|
|
|
|
নতুন ভারতে নতুন কংগ্রেসই লক্ষ্য রাহুলের |
জয়ন্ত ঘোষাল • নয়াদিল্লি |
গ্রিক রাষ্ট্রদূত মেগাস্থিনিস তাঁর ‘ইন্ডিকা’ বইয়ে বলেছিলেন, ভারত এক উন্নত কৃষিপ্রধান দেশ। আজ ২০১৩ সালে কৃষি থেকে শিল্পের পথে এগিয়ে পুরনো ভারতের খোলস থেকে এক নতুন ভারতের নবজাগরণ হচ্ছে। মৌর্য বংশের পতনের প্রায় দু’শো বছর পর, ১ খ্রিস্টাব্দেও গোটা পৃথিবীর অর্থনীতির শতকরা ৩৩ ভাগ ভারতের নিয়ন্ত্রণে ছিল (তখন চিনের অংশীদারিত্ব ছিল ২৬ শতাংশ)। কিন্তু গত ১০০০ বছরের এক অবনমনের সাক্ষী হয়েছে ভারত। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে রাহুল গাঁধীকে সামনে রেখে সনিয়া গাঁধী ও মনমোহন সিংহ নতুন ভারতের পটভূমিতে এক নতুন কংগ্রেস গড়ে তুলতে চাইছেন।
এই চেষ্টা না-করে তাসের ঘরের মতো ভেঙে গিয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। আর বাজার অর্থনীতিকে গ্রহণ করে জিতে গিয়েছে চিন। পশ্চিমবঙ্গে ঠিক এই চেষ্টাই করতে চেয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। বিজেপি-তেও এই চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন লালকৃষ্ণ আডবাণী। তাঁকে দলীয় সভাপতির পদ থেকেই ইস্তফা দিতে হয়েছে।
হাজার বছরের পতনের পর নতুন ভারত গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন রাজীব গাঁধী। তার পর ’৯১ সালে নরসিংহ রাও-মনমোহন জুটি প্রথম উদারনীতির জানলা খুলে দেন। ডয়েশ ব্যাঙ্কের চিফ ইকনমিস্ট, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সঞ্জীব সান্যালের কথায়, “১৯৪৭ সালের পর ’৯১ সালে ভারতে দ্বিতীয় বিপ্লব হয়েছে। রাজীব গাঁধীর সময়ে স্যাম পিত্রোদা টেলিফোন পরিষেবায় বিপ্লব আনেন। আর ’৯১ সালের সংস্কার ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হারকে কয়েক ধাপ এগিয়ে দেয়।”
কংগ্রেস নেতৃত্ব বলছেন, এই আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন দেশে সচেতনতা বৃদ্ধি করেছে। গণতন্ত্রের বিকাশের ফলে ভারতের মধ্যবিত্ত মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০ কোটি। মধ্যবিত্ত তথা নাগরিক সমাজের অসহিষ্ণুতা-অসন্তোষ, বিদ্রোহ-বিক্ষোভ এই অগ্রগতির ফসল। জয়পুরের চিন্তন বৈঠকে সনিয়া বলেছেন, কংগ্রেসই এই অসন্তোষের মোকাবিলা করতে পারে। আর সে জন্য কংগ্রেসকে সময়োপযোগী হয়ে উঠতে হবে। রাহুলের নেতৃত্বে সুপরিকল্পিত ভাবেই সেই পথে হাঁটতে চাইছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব।
এই রণকৌশল তৈরির পিছনে তিনটি মস্তিষ্ক রাহুলকে বিশেষ ভাবে সাহায্য করেছে। স্যাম পিত্রোদা, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জয়রাম রমেশ এবং রাজ্যসভার সদস্য অশোককুমার গঙ্গোপাধ্যায়। রাজনৈতিক নেতা না-হওয়া সত্ত্বেও জয়পুরে আমন্ত্রিত ছিলেন পিত্রোদা। নন্দন নিলেকানির সঙ্গেও এ প্রসঙ্গে কথা বলেছেন রাহুল। ‘ব্ল্যাক সোয়ান’ বইয়ের লেখক নাসিম নিকোলাস টেলেব-কেও রাহুল খুব পছন্দ করেন। টেলেবের সঙ্গেও তাঁর আলোচনা হয়।
বিজেপি অবশ্য রাহুলের এই প্রচেষ্টা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। রাহুলের বক্তৃতার সমালোচনা করতে না-পারলেও বিজেপি নেতা অরুণ জেটলির অভিযোগ, “মনে হচ্ছিল যেন বিরোধী নেতার বক্তৃতা শুনছি।” নতুন কংগ্রেস গড়ার জন্য রাহুল চলতি রাজনৈতিক ব্যবস্থা, লাল বাতির সংস্কৃতি, দুর্নীতির বিরোধিতা করেছেন। অরুণের প্রশ্ন, গত আট বছর ধরে তো কংগ্রেসই ক্ষমতায়। তা হলে রাহুল এই উত্তরাধিকার থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেন কী করে? অরুণের কথায়, “সিস্টেম যদি অ্যান্টিসিস্টেম সাজতে চায়, তবে সেটা ভেক। রাহুল গায়ে নামাবলি জড়িয়ে অণ্ণা হজারে সাজতে চাইছেন।” প্রসঙ্গত, বুদ্ধবাবু যখন নতুন সিপিএম গড়ার কথা বলেছিলেন, তখনও বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছিলেন, জ্যোতি বসুর উত্তরাধিকারকে বুদ্ধবাবু অস্বীকার করেন কী করে?
