হাইকোর্টে প্রদীপ তা-র স্ত্রী ও মেয়ে যে নিরাপত্তার অভাবের কথা জানিয়েছেন, কার্যত একই অভিযোগ জানাচ্ছে গোটা দেওয়ানদিঘি। তবে তৃণমূলের দাবি, পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিকে চোখ রেখে একেবারে ছক কষে এই ধরনের হাওয়া তোলা হচ্ছে।
১১ মাস আগে বর্ধমান শহরের উপকণ্ঠে এই দেওয়ানদিঘিতেই দিনে-দুপুরে প্রকাশ্যে পিটিয়ে মারা হয়েছিল সিপিএমের ডাকসাইটে নেতা প্রদীপ তা-কে। তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে খুন হন সত্তরোর্ধ্ব নেতা কমল গায়েনও। সেই ঘটনায় অভিযুক্ত আট জনকে পুলিশ এখনও ধরতেই পারেনি। ধরা পড়েও জামিনে ছাড়া পেয়ে গিয়েছে ন’জন। তিন জনকে চার্জশিট থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, যা নিয়ে শুক্রবার প্রশ্ন তুলেছে খোদ হাইকোর্ট।
এই পরিস্থিতিতে শুধু নিহত নেতার স্ত্রী চিত্রলেখা তা বা মেয়ে পৃথা নন, দেওয়ানদিঘির সিপিএম কর্মীদের একটা বড় অংশ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলে জেলা নেতাদের দাবি। তাঁদের ব্যাখ্যা, আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে ওই এলাকার আসনগুলিতে যাতে সিপিএমের কেউ দাঁড়াতেই না পারে, তা নিশ্চিত করতে ‘পরিকল্পিত সন্ত্রাস’ চালাচ্ছে তৃণমূল। প্রায় প্রতি দিনই কর্মী-সমর্থকদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, সিপিএম করলে আর এলাকায় থাকতে দেওয়া হবে না। কিছু কর্মী ইতিমধ্যেই গ্রামছাড়া। তবে তৃণমূলের দাবি, পঞ্চায়েত ভোটে প্রার্থী পাবে না বুঝেই সিপিএম সন্ত্রাসের গল্প ফাঁদছে। |
প্রদীপবাবুর স্ত্রী চিত্রলেখা তা এ দিন অভিযোগ করেন, খুনে অভিযুক্ত এক তৃণমূল নেতা মির্জাপুরে তাঁর দেওরের বাড়ির বাইরে পার্কে বসে সপরিবার খুনের হুমকি দিচ্ছে। ধৃত ১১ জনের মধ্যে যে ৯ জন হাইকোর্ট থেকে জামিনে ছাড়া পেয়েছে, তারাই নানা রকম কটূক্তি করছে ও হুমকি দিচ্ছে বলে সিপিএমের অভিযোগ। চিত্রলেখাদেবী বলেন, “সেই কারণেই এ দিন হাইকোর্টে গিয়ে নিরাপত্তার আবেদন জানাই।” সিপিএমের জেলা সম্পাদক অমল হালদারের বক্তব্য, “আগেই হাইকোর্ট মন্তব্য করেছিল, সিআইডি-র হাতে তদন্তভার থাকলেও মা ও মেয়েকে নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যাপারে স্থানীয় পুলিশ বা প্রশাসনের দায়িত্ব রয়েছে। খুনে জড়িতেরা জামিন পেয়ে কী করছে, সে দিকে পুলিশের নজর রাখা দরকার। তারা গোলমাল পাকানোর চেষ্টা করলে পুলিশেরই আদালতে রিপোর্ট দেওয়া উচিত।” তাঁর দাবি, প্রদীপবাবুর বাড়ির কাছেই তৃণমূলের একটি অফিস থেকে তাঁর পরিবারকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
