অবশেষে আরাবুল ইসলাম গ্রেফতার হইলেন। ভাঙড় কাণ্ডে জড়িত থাকায় পাঁচটি জামিন-অযোগ্য ধারায় পুলিশ তাঁহাকে গ্রেফতার করিয়াছে। ঘটনা ঘটিয়া যাইবার এগারো দিন পরে এই ব্যবস্থাগ্রহণ নিঃসন্দেহে একটি বিলম্বিত পদক্ষেপ। তবে বিলম্বিত হইলেও বোধোদয় সর্বদাই সাধু ঘটনা, যাহাকে সাধুবাদ না জানাইয়া উপায় নাই। এই বিলম্বিত ব্যবস্থাগ্রহণের বিকল্প হইত কোনও ব্যবস্থাই না-লওয়া। তাহা হইত রাজধর্মের চরম লজ্জাকর বিচ্যুতি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার সেই বিচ্যুতির ফাঁদে না পড়িবার জন্যই সাধুবাদ দাবি করে। আরও একটি কারণে স্বতঃস্ফূর্ত স্বস্তি উঠিয়া আসে। আরাবুলকে যে আদৌ গ্রেফতার করা হইবে, ঘটনার পর তেমন কোনও সম্ভাবনাই দেখা যায় নাই, শাসক দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা-মন্ত্রীরা (যাঁহাদের অধিকাংশই মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন বলিয়া মান্য) বরং ভাঙড় কাণ্ডে আরাবুলের ভূমিকার প্রশংসায় পঞ্চমুখ প্রফুল্লতা প্রকাশ করিতেছিলেন, একাধিক মন্ত্রী স্বতঃপ্রণোদিত হইয়া তাঁহাকে ‘তাজা নেতা’, ‘উদ্যমী ছেলে’ ইত্যাদি শংসাপত্রে ভরাইয়া দিতেছিলেন। সব মিলিয়া মনে হইয়াছিল, পশ্চিমবঙ্গে অরাজকতা ও উচ্ছৃঙ্খলতার পৌরোহিত্য চলিতেছে, এবং এই পুরোহিতরাই রাজ্যের তমসাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের নির্ণায়ক উপাদান হইয়া উঠিবেন। এক দিকে প্রতিবাদ, অন্য দিকে হতাশা দ্রুত ছড়াইতেছিল। স্বয়ং রাজ্যপাল ‘রাজ্যে গুণ্ডারাজ চলিতেছে’ বলিয়া সরকারকে ভর্ৎসনা করিয়াছিলেন। নাগরিক সমাজ ও বিদ্বজ্জনদের তরফেও আশঙ্কা ও ধিক্কার ধ্বনিত হইতেছিল। এই ব্যাপ্ত হতাশার মধ্যে সম্পূর্ণ একশত আশি ডিগ্রি ঘুরিয়া গিয়া আরাবুলকে গ্রেফতার করিবার যে সৎসাহস দেখাইলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তাহাতে সরকারের রাজধর্মে স্থিত হওয়ার সঙ্কল্পের ইঙ্গিত। রাজ্যবাসী বিস্তর স্বস্তি বোধ করিতেছেন।
কোন প্রণোদনায় এই বিলম্বিত পদক্ষেপ, স্বভাবতই তাহা লইয়া জল্পনার শেষ নাই। হয়তো সমাজের চাপে, হয়তো বিরোধী পক্ষের প্রতিবাদ-আন্দোলনে, হয়তো রাজ্যপালের তিরস্কারে, এবং হয়তো শাসক দলেরও অন্দরে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বরিষ্ঠ নেতাদের পরামর্শে আরাবুল প্রশ্নে সরকার বিলম্বে হইলেও সঠিক পদক্ষেপ করিল। আবার এমনও হওয়া সম্ভব যে আরাবুলের গ্রেফতারির নেপথ্যে কোনও উচ্চমার্গের রাজনীতি আছে। এমন জল্পনাও চলিতেছে যে, আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় দলের শক্ত জমি যাহাতে বেহাত হইয়া বিরোধীদের দখলে চলিয়া না যায় এবং অতঃপর এলাকার বাম নেতাদেরও একই ধরনের অভিযোগে গ্রেফতার করিয়া নিষ্ক্রিয় করিয়া রাখা যায়, সেই লক্ষ্যেই নাকি আরাবুলকে আপাতত বলি দিতে তৃণমূল নেতৃত্ব সম্মত হইয়াছেন। কিন্তু যদি এ জল্পনা সত্যও হয়, তাহা হইলেও বলিতেই হয়, আইনের শাসন কায়েম রাখা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যে-কোনও নির্বাচিত সরকারের কর্তব্য। কোনও দলীয় বাহুবলী যদি আইনের শাসনে ক্রমাগত অন্তর্ঘাত করিতে থাকে, নিজেকে আইনের ঊর্ধ্বে বলিয়া গণ্য করে, পুলিশ-প্রশাসনকে অগ্রাহ্য করিয়া এলাকায় যথেচ্ছাচার কায়েম করে, তাহা গণতন্ত্রের পক্ষে শুভ নয়। শাসক দলের পক্ষেও এমন নেতাকে দুধ-কলা দিয়া প্রতিপালন করিবার ফল ভাল হয় না। রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নে আরাবুল ইসলাম কিংবা মজিদ মাস্টারের মতো ভুঁইফোঁড় নেতাদের লালন-পালনের অবদান প্রভূত। এলাকায় দলের প্রভাব কায়েম করিতে, প্রতিপক্ষ দলকে কোণঠাসা বা শায়েস্তা করিতে এই ধরনের উঠতি নায়কদের প্রশ্রয় দেওয়ার রেওয়াজ পশ্চিমবঙ্গে নূতন নয়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্থানীয় বাহুবলীরা কালক্রমে দলের কাঁটা হইয়া ওঠেন, তখন দল তাঁহাদের গিলিতেও পারে না, ওগরাইতেও পারে না। শেষ পর্যন্ত শীর্ষ নেতৃত্বের বরাভয় আশীর্বাদের হাত মাথার উপর হইতে সরিয়া গেলে আরাবুলরা পথের পাশে পরিত্যক্ত পড়িয়া থাকেন। তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার যে একজন আরাবুলের অপকর্মের দায় হইতে আপনাকে মুক্ত করিবার প্রয়াস করিতেছে। রাজ্য জুড়িয়া অন্যান্য আরাবুলদের ক্ষেত্রেও একই ধরনের প্রশাসনিক দৃঢ়তা ও দলীয় নিরপেক্ষতা অবলম্বন করা হইবে কি না, তাহা অবশ্য কেবল ভবিষ্যৎই বলিতে পারে। |