|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ২... |
|
না, নিছক রোম্যান্টিসিজম নয় |
সেমন্তী ঘোষ |
ইন গুড ফেথ, সাবা নাকভি। রেনলাইট/রূপা, ৩৯৫.০০ |
সাবা নাকভি কালীঘাটে গিয়ে খুঁজে বার করেছিলেন পূজারী বিমান ভট্টাচার্যকে। অবশ্য কয়েক বছর পর মন্দিরে গিয়ে আর দেখা মেলেনি তাঁর। কে জানে, কোথায় তিনি, তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল কি না। সরিয়ে দেওয়াটা আশ্চর্য নয়, যেমন কথাবার্তা বলতেন তিনি, যা বিশ্বাস করতেন। বলতেন, একই সঙ্গে তিনি কালীমাতার পূজারী, আবার মানিকপিরের সাধক। তপসিয়ায় মানিকপিরের দরগাও তৈরি করেছিলেন। কেনই বা নয়? “মানিকপিরের সাধনা করি মানে তো এই নয় যে আমি নিখাদ হিন্দু নই। আমি বামুন পুরুত, ছেলেবেলা থেকে ধর্ম আমায় শিখিয়েছে সব ধর্মমতে সমান ভক্তি রাখতে। তা ছাড়া বাংলায় কত হিন্দু কত দরগা আর মাজারে গিয়ে পুজো দেয়, খবর রাখো কেউ?” না, এ খবর বড় একটা রাখি না আমরা। ‘বামুন পুরুত’ হয়ে কত জন এ কথা বলতে পারেন তাও জানি না। সাবা নাকভির বইটি তাই জন্যই এত দরকারি। এ বইয়ের মধ্যে এমন অনেকগুলি মানুষের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, ভারতের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে থাকা অনেক না-জানা না-শোনা বিশ্বাসের সঙ্গে মোলাকাত হয়। এই যেমন সিকান্দার আলম। ওড়িশায় সালেবেগ ঘরানায় বিশ্বাসী গায়ক, চল্লিশেরও বেশি ওড়িয়া সিনেমার জন্য গান গেয়েছেন, দিনে পাঁচ বার নমাজ পড়েও সবচেয়ে বেশি খ্যাতি তাঁর ‘জগন্নাথ ভজন’-এর দৌলতে! সেই সব ভজনের মধ্যে ভক্ত সালেবেগ-এর গানও আছে, যার একটিতে বর্ণিত— ‘বাবা মুসলমান, মা ব্রাহ্মণ, কিন্তু আমি সালেবেগ যে জগন্নাথকে ছাড়া কিছুই জানি না!’ মুঘল বাদশাহ জাহাঙ্গিরের আমলের প্রাদেশিক শাসক সালেবেগ, যিনি মুসলমান হয়েও জগন্নাথের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন, তাঁর অবশ্য জগন্নাথ মন্দিরে প্রবেশাধিকার ছিল না। সপ্তদশ শতক একবিংশে পড়েছে, কিন্তু সালেবেগ-এর মতোই আজও সিকান্দার আলমরা সেই অধিকার পাননি। কিন্তু তাতে কী! আলমের বাড়িতে গেলে দেখা যায়, ধর্মভীরু মুসলিম পরিবারটির বাড়িময় হিন্দু দেবদেবীর ছবি!
উত্তরপ্রদেশের রায়বেরিলির শিয়া মুসলমান বাবা এবং খ্রিস্টান মায়ের মেয়ে, হিন্দু বাঙালির প্রাক্তন স্ত্রী সাবা নাকভি পেশায় সাংবাদিক। মহারাষ্ট্র, কেরল, তামিলনাড়ু, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, কাশ্মীর, কর্নাটক, অসম, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ: অনেক ঘুরে অনেক শ্রমে মানুষগুলিকে খুঁজেছেন তিনি। বাবরি মসজিদ কাণ্ডের পর বিশেষ ভাবে প্রণোদিত হয়েছেন এই কাজে। অবশ্য প্রণোদনার পাশে অবসাদও কম ছিল না। মনে প্রশ্ন উঠেছে— কী অর্থ এর, দেশ জুড়ে যখন অসহিষ্ণুতার কালসাপের ফোঁসফোঁসানি, ধর্মীয় মৌলবাদের হিংসালীলা, তার মধ্যে ‘সিনক্রেটিক কাল্ট’ বা ধর্মসমন্বয়ের ধারা খুঁজে ফেরাটা বিলাসিতা নয়? নিছক রোম্যান্টিসিজম নয়?
