হাঁড়ির খবর...
জিভে-গরম শীতকাল
খুব গরম আর মিষ্টি কিছু খেয়ে ফেলেছে যে মেয়েটি, তার মুখের দিকে এক বার তাকিয়ে দেখুন!
বিস্ময় আর আনন্দের মিশেলে এমন স্বর্গীয় ছবি, এই সবজান্তা-সভ্যভব্যদের দেশে কদাচ চোখে পড়ে। মালয়ালম ভাষার লেখক ভৈকম মহম্মদ বশিরের বর্ণনা পড়েই প্রথম এমন দৃশ্যে আমার চোখ খুলেছিল।
বশিরের ‘প্রেমপত্র’ গল্পটি যাঁরা পড়েননি (দিব্য বাংলা অনুবাদ মেলে, খোঁজ করুন), সে-সব প্রেমিক-প্রেমিকার থুথু ফেলে ডুবে মরাই শ্রেয়। তার পরে মোক্যাম্বো-র ব্র্যান্ডিসিক্ত জ্বলন্ত বেক্ড আলাস্কা থেকে নকুড়ের ছানা-গুড় বাগিয়ে বহু বার বশিরের কথা মনে পড়েছে। এই ছানা-গুড় অবশ্য বিক্রিযোগ্য নয়।
এই শীতকালে নকুড়বংশের ভাইরা তাঁদের সুহৃদবর্গকে এ জিনিসটি দিয়েই দোকানে আপ্যায়ন করেন। নিখাদ ঘটি নকুড়িয় ভাষায় অবশ্য ‘ছানা-গুড়’ নয়, ‘ছ্যানা-গুড়’ বলতে হবে। নকুড়ের বিশেষ কায়দায় গরমাগরম ছ্যানার জল ঝরিয়েই তার এক খাবলা নিয়ে ন’দের হাঁসখালির নতুন গুড় মাখিয়ে বাটি ভরে দিলেই ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়।
নকুড়ের কথা বললেই, বলরামের কথা না-বললেই নয়! একদা বলরামের কাঁচাগোল্লা গরম করে ‘লিকুইড সন্দেশ’ নামে বিয়ে-বাড়ির পাতে তাকে বিখ্যাত করে তুলেছিল ভোজ কেটারার। উত্তর কলকাতার বিদ্যাসাগর স্ট্রিটের বুবাই কেটারারও নকুড়ের কাঁচাগোল্লাকে ‘হট সন্দেশ’ নামে পেশ করে থাকে।
ঠান্ডার দাক্ষিণ্যে কলকাতার লন্ডনায়নের দিনে হঠাৎ এমন হট-আবেগ উথলে উঠছে। তা লন্ডনই যখন হয়েছি, তখন শুধু ছ্যানা-গুড় নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে কেন? সে-দিন মামা মিয়া-য় ফ্রেশ স্ট্রবেরি ক্রাম্বল সিজলার খেতে খেতেও বুকের মধ্যে সেই চেনা উচ্ছ্বাস সিংহগর্জন করে উঠল। স্ট্রবেরি ক্রাশের চিরকেলে বাঙালি ধাপ্পাবাজি নয়। টাটকা-তাজা স্ট্রবেরি। দারচিনি ও স্ট্রবেরির হাল্কা শুকনো ক্রাম্বল গরম সিজলার-প্লেটে মিষ্টি-মিষ্টি সস, স্ট্রবেরির খানকয়েক চাকলা ও ফ্রেশ ক্রিম ছড়িয়ে পরিবেশন করা হল। আবেগে কাঁপতে কাঁপতে স্ট্রবেরি-স্পন্দিত বুকে তখন মনে হচ্ছে, উইম্বলডনে আছি! এই তো সাক্ষাৎ, ল-ন-ড-ন। একবার অবশ্য মনে পড়ল, উইম্বলডনে ফ্রেশ ক্রিম উইথ স্ট্রবেরিটা ইংলিশ সামার-এর বিলাস। তবে ওই সব ভাবনাকে প্রশ্রয় দিয়ে শীতের বিলেত-বিলাসের আমেজটা খাটো করার মানে হয় না।
বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড বা নিউ আলিপুরে ইতালি-ঘরানার জেলাতো আইসক্রিমের ঠেক মামা মিয়া, এই শীতে জীবনে উষ্ণতার স্পর্শ এনেছে। স্ট্রবেরি না-পোষালে চকোলেট চেখে দেখুন। মামা মিয়া-য় ঘরোয়া চকোলেট কেকের নাম গ্র্যান্ডমাদার্স চকোলেট টর্ট। তাতে অরেঞ্জ সস ঢেলে ফ্রেশ ক্রিমযোগে দিলেও অবধারিত উত্তেজনায় চোখ বুজে আসবে। মামা মিয়া-র একটা ব্যাপার, এ সব মিষ্টি মিষ্টি হয়েও নির্ভার। চকোলেট ছাড়া, বাকিগুলো চড়া মিষ্টিও নয়।
