জমে থাকা মামলা দিন দিন বাড়তে থাকায় বিচারপ্রার্থী আমজনতার প্রত্যাশা পূরণ করা যাচ্ছে না বলে রবিবার কলকাতা হাইকোর্টের সার্ধ শতবর্ষপূর্তির সমাপ্তি অনুষ্ঠানে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন তিনি। কিন্তু হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির সেই কথা যে আইনজীবীদের অধিকাংশের কানে ঢোকেনি, সোমবার তা পরিষ্কার হয়ে গেল। প্রধান বিচারপতি অরুণ মিশ্র তাঁদের ‘ছুটি’র আর্জি খারিজ করা সত্ত্বেও এ দিন হাইকোর্টের কোনও আইনজীবী কাজে যোগ দিলেন না।
বিচারপতি মিশ্র কলকাতা হাইকোর্টের দায়িত্ব নিয়েই জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি হুটহাট কোর্টের কাজ বন্ধ রাখার
 |
অরুণ মিশ্র |
বিরোধী। এমনকী, তাঁর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটির আয়োজনও আদালতের বিরতির সময়ে করতে বলেছিলেন তিনি। অনুষ্ঠানটি বিরতির গণ্ডি ছাড়িয়ে দ্বিতীয়ার্ধে গড়িয়ে যাওয়ায় তিনি সে দিন অসন্তোষও প্রকাশ করেন। আইনজীবীদের স্বামী বিবেকানন্দের উপদেশ মেনে ‘লক্ষ্যে স্থির থাকা’র আহ্বান জানিয়ে বিচারপতি মিশ্র তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, হাইকোর্টে এক দিনের কাজ নষ্ট হওয়ার অর্থ, বহু মানুষের বহু ভোগান্তি।
তার পরেই ফের এ দিন কাজ বন্ধ রাখলেন আইনজীবীরা। ফলে এক ধাক্কায় অনিশ্চিত হয়ে পড়ল কয়েকশো মামলার ভবিষ্যৎ। প্রধান বিচারপতি অবশ্য যথারীতি এজলাসে বসেছিলেন।
শুনানি হয়ে যাওয়া কিছু মামলার রায় দিয়েছেন। নিজেরাই নিজের মামলা করেন, এমন ক’জনের আবেদন শুনেছেন। অন্য বিচারপতিরাও এজলাসে বসেন। কিন্তু আইনজীবীরা না-থাকায় কাজ বলতে তেমন কিছু হয়নি। ফলে বিচারপতিরা কিছুক্ষণ পরে চেম্বারে ফিরে যান। উল্লেখ্য, গত ৮ জানুয়ারি বিচারপতি প্রতাপ রায়ের বিদায় সংবর্ধনার পরে আইনজীবীরা কাজ না-করলেও প্রায় সব বিচারপতি এজলাসে বসেছিলেন। সে দিনও কয়েকটি মামলার রায় হয়েছিল।
অন্য দিকে রাজ্যে আইনজীবীদের প্রধান সংগঠন বার অ্যাসোসিয়েশনের দাবি: প্রধান বিচারপতির আহ্বানে তারা গুরুত্ব দিচ্ছে। কাজ বন্ধের প্রবণতা এমনিতেই অনেক কমেছে। “আগে কোনও আইনজীবী প্রয়াত হলেই এক দিনের কর্মবিরতি হতো। এখন আর তা হয় না।” দৃষ্টান্ত দেন অ্যাসোসিয়েশনের এক সদস্য। কিন্তু এ দিন কেন কাজ হল না?
