দুষ্টু লোকটা ভ্যানিশ
ম্যাদামারা বাঙালি সেই প্রথম মঞ্চে ‘দুষ্টু লোক’ দেখল। কপালে ভ্রুকুটি, মুখে দাড়ি, পরনে ডেনিম, হাতে গিটারএক মাঝবয়সি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে গোটা স্টেজ, মাঝেমধ্যে পবিত্র ক্ষোভে তেড়ে উঠছে পাড়ার প্রোমোটার, দোর্দণ্ডপ্রতাপ শাসকদল বা অপছন্দের প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে। ব্যাস, ভর্তি হল ফেটে পড়ছে করতালিতে‘এই তো চাই’, ‘তোমাকে চাই’ ধ্বনি উঠছে মুহুর্মুহু। সেটা ১৯৯৩।
দুষ্টু লোকটা ভ্যানিশ!
সহাস্য মুখে প্রশান্ত এক প্রৌঢ় বসে গদিমোড়া চেয়ারে। সামনে হারমোনিয়াম, পাশে সমান গুরুত্বে অনুজ কন্ঠশিল্পী। তিন-চারের দশক থেকে সাম্প্রতিক অতীত, অসংখ্য হারিয়ে যাওয়া গানের মণিমুক্তো তুলে আনছেন অনায়াস দক্ষতায়। ক্লান্তিহীন, যেন বাংলা গানের চলমান এনসাইক্লোপিডিয়া বা ‘গুগল আঙ্কল’। কী আশ্চর্য, গোটা অনুষ্ঠানে একবারও চটলেন না, চেয়ার ছেড়েও উঠলেন না!
এটাও সুমন! ২০১৩-র।
সে সময়ে স্কুলের এক বিচ্ছু বন্ধু বলেছিল, আমাদের একটাই আত্মপরিচয়পদবি, কিন্তু সুমনের তিনটেপদবি, দাড়ি আর গিটার। তাঁর ‘চল্লিশ পেরোলেই চালশে’ প্রায় প্রবাদের মর্যাদা পেয়েছে, তেষট্টি পেরোলে আত্মপরিচয় পাল্টাতে পারে কিনা এখনও লেখেননি নাগরিক কবিয়াল।
“আজ আমি আর অতটা গিটারে নেই,” একটা উইকেট খসালেন সুমন। “গিটার আমার কয়েকটা গানে একই সঙ্গে সুর-ছন্দ দিয়েছে বটে, তবে সব কিছুকে তো গিটার ধারণ করতে পারছে না। বরং গিটারের জায়গায় চলে এসেছে বৈদ্যুতিন তানপুরা, সারেঙ্গি বা হারমোনিয়াম। গিটার যদি কোনও গানে ঢোকে আপত্তি নেই। কিন্তু আমি বাজাব না। কোনও পেশাদার গিটার শিল্পী বাজাবেন। ‘গিটার অন্ত প্রাণ’ হয়ে বেঁচে থাকলে তো যে ধ্বনিগুলো সঙ্গীতকে সৃষ্টি করেছে, তা থেকেই বঞ্চিত হব,” কবীর সুমন স্পষ্টবাক।
২০১৩
১৯৯৩
আর তাঁর সেই অযত্ন লালিত দাড়ি, তিরানব্বই-এ তাঁর অকৃত্রিম ট্রেডমার্ক? “দাড়ি আমার এত দিন সঙ্গী ছিল যে মনে হত আমি মায়ের পেট থেকে দাড়ি নিয়েই জন্মেছি। পরিণত বয়সের আগে কখনও দাড়ি কাটিনি। ইদানীং শুকনো-রুক্ষ লাগায় ভাবলাম একটু মসৃণ হই,” শিশুর সারল্যে হাসি বাংলা আধুনিক গানের ইতিহাসস্রষ্টার। একই সঙ্গে এল তৃতীয় পরিচিতির অনিবার্য প্রশ্নের উত্তরের বাউন্সারটাও“ক্যাসিয়াস ক্লে যখন থেকে মহম্মদ আলি হলেন তাঁর ঘুষির জোর বা চুমুর স্টাইল কি পাল্টেছিল?” গানওয়ালার মুখে ফাজিল হাসি।
কিন্তু কে গ্যারান্টি দিতে পারে যে গানওয়ালার এই মুহূর্তের এই সব অবস্থান আর পাল্টাবে না? কোনও দিন আবার হাতে গিটার তুলে নেবেন না কবীর, বাঙালিকে নস্টালজিক করে প্রায় দোতারার সুরে বেজে উঠবে না ‘যদি ভাবো কিনছ আমায়?’ সুমন নিজেই তো বলেন, এই পৃথিবীতে তাঁর দেখা সবচেয়ে বেহিসেবি লোক তিনি নিজে। তবে ইদানীং তিনি গিটার-প্রীতির ভয়ঙ্কর বিপদও দেখছেন। “এত লোক আজকাল গিটার শিখছে যে দেশের গানবাজনা থেকে মানুষের মন চলে গেছে।” তবে শুধু তাঁরই অবস্থান বা মূল্যায়ন তো বদলায় না, তাঁর সম্পর্কে অন্যান্যদের ধারণারও তো আমূল পরিবর্তন ঘটে।
