|
|
|
|
দুর্নীতিতে অস্তে নিতিন, রাজনাথ-উদয় |
অনমিত্র সেনগুপ্ত • নয়াদিল্লি |
সঙ্ঘকে ধাক্কা দিল সঙ্ঘবদ্ধ বিজেপি। নেতৃত্বে লালকৃষ্ণ আডবাণী। দলে এক সময় যাঁর পরিচয় ছিল লৌহপুরুষ হিসেবে। সেই ধাক্কায় আজ শেষ মুহূর্তে, নাটকীয় ভাবে পিছু হঠতে বাধ্য হল নাগপুর। আগামিকাল যাঁর পুনর্নির্বাচন চূড়ান্ত বলে মনে করা হচ্ছিল, সেই নিতিন গডকড়ী আজ রাতে ইস্তফা দিতে এক রকম বাধ্য হলেন। সভাপতি পদের লড়াইয়ে একদম প্রথম সারিতে চলে এলেন উত্তরপ্রদেশের ঠাকুর নেতা রাজনাথ সিংহ। লড়াইয়ে বেঙ্কাইয়া নায়ডুর নাম থাকলেও দ্বিতীয় বারের জন্য সভাপতি পদে রাজনাথের নাম চূড়ান্ত বলেই মনে করছে বিজেপি শিবির।
অথচ, গডকড়ীকে সভাপতি পদে পুনর্নির্বাচন করতে হবে, এটাই ছিল সঙ্ঘ পরিবারের ধনুকভাঙা পণ। এমনকী, কিছু দিন আগেও মোহন ভাগবত আডবাণীকে জানিয়েছিলেন যে, গডকড়ীকেই আরও এক বার সুযোগ দেওয়া উচিত। পরিস্থিতি এমন একটা পর্যায়ে চলে যায় যে, আডবাণী তখনকার মতো তা মেনে নিতে বাধ্য হন। আডবাণী আরএসএসের কাছে গডকড়ীর বদলে সুষমা স্বরাজের নাম প্রস্তাব করলেও রাজি ছিল না নাগপুর। আবার অরুণ জেটলির নামে সম্মত ছিলেন না আডবাণী। তাঁর বক্তব্য ছিল, অরুণের ভাবমূর্তি স্বচ্ছ। কিন্তু ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে উত্তর ভারতে হিন্দি বলয়ের এক জন ধুতি পরা নেতা প্রয়োজন। যিনি মূলত আমজনতার প্রতিনিধি। আডবাণীর পছন্দ ছিলেন শাড়ি পরা উত্তর ভারতের হিন্দিভাষী নেত্রী সুষমা। কিন্তু তাঁকে আবার সঙ্ঘের নাপসন্দ। এই পরিস্থিতিতে গডকড়ীকে মানতে বাধ্য হন আডবাণী। এ দিকে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গেও গডকড়ীর বোঝাপড়া হয়। আরএসএস মোদীকে জানিয়েছিল, সভাপতি পদে নিতিনকে মেনে নিলে তাঁকে লোকসভা ভোটের প্রচার কমিটির প্রধান করা হবে। অর্থাৎ, সাফ হবে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়ার রাস্তা। তাই রাজি হয়ে যান মোদী। |
বুড়ো হাড়ে...
