১৬ বাই ১০ ফুটের একটা কুঠুরি। সামনে লোহার গরাদ। ভিতরে লুঙ্গি, চেকশার্ট পরে হাঁটু মুড়ে বসে রয়েছেন তিনি। কেউ দেখা করতে এলেই ক্ষিপ্ত হয়ে চিৎকার করছেন। শাপশাপান্ত করছেন দলের নেতাদের। একা হয়ে গেলে মোটা চাদরে মাথা পর্যন্ত ঢেকে চুপ করে বসে থাকছেন।
পাঁচ দিনের পুলিশ হেফাজত হওয়ার পরে তৃণমূল নেতা আরাবুল ইসলাম সোনারপুর থানার লকআপে এ ভাবেই বৃহস্পতিবার রাত ও শুক্রবার সারা দিন কাটালেন। তার পরে রাতে বুকে ব্যথার কথা বলায় তাঁকে প্রথমে এম আর বাঙুর, পরে সেখান থেকে এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
বৃহস্পতিবার রাতে লকআপে আনার পরে স্ত্রী জাহানারা বিবি ও ছেলে হাকিবুল তাঁকে দু’টি সাদা চেক লুঙ্গি ও দু’টি জামা দিয়ে গিয়েছিলেন। রাতে নীল জিন্স ও আকাশি চেক-শার্ট খুলে লুঙ্গি ও জামা পরে মাথা মুড়ি দিয়ে লকআপের ভিতরে বসে পড়েন তিনি। লকআপে তাঁর সঙ্গে রয়েছেন ছিনতাইয়ের অভিযোগে ধৃত একজন। তৃণমূলের ‘উদ্যমী নেতা’ ও ভাঙড় কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতিকে পেয়ে ওই আসামী তাঁর সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টাও করেন। কিন্তু তাঁকে পাত্তা দেননি আরাবুল। রাতেই সোনারপুর (পশ্চিম)-এর বিধায়ক জীবন মুখোপাধ্যায় থানায় এসে দেখা করেন তাঁর সঙ্গে। আসেন ক্যানিং-১ নম্বর ব্লক তৃণমূলের সভাপতি শৈবাল লাহিড়িও। গরাদ চেপে ধরে আরাবুল তাঁদের চিৎকার করে বলেন, “সব কিছু-ই দলকে জানিয়ে করেছি। আর আমাকেই এখন পুলিশ হেফাজতে রাখা হল!” এর পরে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি বলেন, “দলই আমাকে শেষ করে দিল।” দু’জনেই তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকেন।
রাতে আরাবুলকে দেওয়া হয় ভাত, মুসুর ডাল, আলু-বিনের তরকারি ও কাতলা মাছের ঝোল। তৃণমূলের এক প্রাক্তন মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠরাই তাঁকে ওই খাবার দেন। লকআপে বসেই খেয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে কম্বল পেতে মেঝেতে শুয়ে পড়েন। লক আপের এক ধারে বালতিতে জল রাখা। সেখানে স্নান-নিত্যকর্মের ব্যবস্থা রয়েছে।
শুক্রবার সকালে লিকার চা ও টোস্ট দেওয়া হয় তাঁকে। সঙ্গে উচ্চ-রক্তচাপ ও ডায়বেটিসের ওষুধ। দিনে দু’বার তাঁকে ওই ওষুধ দেওয়ার নির্দেশ রয়েছে চিকিৎসকদের। বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ আসেন দক্ষিণ ২৪ পরগনা তৃণমূলের ভাইস চেয়ারম্যান শক্তি মণ্ডল। লকআপের গরাদ ধরে উত্তেজিত আরাবুল তাঁকে বলেন, “আমি সবই দলকে জানিয়ে করেছি। তবে আমার এই অবস্থা হবে কেন? আমাকে কেন ফাঁসালেন আপনারা?” শক্তি মণ্ডল আরাবুলের হাত চেপে ধরে বলেন, “দল তোমার সঙ্গে রয়েছে। তুমি শান্ত হও।” কিন্তু শান্ত করা যায়নি আরাবুলকে।
দুপুর দেড়টা নাগাদ আরাবুলের স্ত্রী, শাশুড়ি ও ছেলে আসেন থানায়। জামাইকে লকআপের ভিতরে দেখে কেঁদে ফেলেন শাশুড়ি। আরাবুল তাঁদের বলেন, “দল আমার সঙ্গে চক্রান্ত করেছে। কিছু চিন্তা করবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে।’’
দুপুরে আরাবুলকে দেওয়া হয় ডাল-ভাত-আলুসব্জি ও কাতলা মাছের ঝোল। খাওয়ার পর ফের শুয়ে পড়েন তিনি। সন্ধ্যার পর ভাঙড়ের তৃণমূল নেতা কাইজার আহমেদ আসেন দেখা করতে। লকআপের ভিতর থেকে ফের গর্জে ওঠেন আরাবুল। দলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে বলেন, “আমার দল রাজ্য শাসন করছে। দিদি মুখ্যমন্ত্রী। আর আমাকে-ই কি না লকআপে থাকতে হবে! আমি তো সব কিছুই দলকে জানিয়ে করেছি।” মাথা নেড়ে সায় দেন কাইজার। রাতে সোনারপুর ও ভাঙড় এলাকার কয়েক জন নেতা তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। সবাইকেই একই কথা বলতে থাকেন আরাবুল। তবে পুলিশ কর্তারা এ দিন জেরা করেননি তাঁকে। |