হুল্লোড় |
মেসি মেস রুম
অগোছালো রুমমেটকে নিয়ে নাজেহাল অবস্থা? আর চুপ থাকা নয়!
রয়েছে আসল দাওয়াই। লিখছেন শতরূপা চক্রবর্তী |
কলেজ লাইফ শুরু। কিংবা পড়াশোনার শেষে চাকরি। নিজের মাটি ছেড়ে দূরে পাড়ি। অচেনা জায়গা। অচেনা বাসায় থাকা। হস্টেল, মেস কিংবা ফ্ল্যাট শেয়ার করে দিন গুজরান। মায়ের আঁচলের তলা ছেড়ে বেরিয়ে নিজেই নিজের অভিভাবক হয়ে ওঠা। ঘুম থেকে উঠে নিজের খাওয়ার জোগান থেকে শুরু করে সব একা হাতে সামলানো। একই ঘরে অচেনা মানুষের সঙ্গে ওঠা-বসা, চলা-ফেরার রোজনামচা। কিন্তু কেমন হবে যদি রুমমেটই হয়ে ওঠে আপনার চক্ষুশূল? কলেজ কিংবা অফিস থেকে ফিরে চক্ষু চড়কগাছ! ঘরদোর এলোমেলো, লন্ডভন্ড! অথচ একই ঘরের অন্য বাসিন্দা ঘুমিয়ে কাদা! এই পরিস্থিতিতে পড়লে ঠিক কী করা উচিত! মাথা ঠান্ডা রেখে বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখা যায়? না কি রাগে ফেটে পড়া ছাড়া উপায় থাকে না কোনও?
|
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল
দমদমের একটি মেসে থাকেন চয়ন। বি কম সেকেন্ড ইয়ার। বরাতজোরে অল্প টাকায় থাকতে পেরে প্রথমে তাঁর আনন্দের শেষ ছিল না। কিন্তু সুখ সয়নি। নিজে পয়-পরিষ্কার থাকেন। বাকি দু’ জন রুমমেটের হাবভাবে রীতিমতো বিরক্ত তিনি। বলছেন, “ওদের জন্য ঘরে টেকা যায় না। চারদিকে সাতজন্মের বাসি জামা-কাপড় ছড়িয়ে রাখে। গোছানোর নামমাত্র চেষ্টা নেই। ঘরে ঢুকে পা ফেলার জায়গা পর্যন্ত পাই না।” আসলে ওরা ছিল বড্ড গোঁয়ার। হাজার বার বুঝিয়ে বললেও শোনেনি কিছুই। বেচারি চয়নকে মেস-বাড়িটি বদলাতে হয়েছিল অবিলম্বে। |
|
একই অবস্থা বরানগরের পৌলমীর। বেঙ্গালুরুতে কর্মজীবনের প্রথম পদক্ষেপে ট্রেনিং নিতে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে সেই একই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। তাঁর অভিযোগ, “সহযোগিতার হাত বাড়ানো তো দূর অস্ত, উল্টে ঘর কী ভাবে নোংরা করা যায় সে ব্যাপারে পারদর্শী ছিল আমার রুমমেটরা।” বিছানার উপর ছড়ানো আগের দিনের খাবারের প্লেট। শুধু তাই নয়, দোমড়ানো বিছানার চাদর থেকে উঁকি মারছে উচ্ছিষ্ট। ল্যাপটপ উল্টে পড়ে আছে। কফির কাপ লুটোপুটি খাচ্ছে। রাত-বিরেতে অকারণ ঘরের আলো জ্বালিয়েই চলছে জম্পেশ ঘুম। বাথরুম নোংরা করে রাখা তাদের প্রিয় কাজ। রান্নাঘরের বেসিন উপচে পড়ছে না-ধোওয়া থালা-বাসনে। রাজ্যের আরশোলা জড়ো হয়েছে সেখানে।
ঠিক সেই ‘ডেলি বেলি’ ছবির তিন ঘরসঙ্গীর কথা মনে করিয়ে দেয়। বার কয়েক বলেও উপযুক্ত ফল না হওয়ায় সোজা ফ্ল্যাটের মালিককে ফোন লাগান তিনি। শেষে মালিক তড়ি-ঘড়ি ছুটে এসে কড়া ব্যবস্থা নিলে সমস্যার সমাধান হয়।
|
তবু মেনে নেওয়া নয়