বইটির প্রকাশই এ প্রশ্নের উত্তর। হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার কদর্যতা যখন গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে প্রাত্যহিক পাপ হয়ে উঠেছে, মুসলিম মৌলবাদের ঘৃণ্য তাণ্ডব সর্বত্র দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, আইডেন্টিটি-র সংকীর্ণতম ভাষায় আত্মনিবেদন করেছে রাজনীতি, সাবার সাংবাদিক-সুলভ সংস্কৃতি-তদন্ত আমাদের একটা ধাক্কা দেয়, আশার দিকে, সুস্থতার দিকে। প্রশ্নও তোলে অনেক, গভীর সংকটের ইশারাও দেয়। যেমন, মহারাষ্ট্রে আহমদনগরের গ্রামে কানিফনাথ কানোবা নামে যে মাজারটি থেকে সুফি ইসলামের সব চিহ্ন সরিয়ে মন্দির তৈরি হয়েছে কী বলব তাকে আমরা? ধর্মসমন্বয়ের দৃষ্টান্ত? একই প্রয়াস ঠানে-র হাজি মালাং দরগাটি নিয়েও, ১৯৯৩ থেকে একে ‘মুক্ত’ করে হিন্দু-মুসলিম সমন্বয়ের পীঠস্থান তৈরি করার চেষ্টা চলছে। এটাও ‘সমন্বয়’-এর দৃষ্টান্ত হবে হয়তো!
এই অভিজ্ঞতা দেখিয়ে দেয়, ভক্তি-সুফি সমন্বয়ী সংস্কৃতি থেকে গোঁড়া ইসলামি সামাজিক আন্দোলন ও হিন্দু মৌলবাদী আন্দোলনের যুগল পথ বেয়ে কতখানি ভিন্ন পথে এসে পড়েছে ভারতের নানা অঞ্চল। সমাজতাত্ত্বিক পিটার ভান ডেন ভির ভারতীয় ধর্মসমন্বয় ঐতিহ্যের বিশ্লেষণ করে দেখান— সিনক্রেটিজম বা সমন্বয়ীধর্ম, আর মাল্টিকালচারালিজম বা বহুসংস্কৃতিবাদের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম অথচ গুরুতর পার্থক্য আছে, আর সেটা মনে রাখাই উত্তর-আধুনিক রাষ্ট্রের দায়িত্ব। বলেছিলেন, সিনক্রেটিজম-এর মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই একটা ক্ষমতার গল্প কাজ করে, কোনও একটি বিশ্বাসের নিহিত প্রতাপে অন্য বিশ্বাসগুলিকে আত্মস্থ করার প্রবণতা সেই গল্পে লুকিয়ে থাকে। ফলে আদর্শ হিসেবে কিন্তু সিনক্রেটিজম প্রগতি কিংবা পশ্চাৎপরতা দুই-ই বোঝাতে পারে, প্রেক্ষিতের উপর নির্ভর করে কোন্টি কোন্ ক্ষেত্রে সত্য। এই ব্যাখ্যা মনে রাখলে সাবার এই বইয়ের দুই মলাটের মধ্যে আমরা খুঁজে পাই পাশাপাশি আশা আর হতাশার আলো-আঁধারি।
বহুসংস্কৃতিবাদের মতো রাষ্ট্রীয় আদর্শ ভারতে বিশেষ সাফল্য পায়নি বলেই হয়তো বার বার খোঁজ পড়েছে সমাজের ভেতরের এই সব ‘সিনক্রেটিক’ বা ধর্মসমন্বয়ের ধারার। এখানেই হয়তো আশার নিভৃত আলোকরেখা। কিন্তু রাজনীতি ও সমাজের ক্ষমতার খেলা যে অলক্ষ্যে সেই ধারাকেও আত্মস্থ করে নিতে থাকে! সেই বিপদ সম্পর্কেও সতর্ক হওয়া দরকার। সাবা নাকভি-র বইতেও আশা আর সতর্কতার যুগল নিশানা। |
|
|
|
|
|