|
|
|
|
|
|
ব্যাগ গুছিয়ে...
|
ঢেউগুলি কোথা ধায়
বেলা শেষের আলোয় ঝিকমিক করতে থাকা ধূসর-নীল সমুদ্রের
ক্যানভাসে থাকা জেলে-নৌকোর সিল্যুয়েট। লিখছেন অঞ্জন সরকার |
|
২২ ডিসেম্বর ২০১২ সন্ধে সাতটার জগন্নাথ এক্সপ্রেস যখন আমাদের নিয়ে হাওড়া স্টেশন ছাড়ল তখন কলকাতায় বড়দিনের ব্যস্ততা। জায়গা খুঁজে নিয়ে থিতু হওয়ার সময়েই বুঝতে পারলাম বাঙালি আর কিছু না করুক, বেড়াতে ভালবাসে। গোটা ট্রেনে তিলধারণের জায়গা নেই। রাত ন’টাতেই ঝোলা থেকে বেরিয়ে এলো লুচি, ছানার তরকারি আর নলেন গুড়ের সন্দেশ।
ভোর পাঁচটায় বেজায় হুড়োহুড়ি, পুরী এসে গেল যে। বাক্স-প্যাঁটরা (মাফ করবেন, স্ট্রলি ব্যাগ আর ন্যাপ-স্যাক) সমেত নিজেদের প্লাটফর্মের বাইরে নিয়ে আসতেই মোবাইল বেজে উঠল। হোটেলের গাড়ির চালক জানিয়ে দিলেন কোথায় দাঁড়িয়ে আছেন। এর পরে গাড়িতে বসে আর সুয্যিমামার হাইতোলা দেখতে দেখতে যখন হোটেলের দরজায় পৌঁছলাম তখন সাগরের জলে প্রথম সূর্য তার আগের দিনের কমলা-হলুদ রঙ লাগা তুলি ধুয়ে নিচ্ছে। একটা মিষ্টি হিমেল হাওয়া। চা এসে গেল। তার মধ্যেই ঘর তৈরি। জিনিসপত্তর ঘরে রেখে একটু রিফ্রেশড হয়ে বারান্দায় বসা।
প্রথম দিন সকাল সকাল হোটেলেই স্নান সেরে রওনা হয়ে গেলাম জগন্নাথ মন্দিরে, রিকশায়। মন্দিরের সিংহ-দরজার সামনে যখন নামলাম তখন দেখি মানুষের স্রোত চলেছে মন্দিরের দিকে। গা ভাসালাম স্রোতে। এ মন্দিরের স্থাপত্য যেমন অসাধারণ, তেমনই এর প্রতিটি পাথরের খাঁজে যেন লুকিয়ে আছে না-শোনা, না-জানা কোনও লোকগাথা। দেবদর্শন শেষে পুজো দিয়ে আমরা ফিরে আসি হোটেলের সামনে বালুকাবেলায়। এবেলা শুধুই সমুদ্রের জলে দুষ্টুমির অবগাহন। মাঝে মাঝে জিরিয়ে নিতে ছাতার নীচে চেয়ারে বসা। ডাকসাইটে মিষ্টি ‘মদনমোহন’-এর আস্বাদ নেওয়া আর ডাবের জল।
ঘণ্টাদু’য়েকের স্নানপর্ব সেরে আবার হোটেলে ফেরা। মিষ্টি জলে আর এক প্রস্থ নিজেদের ধুয়ে নিয়ে মধ্যাহ্নভোজনের প্রস্তুতি। খাওয়াশেষে গল্প করতে করতেই দু’চোখের পাতা জুড়ে আসে। এক চোট দিবানিদ্রা। |
|
ঘুম যখন ভাঙল তখন বেলাশেষের আলোয় ঝিকমিক করতে থাকা ধূসর-নীল সমুদ্রের ক্যানভাসে থাকা জেলে-নৌকোর সিল্যুয়েট। দু-একটা রাস্তার আলো জ্বলেছে। বালুকাবেলায় বাজার জমে উঠেছে। ঝিনুক, শঙ্খের হরেক জিনিস, স্যান্ডস্টোন আর সফ্ট স্টোনের হাজারো সম্ভার, মুক্তোর মালা, ঝালমুড়ি, বুড়ির চুল আর কফির ভ্রাম্যমাণ বিপণি। পা রাখি রাস্তায়। আর এক দফা মন্দির যেতে হবে যে। প্রতি সন্ধ্যায় মূল মন্দিরের মাথায় যে ধ্বজা থাকে তা পাল্টানো হয়।
