|
|
|
|
অনেক মিথ্যে বলে ক্লান্ত, আর পারছি না: আর্মস্ট্রং
নিজস্ব প্রতিবেদন |
জীবনটা বড় বেশিই রূপকথার মতো ছিল। অনেক দিন বেঁচেছিল সেই রূপকথা। প্রায় অলৌকিক, একেবারে নিখুঁত। “ইট ওয়াজ মিথিক, পারফেক্ট স্টোরি...
...অ্যান্ড ইট ওয়াজ নট ট্রু।” রূপকথারা সত্যি হয় না, সারা পৃথিবীর সামনে মেনে নিলেন লান্স আর্মস্ট্রং। ওপরা উইনফ্রে-র টক শো-এ রূপকথাকে এই ভাবে মরতে দেখে সারা পৃথিবী রেগে উঠল, যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেল। প্রতারিত হওয়ার বেদনায় ছটফট করল। আর্মস্ট্রংও বললেন, “এই সময়কার গল্পটা বড্ডই কদাকার, বিষময়।”
অসত্য রূপকথা, সত্য অপ্রিয়।
গত বছর জুন মাসে যখন ইউনাইটেড স্টেটস অ্যান্টি ডোপিং এজেন্সি (ইউএসএডিএ) ঘোষণা করল, আর্মস্ট্রং ডোপিংয়ে ধরা পড়েছেন, তখন কিছু বলেননি তিনি। তাঁর সাত-সাতটা ত্যুর দ্য ফ্রাঁসে খেতাব কেড়ে নেওয়া হল, অলিম্পিক পদক ফিরিয়ে নেওয়া হল, সারা জীবনের জন্য সাইক্লিং থেকে নির্বাসনে পাঠানো হল আর্মস্ট্রং কিছু বললেন না। ইউএসএডিএ-র সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আপিলও করলেন না। স্বর্গ থেকে পতন সেদিনই হয়ে গিয়েছিল আর্মস্ট্রংয়ের। আত্মপক্ষ সমর্থনে কিছু বলার থাকলে নির্ঘাত আপিল করতেন, করছেন না মানে বলার কিছু নেই এমনটাই বুঝে নিয়েছিল ক্রীড়াবিশ্ব। কিন্তু আর্মস্ট্রং নিজে দোষ স্বীকার করার ধার দিয়ে যাননি। বরং স্বভাবসিদ্ধ অহং নিয়ে গোটা ঘটনাটাকেই বলির পাঁঠা খোঁজার চক্রান্ত বলে বর্ণনা করেছিলেন। তা হলে চুপ করে আছেন কেন? আর্মস্ট্রং-এর উত্তর ছিল, “সবার জীবনেই একটা না একটা মুহূর্ত আসে যখন মনে হয় ঢের হয়েছে, আর না। আমারও সেই সময়টা এসে গিয়েছে।”
ক’টা মাস মাত্র পেরিয়েছে তার পর। এ দিন ওপরার শো-এ যে আর্মস্ট্রংকে দেখা গেল, তিনিও এক অর্থে ‘ঢের হয়েছে’ই বললেন। “অনেক মিথ্যে কথা অনেক বছর ধরে বলেছি। আর পারছি না, আমি ক্লান্ত” এটাই ছিল তাঁর বক্তব্যের মূল সুর।
পাঁচটা প্রশ্ন ছিল। যার জবাব দিতে হবে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’-য়ে।
এক, আপনি কি নিজের সাইক্লিং পারফরম্যান্সের উন্নতির জন্য কখনও নিষিদ্ধ রাসায়নিক ব্যবহার করেছেন?
দুই, সেই রাসায়নিকগুলোয় কি ‘ইপিও (ইরিথ্রোপোইয়েটিন)’ ছিল?
তিন, পারফরম্যান্স ভাল করার জন্য কখনও কি ব্লাড ডোপ বা ব্লাড ট্রান্সফিউশন করিয়েছেন?
চার, টেস্টোস্টেরন, কর্টিজন বা হরমোন বর্ধক ড্রাগ নিয়েছেন কোনও দিন?
