কর্মরত অবস্থায় সরকারি কর্মী বা শিক্ষকের মৃত্যুতে পোষ্যকে চাকরি দেওয়ার ক্ষেত্রে গড়িমসি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করল কলকাতা হাইকোর্ট।
টানা ১২ বছর মামলা চলার পরে শেষ পর্যন্ত আদালতের নির্দেশে এক প্রাথমিক স্কুলশিক্ষকের ছেলে মৃত বাবার জায়গায় চাকরি পেয়েছেন। ছেলে মহম্মদ ইসমাইল যাতে ওই অধিকার থেকে বঞ্চিত না-হন, সেই জন্য আসল লড়াইটা লড়েছেন তাঁর মা মৃত শিক্ষক মহম্মদ সানাউল্লার স্ত্রী সায়েরা বানু। বছরের পর বছর মামলা চলা সত্ত্বেও যিনি ধৈর্য হারাননি, সুবিচারের আশা ছাড়েননি। মনের জোর নিয়ে ঘুরেছেন আদালতে আদালতে। তাঁর এই হয়রানির কথা জেনে রাজ্যের স্কুলশিক্ষা দফতরের কাজকর্ম নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ।
আদালত সূত্রের খবর, মুর্শিদাবাদের নতুন নলডহরি গ্রামের ফতেপুর প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক সানাউল্লা রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৯৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কর্মরত অবস্থায় মারা যান। ছেলে ইসমাইল তখন মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। সায়েরা বানু জেলা স্কুল পরিদর্শকের কাছে আবেদন করেন, তাঁর ছেলে সাবালক হলে তাকে যেন আইন অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষকের পদে নিয়োগ করা হয়। জেলা স্কুল পরিদর্শক সেই আবেদন গ্রহণ করেন। ইসমাইল উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পরে এক বছর কেটে গেলে তাঁর মা নতুন করে স্কুল পরিদর্শকের কাছে আবেদন করে বলেন, ছেলে সাবালক হয়েছে, উচ্চ মাধ্যমিক পাশও করেছে। তাকে যেন এ বার চাকরি দেওয়া হয়। তখন ওই শিক্ষকের পরিবারকে প্রায় অনাহারে দিন কাটাতে হচ্ছে। এ দিকে পরিবারের সদস্য-সংখ্যা আট। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সানাউল্লার বৃদ্ধা মা-ও।
স্কুলশিক্ষা দফতর ওই আবেদনে সাড়া দেয়নি। কোনও সুরাহা হচ্ছে না দেখে সায়েরা বানু চিঠি লেখেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে। মুখ্যমন্ত্রী স্কুলশিক্ষা দফতরকে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিলেও তাদের কোনও হেলদোল দেখা যায়নি। ওই অসহায় মহিলা শেষ পর্যন্ত আদালতের দ্বারস্থ হন। স্কুলশিক্ষা দফতর যাতে বিষয়টি বিবেচনা করে, হাইকোর্ট প্রথমে সেই মর্মে নির্দেশ দেয়। তার পরেও কিছু হয়নি।
বিচারপতি হরিশ টন্ডন এর পরে আবেদনকারিণীর ছেলেকে প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরিতে নিয়োগের নির্দেশ দেন। কিন্তু রাজ্য প্রাথমিক শিক্ষা সংসদ জানায়, ওই শিক্ষকের মৃত্যুর পরে তাঁর ছেলে সাবালাক হওয়ায় তাঁকে এই চাকরি দেওয়া সম্ভব নয়। সংসদের নির্দেশের বিরুদ্ধে মামলা করেন আবেদনকারিণী। বিচারপতি নাদিরা পাথেরিয়া সংসদকে পুনরায় বিষয়টি বিবেচনা করতে বলেন। এ ভাবেই কাটতে থাকে বছরের পর বছর। হাইকোর্ট ইসমাইলকে নিয়োগের নির্দেশ না-দেওয়ায় সায়েরা বানু অতঃপর ডিভিশন বেঞ্চে আবেদন করেন। বিচারপতি প্রণব চট্টোপাধ্যায় ও বিচারপতি তরুণ দাসের ডিভিশন বেঞ্চ রাজ্যের স্কুলশিক্ষা দফতরের অধিকর্তাকে নির্দেশ দেয়, অবিলম্বে ইসমাইলকে নিয়োগপত্র দিতে হবে।
আবেদনকারিণীর আইনজীবী এক্রামুল বারি বলেন, “এক যুগ ধরে সরকারের উদাসীনতা, সংবেদনশীলতার অভাব এবং দায়সারা মনোভাবের জন্যই গ্রামের এক বিধবা এত কষ্ট পেলেন। অথচ কর্মরত অবস্থায় কারও মৃত্যু হলে তাঁর পরিবার যাতে ভেসে না-যায়, সেই জন্যই পোষ্যকে চাকরি দেওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে আইন চালু হয়েছিল।” ইতিমধ্যেই শিক্ষকের চাকরিতে যোগ দিয়েছেন ইসমাইল। |