যাবজ্জীবন স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ির
সর্বস্বান্ত হয়েও মেয়ের খুনিদের শাস্তিতে স্বস্তি
মামলা চালাতে গিয়ে বিক্রি হয়ে গিয়েছে গাড়ি-বাড়ি। রাত শেষ হতেই ভোরের ট্রেন ধরে ছুটতে হতো প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে হাইকোর্টে। অবশেষে সোমবার মেয়ের হত্যাকারীদের শাস্তি পেতে দেখে স্বস্তি পেলেন বৃদ্ধ পিতা। দেবশ্রী বসু নামে তাঁর অন্তঃসত্ত্বা মেয়েকে পুড়িয়ে মারার দায়ে স্বামী ও শ্বশুর-শাশুড়িকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিল বারাসত আদালত।
দেবশ্রী
কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে ২০০৫ সালের ১১ অগস্ট উত্তর ২৪ পরগনার রাজারহাটে কলাবেড়িয়ার বেসরকারি চাকুরে অর্ঘ্য বসুর সঙ্গে মেয়ে দেবশ্রীর বিয়ে দিয়েছিলেন বনগাঁর মোতিগঞ্জের বাসিন্দা প্রদীপ মিত্র। অভিযোগ, ‘শিক্ষিত ও বড়’ পরিবারে মেয়ের বিয়েতে যৌতুক হিসেবে নানা জিনিসপত্র, ১০ ভরি সোনার গয়না ছাড়াও ৭৫ হাজার টাকা পণ দিতে হয়েছিল। তবুও বিয়ের পর থেকে নানা অছিলায় বাপের বাড়ি থেকে টাকা আনার জন্য দেবশ্রীর উপরে চলত অত্যাচার। বহু চেষ্টাতেও শ্বশুরবাড়ির মন রাখতে না পেরে ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বনগাঁয় বাপের বাড়িতে ফিরে আসেন দেবশ্রী।
এর পর থেকেই শুরু হয় অন্য লড়াই। প্রথমে বারাসত আদালতে বধূ নির্যাতনের মামলা করেন দেবশ্রী। বেশ কিছু দিন মামলা চলার পরে তা স্থানান্তরিত হয় বনগাঁ আদালতে। অর্ঘ্য বিচারকের কাছে জানায়, সে ‘ভুল’ বুঝতে পেরেছে, এখন ফের সংসার করতে সে আগ্রহী। ভর্ৎসনা করেও তাকে সেই সুযোগ দেয় আদালত। দেবশ্রী কিন্তু আদালতে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তাঁকে মেরে ফেলবে। তাঁকে ‘নির্ভয়ে’ শ্বশুরবাড়িতে ফিরে যেতে বলে আদালত জানায়, এর পরে কোনও সমস্যা হলে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। সেটা ২০০৯ সাল। কিন্তু ফের অত্যাচার শুরু হওয়ায়, পরের বছরই ২৬ মার্চ তাঁকে বাপের বাড়ি ফিরে আসতে হয়। তখন তিনি তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা।
রায়ের পরে দেবশ্রীর বাবা-মা।—নিজস্ব চিত্র
এর দিন দুই পরে দেবশ্রী যখন ফের আদালতে যাওয়ার কথা ভাবছেন, শ্বশুরবাড়ির লোকেরা এসে তাঁকে ফের বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যায়। প্রদীপবাবু বলেন, “মেয়ে আমার পা ধরে কাঁদছিল। যেতে চাইছিল না। কিন্তু ওর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা এমন ভাবে কথা বলছিল যে ভাবতে পারিনি, ওরা আবার অত্যাচার করতে পারে। মেয়েকে বলেছিলাম, ‘একটু মানিয়ে নিস মা।’ আজও তার জন্য আফশোস হয়।” পরের দিনই, ২৯ মার্চ দেবশ্রীকে বাড়ির মধ্যেই গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে মারা হয়। প্রদীপবাবু বলেন, “খবর পেয়ে আমি যখন আর জি কর হাসপাতালে যাই, মেয়ে আর নেই।” মেয়ের সেই দগ্ধ চেহারা আজও ভুলতে পারেন না বাবা।
সৎকার করেই ‘শেষ দেখার’ লড়াইয়ে নেমেছিলেন প্রদীপবাবু। রাজারহাট থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়। পুলিশ অর্ঘ্য, তাঁর বাবা সুপ্রকাশ বসু ও মা দীপালিকে গ্রেফতার করে। বারাসত আদালতে শুরু হয় মামলা। অর্ঘ্যর প্রভাবশালী পরিবার জামিনের জন্য পাঁচ বার হাইকোর্টে আবেদন করে। পরিবহণ ব্যবসায়ী প্রদীপবাবু দুই আদালতে মামলা চালাতে গিয়ে নিজের ট্রাক এবং চার বিঘে জমি বিক্রি করে দেন। বনগাঁ থেকে নিয়মিত হাজিরা দিতে থাকেন হাইকোর্ট এবং বারাসত আদালতে। বৃদ্ধের কথায়, ‘‘সারা রাত ঘুম হত না। অন্ধকার থাকতে বেরিয়ে ভোরের ট্রেন ধরে চলে যেতাম আদালতে। বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যেত। আত্মীয়েরা বলতেন, শরীরে সহ্য হবে না। কিন্তু আমি কী করে হাত ধুয়ে ফেলব?”
অবশেষে শনিবার অর্ঘ্য ও তার মা-বাবাকে দোষী সাব্যস্ত করেন বারাসত আদালতের জেলা ও দায়রা বিচারক নির্মল ঘোষাল। প্রথমে এই মামলার সরকারি কৌঁসুলি ছিলেন প্রীতীশ দাশগুপ্ত, পরে দায়িত্ব পান মহেশ্বর বন্দ্যোপাধায়। মহেশ্বরবাবু বলেন, “সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ বিচার করে সোমবার তিন জনকে যাবজ্জীবন সাজা ও ৩ হাজার টাকা জরিমানার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক।”
মেয়ের মৃত্যুর পরেই স্নায়ুরোগে বিছানা নিয়েছিলেন প্রদীপবাবুর স্ত্রী কল্যাণীদেবী। রায় শোনা ইস্তক তিনি অঝোরে কেঁদে চলেছেন। খালি বলছেন “ওরা মেয়ে-নাতি দু’জনকেই মেরেছে।”
প্রদীপবাবুও কাঁদছেন। সব জয়েই কি মানুষ হাসতে পারে?



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.