|
মঙ্গলবার মুম্বইয়ে দু’জন। তত ক্ষণে আডবাণীরই চালে নড়ে গিয়েছে নিতিনের গদি।
তৈরি হয়েছে রাজনাথের ফেরার রাস্তা। ছবি: পিটিআই |
নাটক জমে গেল একেবারে শেষ মুহূর্তে। গোটা বিষয়টি ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছে যাওয়ার পিছনে সব চেয়ে বড় কারণ, আয়কর দফতরের অভিযান। আজ মুম্বইয়ে নিতিন-ঘনিষ্ঠ বিভিন্ন সংস্থার দফতরে আয়কর তল্লাশির পর থেকেই ছবি বদলাতে শুরু করে। ওই সংস্থাগুলির সঙ্গে নিতিন-ঘনিষ্ঠ সংস্থা পূর্তির লেনদেন রয়েছে বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। নিতিন ও তাঁর ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে কর ফাঁকি দেওয়ারও। দলীয় সভাপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকায়, আডবাণী ও জেটলি সঙ্ঘের কাছে গডকড়ীকে দ্বিতীয় দফায় সভাপতি করা নিয়ে আপত্তি জানান। আরএসএসের পক্ষ থেকে আডবাণীকে জানানো হয়, দুর্নীতির অভিযোগে গডকড়ীকে সরালেই ফল ভাল হবে, এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় এর আগে কর্নাটকে ইয়েদুরাপ্পাকে সরাতে বাধ্য হয়েছে দল। কিন্তু তার ফলে সে রাজ্যে এখন ক্ষমতা হারানোর উপক্রম হয়েছে দলের। এর মাধ্যমে বিজেপি-র শীর্ষ নেতৃত্বকে আরএসএস বুঝিয়ে দেয় যে, ক্ষমতার উৎস আসলে তারাই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একজোট বিজেপি নেতৃত্বের চাপে পিছু হঠতে হল সঙ্ঘকেই।
রাতে ইস্তফা দিতে বাধ্য হলেও এ দিন সকাল পর্যন্ত নিজের জয়ের ব্যাপারে প্রায় নিশ্চিত ছিলেন গডকড়ী। কিন্তু আয়কর দফতরের তল্লাশি শুরু হওয়ার পর নিতিন-বিরোধী শিবির সরব হয়। সঙ্ঘের কাছে তারা প্রশ্ন তোলে, জয়পুরে রাহুল গাঁধীর মতো নবীন, কংগ্রেসের দুর্নীতিমুক্ত এক নেতা যখন নতুন ভারতের স্লোগান দিচ্ছেন, বিজেপি তখন কেন এক জন অভিযুক্তকে দলের শীর্ষ পদে নতুন করে বসাচ্ছে? লোকসভা ভোটের আগে গডকড়ীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে মুখ পুড়বে বিজেপিরই। গডকড়ী-বিরোধীরা এ-ও মনে করেন যে, নিজেদের সভাপতির কারণেই কংগ্রেসের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সে ভাবে আক্রমণ শানাতে পারছে না বিজেপি।
এই পরিস্থিতিতে আজ হাল ধরেন আডবাণী। এ দিন সকালে তিনি মুম্বইয়ে বৈঠক করেন আরএসএস-নেতা সুরেশ সোনির সঙ্গে। সঙ্ঘ-রাজনীতিতে যিনি সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবতের বিরোধী বলে পরিচিত। বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্বকে একজোট হয়ে নিতিনের বিরুদ্ধে মরণ-কামড় দেওয়ার পরামর্শ দেন সোনি। আয়কর-তল্লাশি হয়ে ওঠে তার প্রধান ইন্ধন। এর পরেই আডবাণী বিষয়টি নিয়ে আলাদা ভাবে জেটলি, সুষমা, রাজনাথ, বেঙ্কাইয়া, অনন্ত কুমারের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁদের বোঝান, বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব একজোট হয়ে চাপ দিলে সঙ্ঘ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হবে। আডবাণীর যুক্তি ছিল, নাগপুর দলকে দিশা দেখাতে পারে, কিন্তু