পাঁচ, আপনার সাত বার ত্যুর দ্য ফ্রাঁসে খেতাব জয়ে কি এক বারও নিষিদ্ধ ড্রাগ নিয়েছিলেন? |
ওপরা উইনফ্রের মুখোমুখি লান্স আর্মস্ট্রং। ছবি: রয়টার্স |
পাঁচ বারই লান্স আর্মস্ট্রংয়ের জবাব এল, “হ্যাঁ।” ভারতীয় সময় অনুযায়ী শুক্রবার সকালে তিনি টিভির পর্দায় নিজেকে প্রাণপণে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করতে করতে স্বীকার করলেন, “সারা দুনিয়াকে এত দিন ধরে মিথ্যা বলে এসেছি। ‘ওয়ান বিগ লাই’। ড্রাগ না নিলে সাত বার ত্যুর দ্য ফ্রাঁসে জিততে পারতাম না। কোনও মানুষের পক্ষেই তা সম্ভব নয়।”
এই অভিব্যক্তির সঙ্গে একেবারেই পরিচিত নন ফ্লয়েড ল্যানডিস, টাইলার হ্যামিল্টনরা। সাত বার ত্যুর দ্য ফ্রাঁসে খেতাব জয়ের সময় এঁরাই তো লান্সের পাশে ছিলেন, দিন-রাত দেখেছেন তখনকার সেই কিংবদন্তিকে। এই দু’জনের জন্যই তখনকার সেই উদ্ধত, অহঙ্কারী লান্স আর্মস্ট্রং আর এই লান্স আর্মস্ট্রংয়ের মধ্যে সহস্র যোজন তফাত। এঁরা মুখ না খুললে হয়তো গোটা বিশ্ব কোনও দিনই জানতে পারত না, খেলাধুলোর ইতিহাসে সব চেয়ে বড় প্রতারণার কথা।
দু’বার ত্যুর জেতার পরে ২৫ বছর বয়সে ক্যানসার ধরা পড়ে আর্মস্ট্রংয়ের। সেখান থেকে আবার ট্র্যাকে ফেরেন তিনি। বাকি পাঁচটা ত্যুর তার পরেই জেতা। কী পাননি জীবনে? অতুল সম্মান, অর্থ, খ্যাতি, সুখী পরিবার..। জীবনযুদ্ধে জয়ের প্রতীক হয়ে ওঠা আর্মস্ট্রং যুবরাজ সিংহের মতো অনেকের কাছে আদর্শ ছিলেন। সেই আর্মস্ট্রংয়ের বিরুদ্ধে আজ সোশ্যাল নেটওয়ার্কে উপচে পড়েছে পোস্ট, যার কয়েকটায় তাঁর মৃত্যুদণ্ডের দাবি পর্যন্ত উঠেছে। যে ভাবে তিনি মানুষের বিশ্বাসে ঘা দিয়েছেন, তাকে কোনও অংশে নরহত্যার চেয়ে কম অপরাধ বলে মনে করছেন না তাঁরা। বিশ্বের এক নম্বর টেনিস তারকা নোভাক জকোভিচ অস্ট্রেলীয় ওপেন খেলার মধ্যেই বলেছেন, “জীবনের বাকি সময়টা লান্সকে ওর পাপের ফল ভোগ করতে হবে। আর সেটাই ওর প্রাপ্য। ও একটা প্রতারক।”
এটাই যে প্রাপ্য, সেটা মানছেন আর্মস্ট্রং নিজেও। সেই জন্যই সব জেনেশুনে ওপরার শো-তে স্বীকারোক্তি করলেন তিনি। এবং মেনে নিলেন, স্বীকারোক্তিটা করতেও বড্ড দেরি হয়ে গেল। কিন্তু দর্শকদের আজও স্তম্ভিত করেছে যেটা, সেটা আর্মস্ট্রংয়ের মনের জোর। কোনও কান্নাকাটি নেই, ভেঙে পড়া নেই। ভিতরে ভিতরে নার্ভাস ছিলেন নিশ্চয়ই। বারবার মুখে হাত দিচ্ছিলেন। কিন্তু বহিরঙ্গে এর চেয়ে বেশি কোনও অস্বস্তির লক্ষণ না দেখিয়ে আশ্চর্য নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে নিজের সমস্ত কুকীর্তির কথা বলে গেলেন তিনি। বললেন, ২০০৯-এ ট্র্যাকে ফেরার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা বোকামি হয়েছে। গত কয়েক বছরে ডোপিং পরীক্ষার রীতিনীতি অনেক বদলিয়েছে। আগের ১৪ বছর যে ভাবে ডোপিং-গুঞ্জন সামলে পার পেয়েছেন, এখন পেলেন না। মানলেন, জীবনটা সব সময় নিজের মতো করে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছেন, করে এসেওছেন। এ বারই ব্রেকটা কাজ করল না।
আল্পস পর্বত ডিঙোনো আর্মস্ট্রং এখন পাপের পাহাড় মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে। সব স্বীকার করে নিয়ে কি কিছু সুবিধা হবে? শোনা যাচ্ছে, ডোপিং বিরোধী সংস্থার কর্তাদের সামনে ফের স্বীকারোক্তি করলে হয়তো তাঁর শাস্তি সামান্য কমতে পারে। হয়তো ফেরত আসতে পারে তাঁর অলিম্পিক ব্রোঞ্জ। কিন্তু কলঙ্ক মুছবে কি?
