পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের সুপবন প্রবাহিত করিতে হলদিয়ায় শিল্প-সম্মেলন সমাপ্ত। তাহার মঞ্চ হইতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যে লগ্নি করার জন্য শিল্পপতিদের আহ্বানও জানাইয়াছেন। কিন্তু লগ্নির উপযুক্ত পরিবেশ ও পরিকাঠামো প্রস্তুত করার যে দায় একান্ত রাজ্য সরকারেরই, সেই ক্ষেত্রটিতে ত্রুটিবিচ্যুতি সংশোধনের লক্ষণ নাই। বরং শিল্পের জন্য সিলিং-বহির্ভূত জমি রাখা সহ অন্যান্য ছাড়পত্র এখন কত সহজে মেলে, মুখ্যমন্ত্রী দুই-একজন শিল্পপতিকে দেখাইয়া সেই দাবি জানাইয়াছেন। মুশকিল হইল, দুই-এক জনের অভিজ্ঞতা যেমনই হউক, এ রাজ্যে প্রশাসনিক দীর্ঘসূত্রিতায় প্রয়োজনীয় যাবতীয় ছাড়পত্র মিলিতেই দুই-তিন বৎসর লাগিয়া যায়। মুখ্যমন্ত্রী যে সভাস্থলে দৃষ্টান্ত দেখাইয়া লগ্নিকারীদের কাছ হইতে বাড়তি বাহবা পাইতে চাহিয়াছেন, তাহাও এক হিসাবে হাস্যকর। শিল্পপতিদের দ্রুত ছাড়পত্র দেওয়ার মধ্যে বাহাদুরির কিছু নাই, অন্যান্য রাজ্যে স্বাভাবিক নিয়মেই ইহা লগ্নিকারীদের প্রাপ্য হইয়া থাকে।
মুখ্যমন্ত্রী যখন দুই-একজন শিল্পপতির জমি-সংক্রান্ত ছাড়পত্র দ্রুত দেওয়ার কৃতিত্ব দাবি করেন, তখনও কিন্তু শিল্পবিনিয়োগ বিষয়ক অন্যান্য বহু ছাড়পত্র ঝুলিয়া থাকে। এই রাজ্যে কারখানা স্থাপন করিতে জমি একটি বড় সমস্যা, কিন্তু একমাত্র সমস্যা নয়। তাহার পরও রকমারি সরকারি অনুমতি, শংসাপত্র বিভিন্ন দফতর হইতে সংগ্রহ করিতে লগ্নিকারীরা জেরবার হন। পদে পদে আমলাতান্ত্রিক লাল ফিতার ফাঁসে আটকাইয়া যায় বিভিন্ন জরুরি অনুমতি। হলদিয়ার শিল্প-যজ্ঞে আমন্ত্রিত হইয়াও দেশের প্রথম সারির কোনও শিল্পপতিই যে এই রাজ্যে পা রাখিলেন না, তাহার পিছনে দীর্ঘসূত্রিতার নেতিবাচক অভিজ্ঞতার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। আর, যে সরকারের শাসক দল বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীকে কুলার বাতাস দিয়া রাজ্য হইতে বিদায় করিয়া ক্ষমতাসীন, তাহাকে লগ্নিকারীদের আকর্ষণ করিতে আরও উদ্যোগী হইতে হইত। কেন্দ্রবিরোধী তোপধ্বনি, রাজ্যের নিজস্ব কোষাগারের সমূহ দুরবস্থা তুলিয়া ধরা, পূর্বতন সরকারের মুণ্ডপাত করা কিংবা মঞ্চে স্থানীয় শিল্পপতিদের দিয়া গান গাওয়াইয়া সেই লক্ষ্য সাধন দুরূহ। পশ্চিমবঙ্গে শিল্প-বিনিয়োগের আকাল দীর্ঘ দিনের। বামফ্রন্টের আমল হইতেই আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতার নিরিখে লগ্নিকারীদের অভিজ্ঞতা ছিল ভয়াবহ। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মুখ্যমন্ত্রিত্বের শেষ দিকে লগ্নির অনুকূল বাতাবরণ রচনার তৎপরতা শুরু হইলেও পরিকাঠামোগত ঘাটতি দ্রুত শিল্পায়নের পথে বাধা হইয়া দাঁড়ায়। শেষ পর্যন্ত বিরোধী দলের জমি-আন্দোলন গোটা উদ্যোগেই জল ঢালিয়া দেয়। সেই বিরোধীরা আজ রাজ্যে ক্ষমতাসীন, দেশের লগ্নিকারীরা তাহার প্রতিশ্রুতিতে যথেষ্ট আস্থা রাখিতে না পারিলে তাঁহাদের দোষ দেওয়া কঠিন। উপরন্তু সামাজিক বিশৃঙ্খলা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের উপর আক্রমণের উপর্যুপরি ঘটনা, আইনের শাসন রক্ষায় পুলিশ-প্রশাসনের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ, নির্মাণ শিল্পে শাসক দলের স্থানীয় মাতব্বরদের ব্যাপক তোলাবাজি আদপেই বিনিয়োগ-অনুকূল কোনও পরিবেশ নয়। |