পরদিন সকাল সাতটায় দরজায় বাহন হাজির। গন্তব্য চিল্কা। গাড়ি ছুটল বালি উড়িয়ে। পথের মাঝে ঘণ্টাদু’য়েকের মাথায় এক জায়গায় থামল সে। গরম পুরি-সবজি, ইডলি, উপমা আর ছানার জিলিপি দিয়ে দুরন্ত জলখাবারের পরে আবার ছুটল রথ। তারে-বসা মাছরাঙা, পুকুরের জলে গা-ডোবানো নিকষ কালো মোষের দল, পথের দু’ধারে ডাবের কাঁদি নিয়ে বসে থাকা দোকানি, অজস্র কেয়াগাছের দল, সূর্যের আলোয় গা-মেলে দেওয়া লাল শালুকেরা সরে সরে যেতে থাকল আমাদের সামনে এগিয়ে দিয়ে। অবশেষে থামল গাড়ি লাল ধুলো উড়িয়ে। ছুট্টে গিয়ে টিকিট কাটা, জেটিতে পৌঁছে ভুটভুুটি ঠিক করা আর তার পরে ভেসে পড়া। দু’পাশে জল ঠেলে অনেক চরা জমি পেরিয়ে সে থামলো লাল কাঁকড়া দেখাতে। তবে এর চেয়ে অনেক বেশি লাল কাঁকড়া তাজপুরেই দেখেছি।
এর পরে ডলফিন দেখতে জল কেটে এগোই। গেঁথে রাখা জালকাঠির মাথায় শঙ্খচিল। কতকগুলো ‘ইগ্রেট’ সন্তর্পণে পা ফেলছে। একটা হালকা মোচড়ে আমাদের ভুটভুটিটা ঘুরল। আরে! আরে! ওই তো ডলফিন। ওই দ্যাখ, ওই দ্যাখ পিঠটা দেখা গেল। ওই তো, ওই তো এ বার পুরোটা উঠল। মন পুরোটা ভরল না। ডলফিন দেখেছি বটে, কিন্তু ছবি তেমন তুলতে পারলাম কই। ফিরছি এ বার। ‘সি মাউথ’ বা সাগর সঙ্গম দেখে একটা দ্বীপে কিছুটা সময় কাটলো। চাইলে সেখানে টাটকা পারশে, চিংড়ি, কাঁকড়ার স্বাদ নেওয়ার ব্যবস্থা আছে। একটা ছোট্ট চরায় শ’দুয়েক ‘ব্ল্যাক উইংগড্ স্টিল্ট’, কয়েকটা ‘কমন টিল’।
এটাই নাকি ‘বার্ড সাংচুয়ারি’! পাখিগুলো নৌকোর আওয়াজে দল বেঁধে আকাশের নীলে সাদা ডানা মেলল। সূর্য ডোবার আগেই হোটেলের বারান্দায় গরম চায়ের কাপ আর চিকেন পকৌড়া। এক নিমেষে সব ক্লান্তি উধাও। আজকের সন্ধেটা কাটুক স্বর্গদ্বারের কাছে বাজারে। কটকি শাড়ি, সম্বলপুরি তাঁতের কাপড়, খুরদা রোডের গামছা, পিপলির অ্যাপ্লিকের কাজের সম্ভার, রুপোর ফিলিগ্রির নানা আভরণ। সবার উপরে পুরীর খাজা। ‘হোমফ্রন্ট’ সন্তুষ্ট আর আপনিও দিলদরিয়ার মহারাজা। তৃতীয় দিন আর একটু সকাল সকাল। গাড়ি হাজির। গন্তব্য? ধবলগিরি, নন্দনকানন, উদয়গিরি-খণ্ডগিরি, লিঙ্গরাজ মন্দির, সাক্ষীগোপাল, কোনারকের সূর্যমন্দির হয়ে চন্দ্রভাগা সমুদ্রতট। প্রায় বারো ঘণ্টার মতো লাগে। পথের শুরুতেই নন্দনকানন পৌঁছে সাফারি। অলস সিংহমশাই প্রথম রোদের তাপ নিচ্ছে। |
|
