান বিচারপতির উপদেশ উপেক্ষা করিয়া স্রেফ সঙ্ঘবদ্ধতার দাপটে কর্মবিরতির বোঝা বিচারব্যবস্থার উপর চাপাইয়া দেন, তাহা অপেক্ষা দুর্ভাগ্যজনক আর কী হইতে পারে! দৃশ্যত প্রধান বিচারপতির অনুশাসনের বিলম্বিত প্রভাবেই মঙ্গলবার হাইকোর্টে অন্য ছবি দেখা গিয়াছে, প্রয়াত কমল বসুর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন উপলক্ষে আদালতের কাজ বন্ধ হয় নাই। এই দৃষ্টান্ত ব্যতিক্রমী। ব্যতিক্রমী হইয়াই থাকিবে না তো? |