লালগোলা এম এন অ্যাকাডেমি, কিংবা এমএন পাবলিক লাইব্রেরির ভিত্তি ফলকে ‘যোগেন্দ্রনারায়ণ’ নামটি লিখিত থাকলেও তা শুদ্ধ নয়। গবেষক শক্তিনাথ ঝা যথার্থ অর্থেই লিখেছেন, প্রশান্ত পালের ‘রবীজীবনী’ ও সুধাকর চট্টোপাধ্যায়ের ‘লালগোলা রাজের জীবনী’গ্রন্থে ব্যবহৃত হয়েছে যোগীন্দ্রনারায়ণ রায় নামটিই। ৭০ বছর আগে, ১৩৪৯ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত ঐতিহাসিক শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যয়ের লেখা ‘মুর্শিদাবাদ কথা’ গ্রন্থে লালগোলা রাজবংশের ইতিবৃত্তে মহারাজা বাহাদুরের দান, মনুষত্ব ও দেশের প্রতি আনুগত্যের কথা লিখেছেন। প্রদত্ত তথ্যে তিনিও যোগীন্দ্রনারায়ণ নামটিই ব্যবহার করছেন। এমনকি এখন থেকে ১১৫ বছর আগে ১৩০৪ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত ঐতিহাসিক নিখিলনাথ রায়ের ‘মুর্শিদাবাদ কাহিনী’ গ্রন্থেও যোগীন্দ্রনারায়ণ রায় নামটিই ব্যবহৃত হয়েছে। উল্লেখ্য, ওই দু’টি গ্রন্থ-ই যোগীন্দ্রনারায়ণের জীবদ্দশাতেই প্রকাশিত। ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’-সহ যোগীন্দ্রনারায়ণের অনেক কীর্তি আজও বর্তমান। শিক্ষা,স্বাস্থ্য, ধর্ম ও বিবিধ বিষয়ে যোগীন্দ্রনারায়ণের অবদান সর্বজনবিদিত। এ জন্য ব্রিটিশ সরকার তাঁকে বিভিন্ন সময়ে ‘কাইসার-ই-হিন্দ’, ‘সুবর্ণ পদক’, ‘সিআইই’ ‘রাজা’, ‘রাজা বাহাদুর’, ‘মহারাজা’ প্রভৃতি উপাধি প্রদান করেন। ১৩১০ বঙ্গাব্দে লালগোলার রাজাকে ‘খিলাৎ’ দেবার সময় বহরমপুর শহরে দরবার হয়। ওই দরবারে বাংলার ছোট লাট বোর্ডলিন তাঁর ভাষণে মহারাজাকে যোগীন্দ্রনারায়ণ রায় নামেই সম্বোধন করেন। রিচার্ড টেম্পল প্রদত্ত মানপত্রেও যোগীন্দ্রনারায়ণ নামটিই লিখিত হয়। কাজেই ‘যোগেন্দ্রনারায়ণ’ নামটিই বিকৃত। শুদ্ধ নামটি ‘যোগীন্দ্রনারায়ণ’। লোককথা নির্ভর করে নীহারুল লিখেছেন, “অপুত্রক মহেশনারায়ণ দত্তক পুত্র যোগীন্দ্রের পড়াশোনার সময় অনেক বইপত্র কিনেছিলেন। কিন্তু রাও রামশঙ্কর রায়ের পুত্র মহেশনারায়ণের জীবনাবসান হয় যৌবনের প্রারম্ভেই। মহেশনারায়ণের মৃত্যুর পর তাঁর বিধবা পত্নী রানী শ্যামাসুন্দরী পোষ্যপুত্র হিসাবে যোগীন্দ্রনারায়ণকে গ্রহণ করেন। পরে যোগীন্দ্রকে পরিহার করে দ্বিতীয় দত্তক নেন শ্যামাসুন্দরী।” ঐতিহাসিক শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘মুর্শিদাবাদ কথা’ গ্রন্থের ২০৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “যোগীন্দ্রনারায়ণ বুদ্ধিমান, অধ্যবসায়ী ও পরিণামদর্শী মহাত্মা। শৈশবে ও কৈশোরে তাঁহার বিদ্যাশিক্ষার সুবিধা না হওয়ায় উত্তর জীবনে স্বীয় বুদ্ধি ও অধ্যবসায় গুণে তিনি বিবিধ বিদ্যায় পারদর্শী হইয়াছেন।” |
রমাপ্রসাদ ভাস্কর তাঁর চিঠিতে মহারাজা যোগীন্দ্রনারায়ণ রায়ের শুভবিবাহের নিমন্ত্রণপত্রটি তুলে ধরেছেন। এরপর মহারাজার নাম নিয়ে আর তর্ক চলে না। তবে সঠিক নামটি জানার জন্য অতদূর যাওয়ার দরকার পড়ে না। নলিনীকান্ত সরকারের ‘দাদাঠাকুর’ বইটি প্রায় সব গ্রন্থাগারেই পাওয়া যায়। লালগোলার মহারাজার সঙ্গে দাদাঠাকুর শরৎচন্দ্র পণ্ডিতের সুমধুর সম্পর্কের কথা সুবিদিত। দাদাঠাকুরের স্নেহধন্য, অজস্র হাসির গানের স্রষ্টা, ‘বিজলী’ পত্রিকার সম্পাদক নলিনীকান্ত সরকারের ‘দাদাঠাকুর’ বইটিতে অনেকবারই মহারাজার প্রসঙ্গ এসেছে। প্রতিবারই তিনি ‘যোগীন্দ্রনারায়ণ’ লিখেছেন। মুর্শিদাবাদের ভূমিপুত্র, সচেতন ও তথ্যনিষ্ঠ লেখক নলিনীকান্ত মহারাজার ভুল নাম লিখতে পারেন না। অতএব যাবতীয় তথ্য প্রমান অনুসারে মহারাজার আসল নাম যোগীন্দ্রনারায়ণ। কোনও মতেই তিনি ‘যোগেন্দ্রনারায়ণ’ নন। |