মামা মিয়ায় ব্রাউনি, চকোলেট কেক, আপেল-স্ট্রবেরির ক্রাম্বল গরম করে চাখার সঙ্গতে নানা কিসিমের তরল লাভাস্রোত। নলেন গুড়ের মতো থকথকে টফি ক্যারামেল সস, মুচমুচে প্র্যালিন সস-টস অনেক কিছু আছে। বলতে ভুলে গিয়েছি, এমন উষ্ণতার সঙ্গে পছন্দসই আইসক্রিমের খাবলাও সিজলার-পাত্রে বিরাজ করে। সত্যিই সিজলিং-অভিজ্ঞতা।
অথচ, ভেবে দেখুন, এ সব কোনও হাতি-ঘোড়া ব্যাপার নয়! এই মাইক্রো আভেন ও ইন্টারনেট-ইউ টিউবের যুগে বাঙালি ঠাম্মাও হেসে-খেলে বাড়িতে আকছার কেক বানাচ্ছেন। বেকবাগানের মিঠাইয়ে সন্ধেয় গরম নলেনগুড়ের রসগোল্লা খেয়ে বেড়ানোর মতো ডিনারে ওই কেক গরম করে ক্রিম-ট্রিম দিয়ে সাঁটানোও এখন জল-ভাত।
শীতে আইসক্রিমের থেকে এই ঠান্ডা-গরম অভিজ্ঞতাই কলকাতার কাছে বেশি রুচিকর হবে বলে মনে করা হচ্ছে। খাদ্যবিশারদদের কাছে এর একটা গালভরা ফরাসি নামও আছে। গরমি-ঠান্ডা মেশে বলে বলা হয়, শ-ফ্রোয়া (chaud-froid)। আমাদের বলরাম মল্লিকও কিন্তু বিয়েবাড়ির মিষ্টিতে এই যুগলবন্দির কথা মনে রাখছে। যেমন নলেনগুড়ের কাঁচাগোল্লা নলেনগুড়ের আইসক্রিমের সঙ্গে জোট বেঁধে পাতে আসছে। গুপ্ত ব্রাদার্সে আগে এক বার গরম জিলিপি, বেনারসি রাবড়ি ও টক-টক কিউই ফল খাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে। আর সুশীতল আইসক্রিমের সঙ্গে জিভ-পোড়ানো চকোলেট সস বা হট গুলাবজামুনও তো কবেই বাঙালি বিয়ের শেষপাতে পরম আদরে স্বীকৃতি অর্জন করে নিয়েছে। ঠান্ডা-গরমের ললিত-কঠোরের মধুর বৈপরীত্য সত্যিই মহিমময়।
পো’ষ মাসের শেষে বলরামের লাইভ পিঠে কাউন্টারের কথাও বলতে হয়। নলেনগুড় যোগে গরম পাটিসাপ্টা বা ছানার মালপো ‘সেলিং লাইক হট কচুরি’জ’! বিয়েবাড়িতে বলরাম সাদা মাখনে ভেজে রসগোল্লা রাম ঢেলে আগুন জ্বালিয়েও পরিবেশন করে। এই সব গরম বা ঠান্ডা-গরম মিষ্টির সুবাদে বলরাম বিয়ে বা অনুষ্ঠান-বাড়ির ডেজার্টের একটি আলাদা লিস্টিও ছাপিয়েছে। সে-সব খেতে ভাল তো বটেই, দেখেও চোখ ফেরানো যায় না। গরম বেক্ড সন্দেশ বা রসগোল্লাও এখন অনেক কেটারারেরই বিয়েবাড়ির তুরুপের তাস।
কলকাতার শীতের সন্ধে! কড়া থেকে সদ্য নামানো রসগোল্লা বা তাওয়া-গরম চকোলেট-স্ট্রবেরি কেকের সম্ভার। ঠোঁট-জোড়া ফাঁক হওয়ার পরেই বাক্রুদ্ধ কারও চোখে-মুখে সেই দিব্য বিভা। যা কাছ থেকে চেয়ে দেখলেও মনে হয়, জীবন নেহাতই মন্দ না!




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.