|
|
|
|
লাটসাহেব হুঁশিয়ার |
সুব্রতর আক্রমণ, নারায়ণন অনড়ই |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
ভাঙড়ের ঘটনা নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খোলায় রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনকে কার্যত সতর্ক করলেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। সাংবিধানিক অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলে বৃহস্পতিবার সুব্রতবাবু বলেছেন, উনি রাজ্যপালোচিত কাজ করছেন না।
রাজ্যপালের কথায় মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে বলে মন্তব্য করে তাঁকে সুব্রতবাবুর হুঁশিয়ারি, “আমরা নজর রাখছি। নিয়মিত এ রকম হলে ভাবতে হবে কী করব। এখনই রাজ্যপালের বিরুদ্ধে কোনও কড়া ভাষা ব্যবহার করছি না। এখন হলুদ কার্ড দেখালাম। পরে প্রয়োজন হলে লাল কার্ড দেখাব।”
তবে সুব্রতবাবুর হুঁশিয়ারির পরেও রাজ্যপাল জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি নিজের মন্তব্যে অটল। তাঁর কথায়, “আমি রাজ্যপালের ভাষাতেই কথা বলেছি এবং আমার বক্তব্যে অনড়।”
তাঁর একাধিক বর্ষীয়ান মন্ত্রী ভাঙড়ের ঘটনা নিয়ে মুখ খুললেও গত পাঁচ দিনে এ প্রসঙ্গে একটিও কথা বলেননি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ দিন রাজ্যপালের মন্তব্য নিয়েও কথা বলেননি তিনি। এর আগে আরাবুলের সমর্থনে এগিয়ে এলেও রাজ্যপালের মন্তব্য নিয়ে মুখ খোলেননি শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “রাজ্যপালের মন্তব্যের উপরে কোনও দিনই কোনও মন্তব্য করিনি। আজও করব না।”
কেন প্রকাশ্যে মুখ খুললেন রাজ্যপাল?
মহাকরণ সূত্রের খবর, ভাঙড়ের ঘটনা নিয়ে প্রশাসন নীরব কেন, তা ৮ জানুয়ারি, মঙ্গলবার সিপিএম-তৃণমূল সংঘর্ষের দিনেই স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায়কে টেলিফোন করে জানতে চেয়েছিলেন রাজ্যপাল। স্বরাষ্ট্রসচিবকে তিনি বলেন, ‘আপনারা কী করছেন? সরকারের এখনই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’ সে দিনই রাজ্যপাল ডিজি-কে জানিয়ে দেন, ভাঙড়ের ঘটনায় অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা না-হলে তিনি প্রকাশ্যেই পুলিশের বিরুদ্ধে মুখ খুলবেন। ডিজি কিছু না-বললেও স্বরাষ্ট্রসচিব রাজ্যপালকে জানান, সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে এবং আরও কঠোর অবস্থান নেওয়া হবে। কিন্তু তার পরেও বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘটনা সম্পর্কে সরকার তাদের অবস্থান না-জানানোয় ক্ষুব্ধ রাজ্যপাল বুধবার সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খোলেন। |
|
রবীন্দ্র সরোবরে এক অনুষ্ঠানে রাজ্যপাল। বৃহস্পতিবার। —নিজস্ব চিত্র |
সরকারের এক মুখপাত্র জানান, রাজ্যপালের মনোভাব বুঝলেও স্বরাষ্ট্রসচিব কিংবা ডিজি-র পক্ষে একক ভাবে কোনও পদক্ষেপ করা সম্ভব নয়। তাঁদের মতে, রাজ্যপাল কোনও পরামর্শ দিতে চাইলে সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীকেই দিতে পারতেন। ৮ জানুয়ারি সন্ধ্যায় মহাকরণে বসে চার মন্ত্রী আরাবুল ইসলাম ‘আক্রান্ত’ বলে ঘোষণা করে দেওয়ার পরে পুলিশের পক্ষ থেকে আর কী-ই বা করার থাকতে পারে, এমন প্রশ্নও তুলছেন প্রশাসনের অনেক কর্তা।
প্রশাসন সূত্রের খবর, ভাঙড়ের ঘটনা নিয়ে সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে, বৃহস্পতিবারেও তার কোনও রিপোর্ট রাজভবনে পাঠাতে পারেনি মহাকরণ। কারণ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসন যে প্রাথমিক রিপোর্ট পাঠিয়েছে, তার সঙ্গে বাস্তবের মিল নেই। ওই রিপোর্টে গুলি চালানোর কোনও উল্লেখ নেই। এতগুলি গাড়িতে কারা আগুন লাগাল, তা নিয়েও স্পষ্ট কিছু লেখা হয়নি। এমনকী, সিপিএমের মিছিলে তৃণমূল হামলা চালিয়েছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা যে বয়ান দিয়েছেন, তারও উল্লেখ নেই। শুধু বলা হয়েছে, দু’পক্ষের মধ্যে গোলমালের জেরে অশান্তি ছড়িয়ে পড়ে। আরাবুল যে ঘটনাস্থলে ছিলেন, সে কথাও রিপোর্টে বলা হয়নি। স্বরাষ্ট্র দফতরও এমন রিপোর্ট পেয়ে বিস্মিত! তারা জেলা প্রশাসনকে ফের বিস্তারিত রিপোর্ট দিতে বলেছে। যারা গ্রেফতার হয়েছে, তাদের তালিকাও চেয়ে পাঠিয়েছে।
রাজ্যপালকে রিপোর্ট পাঠাতে না-পারলেও কেন তিনি প্রকাশ্যে মুখ খুললেন তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সুব্রতবাবু। তিনি বলেন, “সংবাদপত্রে দেখলাম, রাজ্যপাল ভাঙড় নিয়ে মন্তব্য করেছেন। যদি এ কথা সত্যি হয়ে থাকে, তা হলে আমি মনে করি, এটা রাজ্যপালোচিত কাজ নয়। এই মন্তব্য উস্কানিমূলক কাজ করবে। রাজ্যপালের বিরুদ্ধে নই আমরা। তাঁর বক্তব্যের বিরুদ্ধে।” সুব্রতবাবু আরও বলেন, “রাজ্যপাল এমন আলটপকা মন্তব্য না-করলেই পশ্চিমবঙ্গের মঙ্গল। নয়তো লোক ভাববে উনি দিল্লির কংগ্রেস সরকার দ্বারা মনোনীত হয়েছেন বলেই এ সব বলছেন।”
কিন্তু আগের রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গাঁধীও তো বামফ্রন্ট আমলে নানা বিষয়ে প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়েছেন। সুব্রতবাবুর জবাব, “তখন সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের মতো ঘটনা ঘটেছিল। এখন কী তেমন কোনও ঘটনা ঘটেছে?”