“ঘর ছেড়ে এত দূর এসে রোজ ঝগড়া-ঝাঁটি ভাল লাগে না,” জানাচ্ছেন মুম্বইতে কর্মরতা রিনি সেন। অশান্তির থেকে ধৈর্য আর সহনশীলতা বজায় রাখতেই পছন্দ করছেন তিনি। তাঁর মনে হয়, একদিন তাঁর রুমমেটরা নিজেরাই ভুল বুঝে অনুশোচনায় ভুগবে। শুধু কয়েকটি ব্যাপারে তিনি যথেষ্ট নিয়ন্ত্রিত। নিজের ব্যবহৃত তোয়ালে কিংবা সাবান ভুলেও হাতছাড়া করেন না। ঘরের এক দিকের অংশে নিজের মতো দিব্যি আছেন তিনি।
কিছু দিন হল কলকাতার এক ব্যাঙ্কিং সংস্থায় চাকরি পেয়েছেন সুজিত বসু। গড়িয়ায় একটি ফ্ল্যাট শেয়ার করেন আর এক জনের সঙ্গে। যিনি পেশায় চিত্রকর। সৃষ্টিশীল এই ভাবুক মানুষটির সঙ্গে থাকতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন সুজিত। সকাল-বিকেল পাল্লা দিয়ে চলে তাঁর মদ্যপান আর ধূমপান। যত্রতত্র ছড়িয়ে থাকে আধ-খাওয়া তরল পানীয়ের গ্লাস। আধপোড়া সিগারেট। শুধু এতেই ক্ষান্ত নন তিনি। দিনের পর দিন স্নান না করে থাকলেও তাঁর বিন্দুমাত্র অসুবিধে হয় না। তা ছাড়া সুজিতের জিনিসপত্র ব্যবহারও চলে জোরকদমে। প্রথম দিকে মুখ বুজে মেনে নিলেও সুযোগ বুঝে টাইট দিয়েছেন সুজিত। পেশাদারি ঘর সাফাইয়ের লোক ডেকে ঘর পরিষ্কার করিয়েছেন। রুমমেটের নামে বিল করে তাঁর হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন। অতঃপর মুখ চুন করে ঘর পরিষ্কার করতে এগিয়ে এসেছে চিত্রকর। |
টিপস |
• ঠোঁটে ছদ্ম হাসি ঝুলিয়ে পরিচ্ছন্ন থাকার জন্য জ্ঞানের ঝুলি উপুড় করুন।
• একবার ব্যবহার করেই ফেলে দেওয়ার জন্য প্লাস্টিকের কাপ-প্লেট কিনতে বলুন। অপরিষ্কার বাসনপত্র জমে থাকার থেকে এ বার রেহাই।
• প্রতি সপ্তাহে একবার একসঙ্গে ডিনারে বসুন। অ্যালকোহলও চলতে পারে। গল্প-গাছা করতে করতে হালকা চালে ঘর পরিষ্কার রাখার ব্যাপারটা বলুন। কাজ হবে।
• সে ঘরোয়া পার্টি করতে চাইলে আগেভাগে ঘর পরিষ্কারের অঙ্গীকার করিয়ে নিন।
• সুযোগ পেলেই হঠাৎ করে তার বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ডের সামনে অপরিষ্কার থাকার ফান্ডা ফাঁস করে দিন।
• অকারণ বেশি জামাকাপড় বা অন্যান্য জিনিস কিনতে দেখলে বারণ করতে পারেন। অতিরিক্ত জিনিস ঘরে রাখলে ঘর নোংরা হতে বাধ্য।
• ফ্ল্যাট বা বাড়ির মালিককে সোজাসুজি নালিশ করুন। ঘর পরিষ্কার রাখা ভাড়াটের প্রধান কর্তব্য।
• অযত্নে পড়ে থাকা তার প্রিয় টি-শার্টকে ঝাড়ন বানিয়ে ফেলুন। তেড়ে উঠলে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকুন। |
|
সহ্যের পারদ চড়ছে
“নরম কথায় যখন চিঁড়ে ভিজছে না, অগত্যা ফেটে পড়া ছাড়া উপায় কী?,” বললেন বিজ্ঞাপন সংস্থায় কর্মরতা চন্দ্রাণী। “এ ক্ষেত্রে একটু আধটু দুষ্টু বুদ্ধির পথ নিলে ক্ষতি নেই,” সাফ জানালেন তিনি। চন্দ্রাণীর রুমমেট আবার পশুপ্রেমী। রাস্তায় কোনও প্রাণীর কষ্ট দেখলে মন গলে যায় তার। অসুস্থ বিড়াল কিংবা কুকুর দেখলে ঘর পর্যন্ত নিয়ে আসাই তার ধর্ম। সারা ঘর জুড়ে উড়ে বেড়ায় কুকুরের লোম। খেতে বসে থালায় যদি কুকুরের লোম পড়ে কার মাথার ঠিক থাকে? শেষের সে দিন রুমমেটকে চটিয়ে ছেড়েছিলেন। ভর-সন্ধেয় রুমমেট ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই নাকের গোড়ায় রুম-ফ্রেশনার স্প্রে করে দিয়েছিলেন অবলীলায়। এতে চৈতন্য ফিরেছিল বেচারি রুমমেটের। পর দিন থেকে শুরু হয়েছিল ঘর সাফাইয়ের কাজে হাত লাগানো।
