পুলিশের আচরণবিধি মেনে দেহরক্ষীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। এ জন্য কোথায় উপর মহল থেকে পুরস্কার পাবেন, না জুটেছে সাজা। তাঁকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে রেখেছেন উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ!
বর্ধমান জেলার সভাধিপতি উদয় সরকারের দেহরক্ষী ছিলেন মধুসূদন ঘোষ। তাঁর ‘অপরাধ’, সশস্ত্র দুষ্কৃতীদের আক্রমণ থেকে সভাধিপতিকে প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন তিনি। অভিযোগ, ওই দুষ্কৃতীরা সকলেই তৃণমূল-আশ্রিত।
মধুসূদনবাবুর বিরুদ্ধে ‘অবিচারের’ প্রতিবাদ জানিয়ে সরকারের পাঠানো অন্য দেহরক্ষীকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন
|
মধুসূদন ঘোষ |
উদয় সরকার। রাজ্যপালকেও জানান গোটা ঘটনা। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন মহাকরণে বার্তা পাঠিয়ে কৈফিয়ত তলব করেছেন সরকারের কাছে। জানতে চান, বধর্মানের সভাধিপতির অভিযোগটি নিয়ে সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে? কেন এমন ঘটল? সরকারকে অবিলম্বে পদক্ষেপ করারও নির্দেশ দিয়েছেন রাজ্যপাল।
রাজ্যপালের বার্তা পেয়ে এখন রাজ্য প্রশাসন নড়ে বসেছে বলে স্বরাষ্ট্র দফতরের খবর। বিষয়টি নিয়ে বর্ধমান জেলা প্রশাসনের কাছে রিপোর্ট তলব করা হয়েছে। প্রশাসনের এক কর্তা জানান, সরকার বিষয়টির দ্রুত নিষ্পত্তি চায়। রাজ্যপালকেও সরকারের অবস্থান জানিয়ে দেওয়া হবে। তবে জেলা প্রশাসনের রিপোর্ট এখনও মহাকরণে পৌঁছায়নি।
সে দিন কী ঘটেছিল?
বর্ধমান জেলার সভাধিপতি সিপিএম নেতা উদয় সরকার রাজ্যপালকে পাঠানো চিঠিতে লিখেছেন, গত ১৯ নভেম্বর তিনি বাড়ি থেকে বর্ধমান শহরে আসছিলেন। সেই সময় ফোনে জানতে পারেন, রায়না থানার শ্যামুসন্দর বাজারের কাছে নারুগ্রাম হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সুফি মহম্মদ মফিজুর রহমানকে এক দল দুষ্কৃতী প্রচণ্ড মারধর করছে। মফিজুর খুনও হয়ে যেতে পারেন। তখনই তিনি ওই স্কুলে যান। দেখেন, প্রধানশিক্ষককে মাটিতে ফেলে মারছে দুষ্কৃতীরা। উদয়বাবুকে দেখে কয়েক জন তাঁকেও আক্রমণ করে। উপায় না দেখে তাঁর দেহরক্ষী মধুসূদন ঘোষ নিজের সার্ভিস রিভলভারটি বের করে ভয় দেখালে দুষ্কৃতীরা নিরস্ত হয়। মধুসূদনবাবুই তাঁকে নিরাপদে এলাকা থেকে বার করে নিয়ে যান। তত ক্ষণে পুলিশও চলে আসে।
এই ঘটনার কিছু ক্ষণের মধ্যেই পুলিশ সুপারের অফিস থেকে উদয়বাবুর দেহরক্ষীকে ডিউটি ছেড়ে পুলিশ লাইনে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। পরের দিন তাঁকে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়। মধুসূদনবাবুর পরিবর্তে নতুন এক জন দেহরক্ষীও পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাঁর কাছে। সভাধিপতি অবশ্য সেই দেহরক্ষীকে ফিরিয়ে দেন।
তিনি কি দুষ্কৃতীদের চেনেন? জবাবে উদয়বাবুর অভিযোগ, “যারা আমাকে আক্রমণ করেছিল, তারা সকলেই তৃণমূল-আশ্রিত বলে খবর নিয়ে জেনেছি। আমার প্রাণ বাঁচিয়ে দায়িত্ব পালনের জন্য আমার নিরাপত্তা কর্মীকেই বরখাস্ত করা হল!” উদয়বাবুর আরও অভিযোগ, “মুখ্যসচিবকে পুরো ঘটনা লিখে জানিয়েও কোনও কাজ হয়নি। এই জন্যই রাজ্যপালের দ্বারস্থ হয়েছিলাম। তিনি সরকারকে ব্যবস্থা নিতে বলেছে শুনে আমি খুশি।” তবে, বিষয়টি নিয়ে কোনও কথা বলতে চাননি বরখাস্ত পুলিশকর্মী মধুসুদন ঘোষ। জেলার পুলিশ সুপার সৈয়দ মির্জা জানান, ওই ঘটনা নিয়ে সরকারকে আগে দু’টি রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে। এসপি-র সাফাই, “ঘটনার সময় সভাধিপতির দেহরক্ষী সাদা পোশাকে ছিলেন। তিনি হঠাৎ রিভলভার দেখানোয় এলাকায় উত্তেজনা তৈরি হয়। বড় কিছু হয়ে যেতেও পারত। তাঁকে সাসপেন্ড করে বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়েছে।” উদয়বাবুর রক্ষী না-নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমি তো দেহরক্ষী প্রত্যাহার করিনি। কমান্ড সার্টিফিকেটের (সিসি) পিছনে সই করে সভাধিপতিই তাঁকে ছেড়ে দিয়েছেন। ফিরোজ হোসেন নামে অন্য এক দেহরক্ষীকে পাঠানো হয়েছিল। সভাধিপতি অন্য দেহরক্ষী নিতে অস্বীকার করেন।”
এসপি-র বক্তব্য অবশ্য মানতে চাননি উদয়বাবু। তিনি বলেন, “সে দিন দেহরক্ষী অস্ত্র না দেখালে আমার প্রাণ যেত। তা ছাড়া ফেরত যাওয়ার জন্য এসপি-র অফিস এবং পুলিশ লাইন থেকে ওই দেহরক্ষীকে বার বার চাপ দেওয়া হচ্ছিল।” কিন্তু এসপি-র কথামতো, তিনিই তো দেহক্ষীকে ছেড়ে দিয়েছেন? সভাধিপতির জবাব, “ডিউটি করে চলে যাওয়ার আগে প্রতিদিনই আমাকে সিসি-র পিছনে সই করতে হত। এটাই নিয়ম। দেহরক্ষী তো পুলিশ সুপারের অধীনস্থ কর্মী। তাঁকে আমি ছাড়িয়ে দেবার কে?”
বর্ধমানের তৃণমূল নেতা কৃষিমন্ত্রী মলয় ঘটককে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “অনেক পুরনো ঘটনা। রাজ্যপাল রিপোর্ট চেয়েছেন কি না আমার জানা নেই। তা নিয়ে আমি কিছু বলবও না। কিন্তু উদয় সরকার দেহরক্ষী নেবেন কি নেবেন না, সেটা একেবারেই তাঁর ব্যাপার।” বর্ধমানের অন্য এক তৃণমূল নেতা বলেন, “বিষয়টি যখন রাজ্যপাল পর্যন্ত পৌঁছেছে, তিনি রিপোর্ট চেয়েছেন, তখন আমাদের আর কী-ই বলার থাকতে পারে!” |