বছর দু’য়েক আগে কবীরের আড়ালে অনেক রাজনীতির কারবারি তাঁকে ‘মাওবাদী’ বলে গাল পেড়েছেন। নব্বইয়ের দশকে অনেকে তাঁকে ‘নকশাল’ বলেও সন্দেহ করেছে। ২০১৩-র কবীর কিন্তু অটল প্রত্যয়ে বলেন, “পুঁজিবাদ ছাড়া গতি নেই।” প্রশ্ন তোলেন, “ওবামার নেতৃত্বে থাকলে আমাদের দেশের নেতারা যেমন রেখেছেন, তার থেকে খারাপ থাকতাম কি?” প্রতি মুহূর্তে সেলফোন, ল্যাপটপ ব্যবহার করেও পুঁজিবাদের মুণ্ডুপাত আজ সুমনের কাছে নিখাদ ভণ্ডামি। আজ তাঁর উপলব্ধি “কৃষি বিপ্লব এখানে হলে খুব সুখে দিন কাটবে বলে মনে হয় না।” অনিবার্য বাস্তব বলে মানেন বলে সুমন আজ এফডিআই-এরও সমর্থক।
এখন...
বাস্তব কখনও কখনও চমৎকৃতও করে। কবীর সুমন এই মুহূর্তে তৈরি করছেন তাঁর প্রথম ছবির শ্যুটিং-স্ক্রিপ্ট। বাংলার প্রথম মিউজিক্যাল যে ছবির প্রতিটি সংলাপ বলা হবে সুরে-তালে। সহজ গল্প- বেশির ভাগ চরিত্রই নবীন। গ্রুপ থিয়েটারের ছেলেমেয়েদের দিকেই নজর কবীরের। তবে সবটাই স্বকণ্ঠে। তাই এই মিউজিক্যালে অভিনয়ের জন্য গাইতে জানতে হবে। “স্টার চাই না। প্রসেনজিৎবাবুকে নিলে তো তাঁকে গাইতেও হবে।” গানওলা এখন বায়োস্কোপওলাও। বন্ধু সুমন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনা চলছে। এক বাঙালি প্রযোজকও তৈরি। “বাংলাদেশের চ্যানেলে টেলিফিল্ম করে বুঝেছিলাম আমি একজন বি-গ্রেড আন্তর্জাতিক ছবি নির্মাতা হতে পারতাম। আনকোরা আনাড়ি নই, একটা ছবি কী করে হয়ে ওঠে সে ব্যাকরণটা আমার জানা,” কবীরের গলায় টগবগে আত্মবিশ্বাস। “তবে ১৯৯৩-এ এ সব ভাবতেও পারিনি।”
১৯৯৩ থেকে ২০১৩ কুড়ি বছরে কবীর সুমন পাল্টেছেন কতটা? “বড় হইনি, বুড়ো হয়েছি কেবল,” নিজের ব্যাখ্যা। আর ২০২৩-এ কেমন হবেন? “আরও মজার হব, আরও বুড়ো, আর আরও একা।” তবে কি দুষ্টু লোকটা ভ্যানিশই হল? “বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমি আরও শয়তান হয়েছি। ভয়ঙ্কর শয়তানি ছাড়া কেউ ‘মম চিত্তে শিলাদিত্যে’ লিখতে পারে?” কবীরের প্রশ্ন।
গত সপ্তাহে জ্ঞানমঞ্চে দুঃস্থ ক্যানসার রোগীদের সাহায্যার্থে অনুষ্ঠান। মঞ্চে কবীর ও শ্রীকান্ত আচার্য। কবীর ‘পোকার ফেস’-এ বলে চলেছেন, “আমি আর শ্রীকান্ত, দু’জনেই বাংলা গানে পুষ্ট হয়েছিনানা ধরনের গানে। গানের ক্ষেত্রে আমাদের দু’জনের খুব মিলআমরা দু’জনেই বহুগামী।” কয়েক সেকেন্ডের হিরণ্ময় নীরবতা। দর্শক অপেক্ষায় আরও কিছুর। স্মিত হেসে আবার মুখ খুললেন কবীর সুমন, “আমি অবশ্য অন্য ক্ষেত্রেও বহুগামী, শ্রীকান্ত নন।” মুহূর্তে হলে অসংখ্য পায়রা উড়ল।
দুষ্টুমি না শয়তানি?
দুষ্টু লোকটা কি তবে ভ্যানিশ হয়নি?



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.