নিছক দুর্ঘটনা হিসেবে ভুলে যেতে চাওয়া নয়, অভিভাবকদের কাছে নতুন করে একটা ভাবনার দরজা খুলে দিল ছোট্ট আরিয়ানের মর্মান্তিক পরিণতি। যাতে তাঁরা সন্তানদের আরও বেশি করে সতর্ক করার কথা ভাবতে পারেন। স্কুলের পরিকাঠামোয় জরুরি কিছু অদলবদল করা যায় কি না, সে ভাবনার পথ খুলে দিল শিক্ষক-শিক্ষিকাদের জন্যও। যাতে আর কোনও আরিয়ানের এমন পরিণতি দেখতে না হয়। যাতে আরও একটু যত্নবান হওয়া যায় পড়ুয়াদের প্রতি।
শহরের চিকিৎসকদের একটা বড় অংশের বক্তব্য, একসঙ্গে অনেকটা খাবার মুখের মধ্যে ভরে ফেলা, খেতে খেতে
|
আরিয়ান দত্ত |
অনর্গল কথা বলে যাওয়া, খাওয়ার সময়ে হুটোপাটি করা অধিকাংশ শিশুরই প্রায় মজ্জাগত। বহু ক্ষেত্রেই অভিভাবকরা এ নিয়ে উদাসীন। অনেক ক্ষেত্রে স্কুলও এ বিষয়ে খেয়াল রাখে না। এই অসতর্কতার মূল্যই জীবন দিয়ে চোকাতে হতে পারে।
অভিভাবকদের অনেকেই জানিয়েছেন, ছোটরা যাতে টিফিন খাওয়ার সময়ে পোশাক নোংরা করে না ফেলে এবং চার দিকে খাবার না ছড়ায়, সেই কারণেই বেশির ভাগ স্কুল বাড়ি থেকে টিফিনে শুকনো খাবার দিতে নির্দেশ দেয়। বিস্কুট, কেক জাতীয় সেই শুকনো খাবার খাওয়ার সময়ে কথা বললে অনেক সময়েই তা গলায় আটকে যাওয়ার ভয় থাকে। সে ক্ষেত্রে টিফিনের সময়ে ছোটদের ক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নজরদারি জরুরি বলে মনে করেছেন তাঁরা। ডিপিএস নিউ টাউনের ষষ্ঠ শ্রেণির আরিয়ান দত্তের এমন মর্মান্তিক মৃত্যুর পরে বুধবার বিভিন্ন স্কুলে অভিভাবকেরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ নিয়ে কথাও বলেছেন বলে খবর। |
নজর রাখুন |
• খেতে বসে তাড়াহুড়ো নয়, তাড়াতাড়ি খেতে চাপও দেবেন না
• খাওয়ার সময়ে কথা নয়
• শুয়ে শুয়ে খাওয়া নয়
• শ্বাসকষ্ট থাকলে খুব শুকনো খাবার দেবেন না
• গলায় আটকে গেলে জোর করে জল খাওয়াবেন না
• স্কুলে ‘বেসিক লাইফ সাপোর্ট কোর্স’ করা কর্মী রাখুন
• সমস্যা হলে তৎক্ষণাৎ কাছের হাসপাতালে নিয়ে যান |
|
কোন কোন দিক থেকে সতর্ক থাকা দরকার?