দলের দৈনন্দিন বিষয়ে মাথা গলাতে পারে না। বিজেপি সূত্র বলছে, আডবাণীর প্রস্তাব মেনে নেন সকলে। দুপুরে রাজনাথকে জানিয়ে দেওয়া হয়, তিনি যেন দিল্লি ছেড়ে না যান। বিকেলে বিজেপির সদর দফতরে বৈঠকে বসেন রাজনাথ-অনন্ত কুমার-বেঙ্কাইয়া নায়ডুরা। রাত ন’টা নাগাদ বৈঠকে বসেন সুষমা-জেটলি। তাঁরাও সোনি-আডবাণীর প্রস্তাবে সম্মতি দেন। সূত্রের খবর, প্রায় একই সময়ে ভাইয়াজি জোশীর সঙ্গে কথা হয় নিতিনের। এবং তখনই নিতিনকে সরে দাঁড়ানোর বার্তা দেন ভাইয়াজি।
রাজনীতির কারবারিরা মনে করছেন, বিজেপিতে এখন প্রধানমন্ত্রী পদের মূল দাবিদার হিসেবে থাকলেন জেটলি, সুষমা ও মোদী। সভাপতি হলে রাজনাথ এই দৌড়ে কিছুটা পিছিয়ে যাবেন, এটা বুঝেই তাঁর নাম মেনে নেন জেটলি-সুষমা। বিজেপি-র একজোট শীর্ষনেতৃত্ব ও সঙ্ঘের একাংশের চাপে শেষ পর্যন্ত সরে দাঁড়ানোর কথা ঘোষণা করেন গডকড়ী। রাতে জানান, তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে। এতে দলের ক্ষতি হোক, তিনি চান না। তাই ইস্তফা। |
|
নিতিন-ঘনিষ্ঠ সংস্থার সঙ্গে জড়িত কিছু সংস্থায় আয়কর তল্লাশি |
মুম্বইয়ে আডবাণীর সঙ্গে বৈঠকে আরএসএস নেতা সুরেশ সোনি |
আলাদা করে জেটলি, সুষমা, রাজনাথদের সঙ্গে কথা আডবাণীর |
|
রাজনাথকে ফোন করে দিল্লিতে থাকার পরামর্শ |
|
বিজেপি দফতরে বৈঠকে অনন্ত কুমার, বেঙ্কাইয়া, রাজনাথ |
|
জেটলি-সুষমা বৈঠক |
দিল্লি ফিরলেন আডবাণী |
‘তুমিই সভাপতি’, রাজনাথকে বার্তা অনন্ত কুমারদের |
|
গডকড়ী সরে যাওয়ায় রাজনাথের নির্বাচন প্রায় চূড়ান্ত বলেই মনে করছে দল। জিন্না-কাণ্ডে আডবাণী সভাপতি পদ থেকে সরে যাওয়ার পরে দলের সভাপতি হয়েছিলেন রাজনাথই। এ বার বেঙ্কাইয়া দৌড়ে থাকলেও তিনি দক্ষিণের নেতা। যশবন্ত সিনহার নাম উঠে এলেও সুষমা-জেটলির আপত্তি রয়েছে তাঁর ব্যাপারে।
এ দিনের এই গোটা পর্বে যাঁকে কিছুটা দূরে থাকতে দেখা গেল, তিনি নরেন্দ্র মোদী। বিজেপির একটি শিবিরের বক্তব্য, গডকড়ীর ইস্তফা দেওয়ায় মোদীকে প্রচার কমিটির প্রধান করার যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা-ও আপাতত অনিশ্চিত হয়ে পড়ল। তবে অন্য একটি অংশ বলছে, কংগ্রেস যেখানে রাহুলকে সামনে রেখে লড়াইয়ের কথা ঘোষণা করেছে, সেখানে টক্কর দিতে দলের অধিকাংশ কর্মী-সমর্থকই চাইছেন মোদীকে। দ্বিতীয় দফায় জিতে আসা মোদীর ক্যারিশমা, টাটা-অম্বানীদের পাশে পাওয়া চনমনে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী দলে নিজের রাস্তা সাফ করতে ধাপে ধাপে এগোচ্ছিলেন। সেই অঙ্কেই গডকড়ীকে সমর্থন করেছিলেন। নাটকীয় পরিবর্তনে কি মোদীর সেই হিসেব গুলিয়ে যাবে? দলের ওই অংশের বক্তব্য, দলের মধ্যে এই মুহূর্তে সব থেকে উজ্জ্বল মুখ তথা বিকাশপুরুষ মোদী সম্ভবত এই ধাক্কা সামলে উঠবেন। তবে আজকের দিনটা তাঁর কাছে ধাক্কা তো বটেই। বুড়ো হাড়ে যে ভেল্কি দেখালেন আডবাণী, তাতে প্রশ্ন রয়ে গেল, শেষ প্রহরে কি তিনিই কিস্তি মাত করবেন? সেই লড়াইয়ে কী হবে, তা সময় বলবে। তবে এ দিন লৌহপুরুষের চালে নীরবই রইলেন বিকাশপুরুষ। |
|
|
|
|
|