এক সপ্তাহের মধ্যে পাকিস্তানের ভোল পালটাইয়া গেল। আধুনিক অলঙ্কার ব্যবহারে বলা যায়, চলমান পাকিস্তান গাড়িটিতে যেন সজোর হ্যাঁচকা-য় গিয়ার পরিবর্তন হইল। সোমবার শিয়া মুসলিমদের উপর আক্রমণের প্রতিবাদে আন্দোলনের অভিঘাতে বালুচ প্রদেশের সরকার পত্রপাঠ বরখাস্ত। সোম ও মঙ্গলবার উপর্যুপরি বোমা হানায় বহু প্রাণনাশ। মঙ্গলবার পাক সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক প্রধানমন্ত্রী রাজা পারভেজ আশরাফ-এর নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি। মঙ্গল-বুধ জুড়িয়া প্রবাস-ফেরত বিদ্রোহী, কট্টর ইসলামি মহম্মদ তাহির উল-কাদ্রি ও তাঁহার লক্ষাধিক সমর্থকের সরকার-বিরোধী মিছিলে রাজধানী ইসলামাবাদের নাভিশ্বাস। কাহার কী উদ্দেশ্য, আপাত এবং সত্যকারের উদ্দেশ্যের মধ্যে কতখানি পার্থক্য, সবই ধোঁয়ার অতলে। এইটুকু নিশ্চিত, পাকিস্তানের প্রথম বার গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ ফুরাইবার সময় ঘনাইয়া আসিতেই এত রকম অঘটনের ছড়াছড়ি। অর্থাৎ এতগুলি অঘটনের বহুবিধ লক্ষ্যের মধ্যে একটি লক্ষ্য নিশ্চিত: ক্ষমতাসীন সরকারকে আইনসিদ্ধ রাস্তায় তাহার মেয়াদ শেষ করিতে না দেওয়া, এবং পরবর্তী ‘গণতান্ত্রিক’ নির্বাচনের রাস্তায় এমন কাঁটা রোপণ করা যাহাতে নির্বাচনী ফলাফল বাহির হইতে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। বিভিন্ন পক্ষ ক্রিয়াশীল, বিভিন্ন পক্ষ বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণের আশা-পোষণে ব্যস্ত, সুতরাং কোন ধরনের নিয়ন্ত্রণ অতঃপর পাকিস্তানে বিরাজ করিবে, এ সকল গূঢ় তত্ত্ব আপাতত রহস্য-গুহাতেই নিহিত।
কাদ্রি কী চাহেন? পাকিস্তানের মন্ত্রী-নেতৃ-স্থানীয় ব্যক্তিরা, এবং তাঁহারা যে রাজনৈতিক শ্রেণির প্রতিভূ, সেই শ্রেণির অপার অর্থনৈতিক দুর্নীতিই তাঁহার বিক্ষোভের লক্ষ্য। এই শ্রেণিকে হটাইয়া তিনি ‘সত্যকারের’ নির্বাচন চাহেন, যাহাতে জনগণের ‘সত্য’ প্রতিনিধিরা (অর্থাৎ রক্ষণশীল ইসলামি নেতারা) উঠিয়া আসিতে পারেন। পশ্চিম এশিয়ার মতো কট্টর সমাজ-প্রশাসনই তাঁহার লক্ষ্য। উন্নয়নহীন, বেকারত্ব-দীর্ণ, অর্থনৈতিক সংকটে গ্রস্ত পাকিস্তানি সমাজে বিপুল লোকবল লাভ করিয়াছেন এই ধূমকেতুসম নেতা, বিপুল অর্থবল তাঁহার পিছনে। অর্থবলের উৎসটি অবশ্য অজানা। সুতরাং বোঝা যায় না, কাদ্রির আপাত লক্ষ্যের পিছনে কী বা কেহ বা কাহারা রহিয়াছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সর্বদাই রহস্যময় প্রতিষ্ঠান, এখনও পর্যন্ত এই সংকটে তাহারা অতীব রহস্যখচিত নীরবতার সহিত বিক্ষুব্ধ পক্ষ ও সরকার পক্ষকে অবলোকন করিয়া চলিতেছে। ইতিপূর্বে সামরিক প্রধান জেনারেল কায়ানি কয়েক বার বলিয়াছেন যে পাক সেনা আর আগের মতো প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে জড়াইতে ইচ্ছুক নয়, ফলে প্রত্যক্ষ ‘ক্যু’-র সম্ভাবনা কম। তবে পরোক্ষ ভাবে নিয়ন্ত্রিত পালাবদল বা সফ্ট ক্যু-র আসন্নতা উড়াইয়া দেওয়া যায় না। মুশকিল এই যে, ক্ষমতাসীন পিপিপি দলের নেতৃবর্গ প্রেসিডেন্ট জারদারি কিংবা প্রধানমন্ত্রী আশরাফের মতোই প্রধান বিরোধী পিএমএল-এন নেতা নওয়াজ শরিফও সেনা-প্রতিষ্ঠানের বিশেষ অপ্রিয়। কোন নেতা বা কোন দলকে জেনারেল কায়ানি কৃপা করিতেছেন বা করিবেন, এখনও তাহা অস্পষ্ট।
সামগ্রিক চিত্রটি জটিলতর করিয়া তুলিয়াছে পাক সুপ্রিম কোর্ট। প্রথমে প্রেসিডেন্ট জারদারির বিরুদ্ধে পুরাতন বিচার তুলিয়া আনিয়া গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি, তার পর জারদারির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ না লইবার অপরাধে প্রধানমন্ত্রী গিলানির পদচ্যুতি, এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আবারও পুরাতন দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতারের হুমকি: ইহার মধ্যে বিচারবিভাগের রাজনৈতিক কর্মযোগের একটি ছবি দেখিতে পাওয়া সম্ভব। সেই রাজনীতি যদি সেনাবিভাগ ও বিচারবিভাগের মধ্যে সংযোগী হইয়া থাকে, তাহা হইলে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত ভাবেই ঘোর তমসাময়। স্বভাবতই এই পরিস্থিতিতে সর্বাপেক্ষা বিচলিত ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পাকিস্তানে সুস্থিত গণতন্ত্রের সঙ্গে ইহাদের ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি ও কর্মপন্থা ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িত। বিশেষত ২০১৪ সালে আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহারের আগে পাকিস্তান রাজনৈতিক ভাবে স্থিতিশীল না হইলে ভারত তথা দক্ষিণ এশিয়ায় প্রবল সংকটের সম্ভাবনা উড়াইয়া দেওয়া যায় না। |