শিশুরোগ চিকিৎসক সুব্রত চক্রবর্তীর কথায়, “কোনও ভাবে খাবার গলায় আটকে গেলে জল খাইয়ে তা নামানোর চেষ্টা করেন অনেকে। এটা একেবারেই ঠিক নয়। এক ধরনের প্রশিক্ষণ রয়েছে, যার পোশাকি নাম ‘বেসিক লাইফ সাপোর্ট কোর্স’। বিদেশে এর খুবই চল। এখানেও ডাক্তার-নার্সেরা অনেকেই জানেন। স্কুলে এ ধরনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স থাকলে তাঁরা চটজলদি ব্যবস্থা নিতে পারবেন।” শ্বাসকষ্টের সামান্য সমস্যাও থাকলে মুড়ি, চিঁড়ে, বিস্কুটের মতো শুকনো খাবার এড়িয়ে যাওয়া উচিত বলে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
ইএনটি চিকিৎসক অরুণাভ সেনগুপ্তের আক্ষেপ ‘‘বেসিক লাইফ সাপোর্ট দিতে পারেন, এমন কোনও কর্মী ঘটনাস্থলে থাকলে তিনিই আরিয়ানের গলায় আঙুল ঢুকিয়ে খাবারের টুকরোটা বার করে আনতে পারতেন। সময়টা এ ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ। এক-একটা মিনিট দেরি হওয়ার অর্থ, মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া।” শিশরোগ চিকিৎসক প্রবাল নিয়োগী বলেন, “পিঠে চাপড় মারা বা অন্য ভাবে আটকানো খাবার বার করার চেষ্টা করতে গিয়ে সময় নষ্ট যেন না হয়। হাসপাতালে যাওয়ার পথে গাড়িতে ওই চেষ্টাগুলো করা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, দেরি করে হাসপাতালে পৌঁছলে ডাক্তারদেরও কিছু করার থাকে না।”
শিশুরোগ চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষ বলেন, “শ্বাসনালী ও খাদ্যনালী পাশাপাশি থাকে। সাধারণ ভাবে খাওয়ার সময়ে শ্বাসনালীর উপরের অংশটি ঢাকা পড়ে যায়। কিন্তু খাওয়ার সময়ে কথা বলা ও অন্য কোনও শারীরিক কাজ করলে সমন্বয় নষ্ট হয় এবং খাবার খাদ্যনালীর পরিবর্তে শ্বাসনালীতে আটকে যেতে পারে। সুতরাং খাওয়ার সময়ে খাওয়াটাই একমাত্র কাজ হওয়া উচিত। বাড়িতে তো বটেই, স্কুলেরও এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া দরকার।”
কী বলছেন বিভিন্ন স্কুল কর্তৃপক্ষ? সাউথ পয়েন্ট স্কুলের তরফে কৃষ্ণ দামানি বলেন, “এমন ঘটনা আগে কখনও শুনিনি। আমরাও হতবাক। সচেতনতা বাড়ানোর কথা ভাবতেই হচ্ছে। গোড়ায় আমরা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সচেতন করব, যাতে তাঁরা ছেলেমেয়েদের বিষয়টি বুঝিয়ে বলেন। কী ভাবে খেতে হয়, তাড়াহুড়ো করে খেলে কী বিপদ হতে পারে, সবটাই বাচ্চাদের জানাতে হবে।”
পাঠভবন প্রাথমিক বিভাগের প্রধান শিক্ষিকা রিনা চক্রবর্তী বলেন, “বাচ্চাদের টিফিন খাওয়ার সময়ে শিক্ষিকারা ঘরেই থাকেন। খাওয়ার সময়ে যাতে বেশি গল্পগুজব না হয়, সেটা নিশ্চিত করার জন্যই এই ব্যবস্থা। ডিপিএস স্কুলের ঘটনার পরে আমরা আরও সতর্ক হব।”
চিকিৎসকদের অনেকেই বলেছেন, বাচ্চারা খেতে দেরি করলে অভিভাবকেরা নিজেরাও অনেক সময়ে অধৈর্য হয়ে তাড়াহুড়ো করে অনেকটা খাবার মুখে ঠেসে দেন। এর পরিণতিও মারাত্মক হতে পারে। অভিভাবকদের প্রতি তাঁদের পরামর্শ, সন্তান এক-আধ দিন কম খেলে ক্ষতি নেই। কম সময়ে বেশি খাওয়াতে গিয়ে তার বিপদ ডেকে আনবেন না। |