ওঁর যুক্তি, “আগেই ঠিক করা ছিল যে, সার্ধ শতবর্ষের সমাপ্তি অনুষ্ঠানের পর দিন হাইকোর্ট ছুটি থাকবে। আমরা তা প্রধান বিচারপতিকে জানিয়েওছিলাম।” হাইকোর্ট-সূত্রের খবর: বার অ্যাসোসিয়েশন, বার লাইব্রেরি এবং ইনকরপোরেট ল সোসাইটি’র তরফে প্রধান বিচারপতিকে জানিয়ে রাখা হয়েছিল, সোমবার তারা কাজে যোগ দেবে না। আইনজীবীরা জানান, হাইকোর্টের শতবর্ষের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পরেও এক দিন কাজ বন্ধ ছিল। |

নিষ্পত্তি কোথায় |
কলকাতা হাইকোর্ট |
মোট বিচারপতির পদ |
৫৮টি |
এখন রয়েছেন |
৪১ জন |
বকেয়া মামলা |
৩ লক্ষ ৭৪ হাজার
(দেওয়ানি ৩ লক্ষ) |
নিম্ন আদালত |
বকেয়া মামলা |
২৮ লক্ষ
(ফৌজদারি ২১ লক্ষ) |
সূত্র: কলকাতা হাইকোর্ট |
|
এমন হরেক অনুষ্ঠানের জন্য আদালতের কাজ কেন ব্যাহত হবে, মামলাকারী সাধারণ মানুষের মনে সে প্রশ্ন অবশ্য থেকেই যাচ্ছে। যার পাল্টা হিসেবে আইনজীবীদের প্রশ্ন, “বিচারে দেরির জন্য শুধু কি আইনজীবীদের কর্মবিরতি-ই দায়ী?” এ প্রসঙ্গে অন্য নানা কারণের দিকে আঙুল তুলছেন তাঁরা। কী রকম?
এর অন্যতম হল, বিচারপতির ও পরিকাঠামোর অভাব। হাইকোর্ট-সূত্রের ব্যাখ্যা: হাইকোর্টে দৈনিক দায়ের হওয়া নিত্য-নতুন মামলা শুনতেই সীমিত সংখ্যক বিচারপতির সময় চলে যাচ্ছে। চূড়ান্ত রায়ের অপেক্ষায় থাকা বহু মামলা ঝুলে থাকছে। মানুষের সচেতনতাবৃদ্ধির ফলে মামলা দাখিলের প্রবণতা বাড়লেও আদালতের সংখ্যা সেই অনুপাতে বাড়েনি। বকেয়া মামলার পাহাড় জমছে। হাইকোর্টে বিচারপতিপিছু মামলার অনুপাত প্রতিকূল। নিম্ন আদালতগুলোয় অসাম্যটা আরও প্রকট।
আর এখানেই বিলম্ব-চক্রের সূত্রপাত। হাইকোর্ট-সূত্রের বক্তব্য: নিম্ন আদালতে বিচার দ্রুত না-হলে হাইকোর্টের উপরে চাপ বাড়ে। কারণ, নিম্ন আদালতে বিচার না-পেয়ে বহু আবেদনকারী সরাসরি হাইকোর্টে চলে আসেন। “ঠিক যেমন জেলা বা মহকুমা হাসপতালে চিকিৎসা না-পেয়ে রোগীরা কলকাতার হাসপাতালে ভিড় জমান, এখানেও ঠিক তা-ই।” মন্তব্য এক আইনজীবীর।
ফলে কলকাতার সরকারি হাসপাতালগুলোর মতো হাইকোর্টেরও নাভিশ্বাস। পাশাপাশি বিচার-পরিকাঠামোও বেহাল। আধুনিক সুযোগ-সুবিধাযুক্ত আদালত ভবনের অভাব তো আছেই, কর্মী থেকে প্রয়োজনীয় আসবাব সবেতেই টান। অন্য অনেক রাজ্যে অনলাইনে দিনের দিনই জেনে নেওয়া যায়, কোন মামলার কী অবস্থা। পশ্চিমবঙ্গে কলকাতা হাইকোর্ট ছাড়া কোথাও সেই ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। উপরন্তু বিচার শুরুর আগে অভিযুক্তদের নিম্ন আদালতের যে লক-আপে রাখা হয়, তা এক কথায় ভয়ঙ্কর। এমনকী, অনেক লক-আপে পানীয় জলের ব্যবস্থাটুকুও নেই বলে অভিযোগ।
বিচারপতি মিশ্র এই সব অব্যবস্থার সুরাহা চেয়ে রাজ্য সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। প্রধান বিচারপতি কী কী পরিবর্তন চান, হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল তা সরকারকে জানিয়েছেন। সরকারের কী বক্তব্য?
আইন ও বিচার দফতর সূত্রে বলা হয়, রাজ্য সরকার পুরো বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত। সমস্যা-মুক্তির উপায় খোঁজা হচ্ছে। |