এ বার ঢোক গিললেন লান্স আর্মস্ট্রং। মানুষের বিশ্বাস নষ্ট করেছি আমি। বাকি জীবন জুড়ে তার খানিকটা ফেরত পাওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাব। ক্ষমা চেয়ে যাব।
ক্যানসারের চেয়েও কঠিন যুদ্ধে জীবনের চাকাকে আর এক বার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় লান্স আর্মস্ট্রং। |
‘ব্ল্যাক’ আর্মস্ট্রং |
|
১৯৯৬ টেস্টিকুলার ক্যানসার ধরা পড়ে। চিকিৎসায় পরের বছরই রোগমুক্তি।
১৯৯৯ প্রথম ত্যুর দ্য ফ্রান্স খেতাব।
২০০০ সিডনি অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ। প্রথম বই ‘ইটস নট অ্যাবাউট দ্য বাইক’ প্রকাশিত।
২০০৪ ষষ্ঠ বার ত্যুর দ্য ফ্রান্স জেতার পর তাঁকে নিয়ে দুই সাংবাদিক পিয়ের ব্যালিস্টার ও ডেভিড ওয়ালশের লেখা বই ‘এল এ কনফিডেন্সিয়াল’ প্রকাশিত। যাতে প্রথম আমস্ট্রংয়ের বিরুদ্ধে ডোপিংয়ের অভিযোগ তোলা হয়।
২০০৫ টানা সাত বার ত্যুর দ্য ফ্রান্স জিতে অবসর ঘোষণা। ফরাসি সংবাদপত্র ‘লেকিপ’ দাবি করে, ১৯৯৯-এ নেওয়া ও সংরক্ষিত তাঁর মূত্র নমুনায় নিষিদ্ধ ইরিথ্রোপোয়েটিন পাওয়া গিয়েছে।
২০০৬ ডোপিংয়ের অভিযোগ থেকে মুক্তি।
২০০৮ পেশাদার সাইক্লিংয়ে ফেরার সিদ্ধান্ত।
২০১০ ত্যুর দ্য ফ্রান্সে ২৩তম স্থান। প্রাক্তন সতীর্থ ফ্লয়েড ল্যান্ডিস প্রথম তাঁর ও লান্সের ডোপ করার কথা ফাঁস করেন। অভিযোগ নিয়ে সরকারি তদন্ত শুরু আমেরিকায়।
২০১১ আন্তর্জাতিক সাইক্লিং থেকে অবসর।
২০১২ ফেব্রুয়ারিতে সরকারি তদন্ত বন্ধ। জুনে মার্কিন ডোপিং বিরোধী সংস্থার রিপোর্টে তাঁর ডোপ করার তথ্য। তিনি স্বীকার না করলেও প্রতিবাদও করেননি। ওই সংস্থা কর্তৃক ১৯৯৮ অগস্ট থেকে জেতা তাঁর যাবতীয় খেতাব কাড়ার সিদ্ধান্ত। এর বিরুদ্ধেও আবেদন জানাননি আমস্ট্রং।
২০১৩ টিভি টক শোয়ে অবশেষে স্বীকারোক্তি। মেনে নিলেন নিয়মিত ডোপিং করতেন তিনি। |
|
ডোপিং না করলে...
• ডোপিং না করলে এত বার ‘ত্যুর দ্য ফ্রান্স’ জিততাম না। কিন্তু আমি যা করেছি তা নতুন নয়, অনেকেই করেছে। আমার অপরাধ, আমি সেটা রোখার চেষ্টা না করে মদত দিয়েছি।
কী ভাবে ডোপিং
• আমার ‘ককটেল’-এর প্রধান উপাদান ছিল টেস্টোস্টেরন, এরিথ্রোপোয়েটিন বা ইপিও। তবে অল্প পরিমাণে। ব্লাড ট্রান্সফিউশনও করিয়েছি অনেক বার।
কেন কুকীর্তি
• জেতার অদম্য খিদে। সে যে কোনও উপায়েই হোক। কিন্তু সেটা এতই কঠিন হয়ে ওঠে যে, নিজেকে সেই জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য এ ছাড়া কোনও উপায় ছিল না।
গুন্ডামি.....
• বহু করেছি। সার্কিটে যদি কেউ আমার সঙ্গে শত্রুতা করত, তাকে শেষ করার জন্য যা যা করা দরকার, সবই করতাম।
ভবিষ্যৎ
• বাকি জীবন ধরে আমাকে নতুন করে মানুষের ফের বিশ্বাস অর্জনের চেষ্টা করতে হবে। গোটা বিশ্বের কাছে চিরকাল ক্ষমা চেয়ে যেতে হবে। |
|
|
|
|
|
|