বাজেট পর্যন্ত অপেক্ষা করা হল না। বিদেশ থেকে সোনা আমদানিতে রাশ টানতে আমদানি শুল্কের হার ৪% থেকে বাড়িয়ে ৬% করে দেওয়া হল। অর্থ মন্ত্রকের এই ঘোষণার পরেই আজ রাজধানীতে সোনার দাম প্রতি দশ গ্রামে এক লাফে ৩১৫ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১,২৫০ টাকায়। দাম এ ভাবে বাড়লে বিয়ের বাজার মার খাবে বলে আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের। কারণ, শুল্ক বৃদ্ধির ফলে প্রতি ১০ গ্রাম গয়নারর দাম বাড়বে ৬০০ টাকার মতো।
এই নিয়ে ২০১২-র জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত তিন বার সোনার আমদানি শুল্ক বৃদ্ধি করা হল। আগে সোনার দাম যাই হোক না কেন, প্রতি ১০ গ্রামে ৩০০ টাকা আমদানি শুল্ক দিতে হত। ২০১২-র ১৭ জানুয়ারি মোট দামের উপর ২% আমদানি শুল্ক ধার্য করা হয়। তার দেড় মাসের মধ্যেই ২০১২-’১৩-র বাজেট পেশ করতে গিয়ে তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় ২% থেকে বাড়িয়ে শুল্কের হার ৪% করে দেন। এ বারও বাজেটের ঠিক আগেই ওই হার আরও বাড়িয়ে ৬% করা হল।
কেন কেন্দ্র এত দ্রুত সোনার আমদানি শুল্কের হার বাড়ানোর পথে গেল?
অর্থ মন্ত্রকের যুক্তি, এতে বাগে আনা যাবে সোনা আমদানি খাতে বিপুল বিদেশি মুদ্রা ব্যয়। যে-কারণে লাগামের বাইরে চলে যাচ্ছিল লেনদেন খাতে বাণিজ্য ঘাটতি। জানুয়ারির শুরুতেই তাই অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম মানুষের কাছে সোনার চাহিদা কমানোর আবেদন জানিয়েছিলেন। না-হলে তাঁকে আমদানি শুল্ক বাড়াতে হবে বলেও তখনই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তিনি। মনে করা হচ্ছিল, বাজেটেই এই ঘোষণা করা হবে। কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে আজ থেকেই তা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিল অর্থ মন্ত্রক। অর্থ সচিব অরবিন্দ মায়ারাম বলেন, “প্ল্যাটিনামের আমদানি শুল্কও একই হারে বাড়ল।”
দেশের বাজারে সোনার জোগান বাড়ানোর একটা রাস্তা অবশ্য খুলে দেওয়া হয়েছে। যে-সব মিউচুয়াল ফান্ডে সোনায় লগ্নি করা হয় (গোল্ড এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড), তার সঙ্গে ব্যাঙ্কে সোনা জমা রাখার প্রকল্প (গোল্ড ডিপোজিট স্কিম) জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে মিউচুয়াল ফান্ড সংস্থাগুলির কাছে যে-সোনা রয়েছে, তা তারা ব্যাঙ্কে জমা রাখতে পারবে। ব্যাঙ্কে যে-সোনা বা গয়না জমা রাখা হয়, তা গলিয়ে সোনার বাট তৈরি করে অলঙ্কার তৈরির জন্য স্বর্ণশিল্পীদের ধার দেওয়া হয়। অর্থাৎ মিউচুয়াল ফান্ডগুলির কাছে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকা সোনা এ বার গয়না তৈরির কাজে লাগবে।
পাশাপাশি, মানুষ যাতে আরও বেশি সোনা ব্যাঙ্কে জমা রাখেন, তার জন্য ‘গোল্ড ডিপোজিট স্কিম’-এ সোনা রাখার ন্যূনতম মেয়াদ ৩ বছর থেকে কমিয়ে ৬ মাস করা হবে। দু’তিন সপ্তাহের মধ্যেই রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও সেবি এ বিষয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করবে। এখন ৩ বছর পর তখনকার বাজার দরে ওই পরিমাণ সোনার মূল্য বা সুদ-সহ সোনার বাট ফেরত পাওয়া যায়।
শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে দাম বাড়বে না কমবে, তা নিয়ে এখনই নিশ্চিত নন অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা। তবে তাঁদের বক্তব্য, যাঁরা সোনার গয়না কিনবেন বলে স্থির করেছেন, তাঁরা কিনবেনই। তা বুঝেও আজ ফের সরকারের তরফে কম সোনা কেনার জন্য আবেদন জানানো হয়েছে। অর্থ মন্ত্রকের বক্তব্য, ২০১১-’১২ অর্থবর্ষে সোনা আমদানি খাতে খরচ হয় ৫৬৫০ কোটি ডলার। চলতি ২০১২-’১৩ অর্থবর্ষে ডিসেম্বর পর্যন্ত খরচ ৩৮০০ ডলার। এর ধাক্কায় অর্থবর্ষের প্রথম ছ’মাসে লেনদেন খাতে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৪.৬%।
আমদানি কমাতে গিয়ে অবশ্য সোনার চোরাপাচার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকছে। অলঙ্কার শিল্পের প্রয়োজনেও বেআইনি পথে সোনা আমদানি হয়। তাতে সরকারেরই রাজস্ব ক্ষতি হয় বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অল ইন্ডিয়া জেম অ্যান্ড জুয়েলারি ফেডারেশনের ডিরেক্টর হর্ষদ আজমেরা। তিনি বলেন, “আমদানি এবং জোগানের মধ্যে ফারকটা ভর্তি করবে চোরাপথে আসা সোনা।” কেন্দ্রীয় রাজস্ব সচিব সুমিত বসু অবশ্য বলেন, “চোরাপাচার রুখতে সব ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তবে শুল্ক বৃদ্ধির খবরে হতাশ গয়না রফতানিকারী এবং ব্যবসায়ীরা। জেম অ্যান্ড জুয়েলারি এক্সপোর্ট প্রমোশন কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান পঙ্কজ পারেখ বলেন, “শুল্ক বাড়ায় গয়না রফতানির খরচ বাড়বে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতীয় গয়না প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে পারে।” বাড়বে গয়নার দামও। স্বর্ণশিল্প বাঁচাও কমিটির কার্যকরী সভাপতি বাবলু দে বলেন, “২% আমদানি শুল্ক বৃদ্ধিতে প্রতি ১০ গ্রাম গয়নার দাম বাড়বে ৬০০ টাকার মতো।” সবে বিয়ের মরসুম শুরু হয়েছে। দাম এক লাফে এতটা বাড়লে ব্যবসা কেমন যাবে, তা নিয়ে চিন্তার রেখা ফুটেছে গয়না ব্যবসায়ীদের কপালে। |