গাড়ি দেখে দু-একটা পোজ দেওয়ার পরে আবারও মাথা নীচু করে রোদ পোয়ানো। সাফারি শেষে নন্দনকাননের বাকি সদস্যদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ সেরে নিতে নিতে মনে হল এরা যদি পারে তা হলে আমরা কেন আমাদের চিড়িয়াখানা সুন্দর করে রাখতে পারি না! এদের ‘অ্যাকোয়ারিয়াম’ সত্যি মনে রাখার মতো, এ বার ধবলগিরি। শান্তিস্তূপ। বৌদ্ধমন্দির। নীল আকাশের বুকে সাদা মন্দিরটা সত্যিই চোখ জুড়োয়। এখানে ‘স্লিপিং বুদ্ধ’র মূর্তি আছে। মন্দির চত্বর থেকে বাইরের দৃশ্যও সুন্দর। সেখান থেকে লিঙ্গরাজ মন্দির হয়ে যখন কোনারক পৌঁছলাম তখন প্রায় বিকাল। আগেও এসেছি। কিন্তু এ মন্দিরের গঠনশৈলী প্রতি বারই এখানে টেনে আনে। যদিও মন্দিরের বিভিন্ন অংশের সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু খুব দুঃখ পেলাম দেখে যে মন্দিরের গায়ের অধিকাংশ মূর্তিই প্রায় নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে। দুখী মনটাকে অনেকটা ভাল করে দিল চন্দ্রভাগা। যখন সেখানে পৌঁছেছি তখন অস্তসূর্যের নরম আলোয় আদর মাখছে সে। নরম সোনা রোদে যেন অরণ্যদেবের ‘কিলাউইয়ের সোনাবেলা’।
শেষের সে দিন। হোটেলের বাইরে যখন পা রাখলাম, তখনও রাস্তার সব কটা আলো নেভেনি। আকাশে চাঁদটা আর ততটা উজ্জ্বল নয়। সমুদ্র ঝাপটা দিচ্ছে বালুকাবেলায়, নরম করে। পুব আকাশ আর কালচে নয়। একটা শঙ্খচিল তার বুক ভেজাচ্ছে সাগরের জলে। আমি ভেজা বালির ওপর দিয়ে হাঁটছি খালি পায়ে। নরম বালিতে আমার পায়ের ছাপ। হাওয়া একটু কাঁপন ধরাচ্ছে শরীরে, মনে। নিউ মেরিন ড্রাইভের পাশ দিয়ে সোজা চলেছি সমুদ্রের ঢেউয়ের ভাঙা-গড়া দেখতে দেখতে। কখনও বা বালির ওপর ফিরতে চাওয়া ঢেউ আর ফেনার ফিলিগ্রির কাজ। কাঁকড়ার বালি তোলার নকশা। কত অচেনা-চেনা বক। এদের সঙ্গী করে পৌঁছলুম মোহনায়। এখানে শান্ত জলের ছলাৎ ছল। নীল আকাশ আর বালির মেশামেশি, অদূরে দামাল সমুদ্রের দস্যিপনা। ডাকি তাকে, বলি, আবার আসব ফিরে।
|
কী ভাবে যাবেন |
ট্রেনে সরাসরি পুরী। এ ছাড়া বিমানে ভুবনেশ্বর গিয়ে সড়ক পথেও যাওয়া যায়। |
কখন যাবেন |
বছরের যে কোনও সময়ে। তবে ভাল ভাবে উপভোগ করতে চাইলে
উৎসবের দিনগুলো এড়িয়ে চললে ভাল হয়। তখন খুব ভিড় হয়। |
কোথায় থাকবেন |
সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থা অনেক। পুজোর ছুটি, গরমের ছুটি, বড়দিনের ছুটি,
রথযাত্রায় যেতে চাইলে অন্তত তিন থেকে চার মাস আগে বুকিং করতে হয়। |
|
|
|
|
|
|
|