এ দিন দুপুরে প্রদীপবাবুর বাড়ির পাশে দেওয়ানদিঘি বাজারে গিয়ে অবশ্য এই দাবি সমর্থন করার মতো লোক মেলেনি। অন্তত জনা দশেক প্রসঙ্গ শুনেই এড়িয়ে যান। কয়েক জন বলেন, “ কী জানি, কিছু বললে বিপদ হবে না তো!” তবে প্রীতম কর্মকার নামে এক যুবক আড়াল দেখে নিচু গলায় বলেন, “এখন তো এলাকা শান্ত। প্রদীপবাবুর স্ত্রী শিক্ষকতা করছেন। তাঁর মেয়ে কলকাতায় লেখাপড়া করছে বলে শুনেছি। ওঁরা সিপিএমের নানা অনুষ্ঠানেও যোগ দিচ্ছেন। কেউ ওঁদের উত্ত্যক্ত করছে বলে আমরা অন্তত শুনিনি।” গৌরাঙ্গ তা নামে এক জন বলেন, “আমরা প্রদীপবাবুর পরিবারকে সহানুভূতির চোখেই দেখি। ওঁর স্ত্রী বা মেয়েকে প্রায়ই বাজারে দেখতে পাই। নিরাপত্তা চেয়ে ওঁরা কেন হাইকোর্টে গেলেন, তা জানি না।”
সিপিএম অবশ্য দাবি করছে, ভয়ে লোকে তৃণমূলের বিরুদ্ধে মুখ খুলছে না। দেওয়ানদিঘিতে সিপিএমের সদর জোনাল অফিসে বসে জোনাল সদস্য দেবু রায় অভিযোগ করেন, “শুধু যে ওই পরিবারটি ভয়ে রয়েছে তা নয়। আমাদেরও গোপনে কাজ করতে হচ্ছে। প্রশাসন প্রকাশ্য মিটিং-মিছিল করার অনুমতি দিচ্ছে না। অথচ তৃণমূলের লোকেরা মিছিল করে এসে আমাদের কর্মীদের মারধর করছে, গ্রামছাড়া করছে। অভিযোগ পেয়েও পুলিশ ব্যবস্থা নিচ্ছে না।” সিপিএমের অভিযোগ, বিধানসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হতেই জেলা পরিষদের সদস্য তথা দলের স্থানীয় নেতা সামসুর আলিকে তাঁর গ্রাম ইউসুফাবাদ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। আজও ফিরতে পারেননি। মালকিতা গ্রামের এক কর্মী দম্পতিও ঘরছাড়া। মাইনগরে মাত্র কয়েক দিন আগে সিপিএমের পতাকা পুড়িয়ে দেয় তৃণমূলের লোকেরা। প্রতিবাদ করতে গিয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের এক জনের বাড়ি ও মোটরবাইক পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ভাঙচুর করা হয় অন্য এক জনের বাড়ি। নির্বাচনের পর থেকে বন্ধ থাকা একটি ট্রেড ইউনিয়ন অফিসও খোলা যাচ্ছে না। দাসপুরে ডিওয়াইএফ-এর সম্মেলনের অনুমতি দেয়নি পুলিশ। কিন্তু সম্মেলন হবে ধরে নিয়ে জড়ো হওয়া কিছু যুবকককে মারধর করেছে তৃণমূল। পুলিশ আহতদের বিরুদ্ধেই মামলা রুজু করেছে।
দেবুবাবুদের দাবি, “পঞ্চায়েত ভোটে যাতে আমরা প্রার্থী দিতে না পারি, সেই উদ্দেশ্যেই পরিকল্পিত ভাবে আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের আবহাওয়া কায়েম করছে তৃণমূল।” তৃণমূলের স্থানীয় যুব নেতা নুরুল হাসান পাল্টা বলেন, “নতুন করে তো কিছু হয়নি। আসলে পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে সিপিএম মৃতদেহ সামনে রেখে বাজার গরম করতে চাইছে।” অমলবাবু আবার বলেন, “তৃণমূলের লোকেরা বুঝে গিয়েছে, খুন-জখমের রাজনীতি করে ওদের পায়ের তলায় মাটি সরে যাচ্ছে। তাই ওরা এলাকা দখল রাখতে মরিয়া। আমরা রাজনৈতিক ভাবে এই সন্ত্রাসের প্রতিরোধ করছি। করবও।” |