পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যত খারাপ দিকে যাচ্ছে, নয়াদিল্লি-ইসলামাবাদ সম্পর্কের উত্তাপ বাড়ছে তত। হকি, ক্রিকেট, ভিসা থেকে শুরু করে দু’দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যেও তার ধাক্কা এসে লাগছে। সম্পর্কে তিক্ততার ঢেউ পৌঁছেছে রাষ্ট্রপুঞ্জেও। নিরাপত্তা পরিষদে সন্ত্রাস দমন নিয়ে বিতর্কে অংশ নিয়ে ভারতের হরদীপ সিংহ পুরি ভারত-পাক সীমান্তে উত্তেজনার প্রসঙ্গে সরব হন। অভিযোগ করেন, সন্ত্রাস কিছু দেশের রাষ্ট্রীয় নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মতো দৈত্যের সৃষ্টি করছে তারা। এই অদূরদর্শিতার ফল ভুগতে হচ্ছে তাদেরও। এই কারণে আন্তর্জাতিক মহলের প্রতি ভারতের বক্তব্য, জঙ্গি দমন আর সন্ত্রাসের পরিকাঠামো নির্মূল করাকে কোনও মতেই আলাদা করে দেখা চলতে পারে না। ঘটনাচক্রে এ বছর পাকিস্তান নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য। ফলে এ দিনের এই বিতর্ক হয় পাক বিদেশমন্ত্রী হিনা রব্বানি খারের সভাপতিত্বেই।
প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ গত কাল পাকিস্তান সম্পর্কে আক্রমণাত্মক মনোভাব নেওয়ার পরে খেলাধুলোর উপরে তার প্রভাব পড়েছে। পাক মহিলা ক্রিকেট দলের আসাই শুধু নয়, ভারতে মহিলাদের ক্রিকেট বিশ্বকাপ হওয়া নিয়েই অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। স্থগিত হয়ে গিয়েছে বয়স্ক পাক নাগরিকদের আসা মাত্র ভিসা দেওয়া চালুর অনুষ্ঠানও। সংশয় তৈরি হয়েছে, দু’দেশের বাণিজ্যিক যোগাযোগ অব্যাহত থাকবে কি না, তা নিয়েও। ২৭ তারিখ পাক বাণিজ্যমন্ত্রী মাখদুম আমিন ফাহিমের দিল্লি আসার কথা ছিল। বাণিজ্য মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, ফাহিম এলেও তিনি শুধু আগরায় আন্তর্জাতিক শিল্প সম্মেলনে অংশ নেবেন। কোনও দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হবে না। কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রী আনন্দ শর্মা জানিয়ে দিয়েছেন, শান্তির পরিবেশেই ব্যবসাবাণিজ্য নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কীসে অর্থনীতির মঙ্গল, পাকিস্তানকেও তা বুঝতে হবে। |
ভারতের কড়া বার্তায় অবশ্য সুর বদলায়নি পাকিস্তান। ভারতীয় সেনাপ্রধান বিক্রম সিংহ ঘোষণা করেছিলেন, আক্রান্ত হলে ভারতও প্রত্যাঘাত করতে তৈরি। আন্তর্জাতিক মহলে এটাকেই আজ যুদ্ধের জিগির বলে দেখানোর চেষ্টা করেন পাক-বিদেশমন্ত্রী হিনা। নিয়ন্ত্রণরেখায় ভারতের দিক থেকে যুদ্ধবিরতির চুক্তি লঙ্ঘনেরও অভিযোগ তোলেন তিনি। হিনার অভিযোগকে নস্যাৎ করে দিয়ে ভারতীয় সেনার দাবি, পাক সেনাই নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে ভারতের জমিতে ল্যান্ডমাইন পুঁতছে। পাকিস্তানের সরকারি কারখানায় তৈরির সিলমোহর-সমেত সেই ল্যান্ডমাইনের ছবিও প্রকাশ করে দেওয়া হয়েছে। দু’দিন আগে পুঞ্চের ফ্ল্যাগ-মিটিংয়ে সেই ছবি পাকিস্তানের হাতে তুলে দেওয়া হয়। পাক-সেনার পাল্টা অভিযোগ, ভারতের গুলিতে এক পাক সেনার মৃত্যু হয়েছে। জবাবে সেনাপ্রধান যুক্তি দিয়েছেন, এমন হয়ে থাকলেও তার জন্য পাকিস্তান দায়ী। ওদের গুলির জবাবেই ভারতকে গুলি চালাতে হচ্ছে। নিয়ন্ত্রণরেখায় উত্তেজনা কমাতে আজও দু’দেশের ডিজি (মিলিটারি অপারেশন)-এর দীর্ঘ সময় ধরে হটলাইনে কথা হয়েছে। উত্তেজনা কমাতে নিজের-নিজের সেনাবাহিনীকে যুদ্ধবিরতি মেনে চলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে দু’পক্ষই। যদিও চাপানউতোরও সমানে চলেছে।
ভারতীয় কূটনীতিকদের এখন ভাবনা, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এবং আশফাক কিয়ানির নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনীর উপরে সে দেশের সরকারের কতটা নিয়ন্ত্রণ অবশিষ্ট রয়েছে? বিশেষ করে সুপ্রিম কোর্টও যেখানে খোদ প্রধানমন্ত্রী রাজা পারভেজ আশরফকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছে দুর্নীতির অভিযোগে। পাক সরকার এ নিয়ে আদালতে পাল্টা আবেদন জানাতে প্রস্তুত হচ্ছে। কিন্তু সমস্যার শেষ নয় সেখানেই। সুন্নি নেতা তাহির-উল-কাদরির নেতৃত্বে এখনও বিক্ষোভ চলছে। বুধবার রাতের মধ্যে সরকারকে গদি ছাড়ার ডাক দিয়েছেন তিনি। ইমরান খানের মতো দেশের অন্য রাজনৈতিক নেতাদেরও রাস্তায় নামার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। তাঁর দাবি, নির্বাচনের আগে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হোক। সেনাবাহিনী সেই সরকারকে সমর্থন করুক। অভিযোগ উঠেছে, কাদরি আসলে সামরিক অভ্যুত্থানের পথ তৈরি করছেন সেনা এবং আইএসআইয়ের মদতে। এই অবস্থায় দিল্লি মনে করছে, রাজনৈতিক কর্তৃত্বহীন নির্বাচিত সরকারের থেকে সামরিক সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা ভাল। হিনা কিন্তু এখনও বলছেন, রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়েও তাঁর সরকার ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক শোধরানোর চেষ্টা করেছিল। এখনও আলোচনার প্রক্রিয়ায় থাকতে বদ্ধপরিকর পাক সরকার। হতাশ করছে ভারতই। |