কিন্তু এই তর্ক দূরে সরিয়ে রেখে মানুষ যে ৪২ বছরের যুবক রাহুলকে গ্রহণ করতে পারে, সেটা বিরোধীরা বিলক্ষণ বুঝতে পারছেন। কারণ, তাঁর কণ্ঠ নতুন। তিনি পরীক্ষিত নন।
বস্তুত, ঠিক এই ভাবেই ভারতের জনতা রাজীবকে গ্রহণ করেছিল। মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে যে তাঁর গায়ে বোফর্স দুর্নীতির ছাপ লেগেছিল, সেটা স্বতন্ত্র বিষয়।
নতুন ভারত সৃষ্টির স্লোগানের মাধ্যমে রাহুল কংগ্রেসকে ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততান্ত্রিক বৃদ্ধতন্ত্র থেকে মুক্ত করতে চাইছেন। কিন্তু জয়রাম এবং তথ্যমন্ত্রী মণীশ তিওয়ারির মতে, “নবীনতন্ত্র মানে ভারতের অন্তরাত্মার সাবেক মূল্যবোধ বিসর্জন দেওয়া নয়। সততা ও দুর্নীতি বিরোধিতা তো সবুজের অভিযানও। তিয়েনআন মেন স্কোয়ার থেকে যন্তর-মন্তর, নতুন যৌবনের দূতেরা যেখানেই বিক্ষোভ দেখান, তাঁরা কিন্তু সৎ, দুর্নীতি-বিরোধী।” সুতরাং সততা মানে গাঁধীবাদী প্রাচীনত্ব নয়। সেটাও নবীনের ধর্ম। ঠিক এটাই আজ রাহুলের মন্ত্র। সমাজতাত্ত্বিক দীপঙ্কর গুপ্ত বলেন, “আধুনিকতা মানে শুধু আই-ফোন আর ইন্টারনেট ব্যবহার করা নয়। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে যদি কেউ সতীদাহকে সমর্থন করে, তবে তা-ও প্রাচীনত্ব।” তিনি এটাকে বলেছেন ‘মিসটেকেন মর্ডানিটি’। রাহুল ব্রিগেডের সদস্য মীনাক্ষী নটরাজন বলেন, “এক জন দর্শনের অধ্যাপক জিন্স পরেও সক্রেটিস পড়াতে পারেন।”
রাহুল এই নতুন ভারত গড়ার কারিগর হতে চাইছেন। তাই তিনি বলেছেন, “কংগ্রেসের ডিএনএ-তেই আছে ‘হিন্দুস্তান’ (শব্দ ব্যবহার প্রণিধানযোগ্য)।” সনিয়াও বলেছেন, “সকলকে নিয়ে সার্বিক ভারত নির্মাণে বিশ্বাস করি আমরা।” এই নতুন ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক ভারত গড়ার ডাক দিয়ে রাহুল সুকৌশলে নরেন্দ্র মোদীর হিন্দু জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণ রাজনীতিকেও আক্রমণ করেছেন। বিজেপি-কে ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থা থেকে আরও এক বার বিচ্ছিন্ন করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছেন। আসলে কংগ্রেস বিরোধিতাকে দূরে সরিয়ে রেখে বিজেপি বিরোধিতাকে
সামনে তুলে আনাই রাহুলের প্রধান রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। দেড় বছর পরে লোকসভা ভোটের আসরে সেই কৌশল কাজে দেবে কিনা, সেটাই দেখার। |
|
|
|
|
|