সোদপুরের শৌভিকও কম যান না কিন্তু। তাঁর রুমমেট আবার পিএইচডি পাঠরত। দিনরাত নেট ঘেঁটে এন্তার প্রিন্ট-আউট নিয়ে চলে তাঁর পড়াশোনা। অগুন্তি কাগজপত্র আর ফাইলের চোটে ঘরের মধ্যে নড়াচড়ার জো নেই। বার বার বলেও যখন কাজ হয়নি,
শৌভিক ঘরে ঢুকেই ফ্যান চালিয়ে দেন। ব্যাস, এক লহমায় সব দরকারি কাগজ এলোমেলো! সেই মুহূর্তে রুমমেটটি রাগে ফেটে পড়েছিল এ কথা ঠিক, তবে তারপর থেকেই শুরু হয়েছিল গোছগাছ। নিয়মমাফিক বই-খাতা আর কাগজপত্র স্থান পাচ্ছিল বুকশেলফ-এ। |
আমার হয়ে রাজই ঘর পরিষ্কারের দায়িত্ব নিত |
সে ছিল আমার স্ট্রাগল-লাইফ। সবে একটু-আধটু শ্যুটিং শুরু করেছি। আমরা বন্ধুরা মিলে থাকতাম রানিকুঠির এক মেসবাড়িতে। রাজ চক্রবর্তী, সৌমেন হাজারি, ম্যাক্স, তাজ, ভজনদা আর আমি। মাঝে মধ্যে বিশ্বনাথও থাকত। সবাই তখন বেকার। রোজগেরে বলতে শুধু আমিই। ঘরদোর খুব নোংরা থাকত। সবাই সব কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখত। পরিষ্কার করব যে সময় কোথায়? সকাল-বিকেল শুধু ছোটাছুটি। আমাদের মধ্যে সব থেকে অপরিষ্কার ছিল সৌমেন হাজারি। কেন জানি না তার গা-হাত-পা খুব চুলকোত! ওর পাশে শুতে পর্যন্ত ভয় করত। আর সব থেকে পরিষ্কার ছিল শিবু (রাজ চক্রবর্তী)। রোজ হাওয়াই চটি ধুতে বসত। আমি যেহেতু একমাত্র রোজগেরে ছিলাম তাই আমায় ক্ষমা করে দিত। আমার হয়ে শিবুই ঘর পরিষ্কারের দায়িত্ব নিত। আমি মাঝেমধ্যে সময় পেলে ঘর গোছাতাম।
রুদ্রনীল ঘোষ |
|
গোড়ায় গলদ
অন্যের বিরক্তির কারণ হচ্ছি? তা নিয়ে আবার মাথাব্যথা করব? দুনিয়ায় এমন মানুষের অভাব নেই। রাগ করে কী হবে? বরং এই ভেবে গর্ব হোক যে আপনি সুস্থ এবং পরিচ্ছন্ন ভাবে বাঁচতে জানেন। আসলে ছোট থেকে যে পরিবারে বড় হয়ে উঠি তার একটা বড় প্রভাব আমাদের মধ্যে পড়ে। অপরিচ্ছন্ন থাকার প্রধান কারণ হিসেবে পরিবারকে দায়ী করা যেতে পারে। এ ছাড়া আছে আলসেমি। তাই নিজের আর পারিপার্শ্বিক পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে এ ধরনের মানুষ কখনওই চিন্তিত নয়। মন থেকে কুঁড়েমি যত দিন না দূর হবে পরিস্থিতি বদলাবে না কখনওই।
এক ছাদের তলায় থাকতে গেলে সকলকেই মানিয়ে চলতে হয়। তবু এ ভাবে ধৈর্যের পরিচয় ক’জন দিতে পারে? সহ্য করতে করতে ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতে বাধ্য। ঠিক তখনই ফোঁস করতে শিখুন। না হলে পরিস্থিতি হাতের বাইরে বেরিয়ে যাবে। |
|