নারায়ণন বুধবার বলেছিলেন, “আমি নিজেই প্রশাসনের অংশ, তাই বলতে পারি, প্রশাসনের তরফে গাফিলতি রয়েছে।” যার জবাবে সুব্রতবাবুর মন্তব্য, “উনি যদি নিজেকে সরকারের লোক বলে মনে করেন, তা হলে মুখ্যসচিব, অফিসারদের ডেকে জানতে চাইতে পারতেন। প্রকাশ্যে বিবৃতি দেওয়ায় ওঁর ভাবমূর্তি কলুষিত হচ্ছে। নিজেকে সরকারের লোক বলে মনে করলে এ ভাবে প্রকাশ্যে বিবৃতি দেওয়া কি সঙ্গত?”
রাজ্যপাল ভাঙড়ের পরিস্থিতি উদ্বেগজনক বলে মনে করলেও সুব্রতবাবুর বক্তব্য, “রেজ্জাকের সঙ্গে লড়তে গেলে এ রকমই করতে হবে। উনি ক্যানিং, ভাঙড় জুড়ে কোনও দিন অবাধ নির্বাচন করতে দেননি। কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় কী, উনি (রাজ্যপাল) জানেন? রেজ্জাক গত এক বছরে পাঁচটা খুন করেছেন।” যার জবাবে রেজ্জাকের কটাক্ষ, “পুলিশ-প্রশাসনের কাছে কোনও খবর নেই। শুধু উনি জানেন। কারণ, খুনের সময় উনি আমার সঙ্গে ছিলেন।” সুব্রতবাবুর আরও অভিযোগ, “কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা তো জেলায় জেলায় প্রকাশ্যে বিবৃতি দিচ্ছেন একটা খুন হলে পাল্টা পাঁচটা হবে। রাজ্যপাল চাইলে সেই রিপোর্ট পাঠিয়ে দিতে পারি।”
|
হিংসায় উদ্বিগ্ন প্রাক্তনও |
রাজনৈতিক হিংসা তুমুল। আর সেই হিংসায় চিন্তাভাবনা, মন কিচ্ছু থাকে না। হিংসা আর প্রতিহিংসার রাজনীতি আসলে আত্মভক্ষক। তা শুধু শিকারকে গ্রাস করে না, এক সময় শিকারিকেও গিলে ফেলে।
গোপালকৃষ্ণ গাঁধী
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কমলা বক্তৃতা, বৃহস্পতিবার |
প্রশ্ন: এটা কি আজকের পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে বললেন?
উত্তর: হ্যাঁ। বললামই তো, হিংসার রাজনীতি সবাইকে গ্রাস করে। শিকার-শিকারি কেউ রেহাই পায় না।
প্রশ্ন: পরিবর্তনের পর সেই রাজনীতি থেকে পশ্চিমবঙ্গ রেহাই পেল না কেন?
উত্তর: (নীরব হাসি)।
প্রশ্ন: বুধবার রাজ্যপাল এখানে গুন্ডারাজের কথা বলেছেন। আপনি নন্দীগ্রামে হাড়-হিম করা সন্ত্রাসের কথা বলেছিলেন। সবই কি তবে মুদ্রার এ পিঠ আর ও পিঠ?
উত্তর: (হাসি) থাক না!
প্রশ্ন: আপনি বলছিলেন, ট্র্যাজেডিই বাংলার মূল সুর। ট্র্যাজেডি পুনরাবৃত্ত হলে সেটা প্রহসন হয়ে যায়। পশ্চিমবঙ্গ তবে ট্র্যাজেডির শিকার, না প্রহসনের?
উত্তর: (হাসতে হাসতে) এটা আরও বিপজ্জনক প্রশ্ন। এখানে এ সব থাক.... |
|
সুব্রতবাবু এ দিন রাজ্যপালের অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুললেও রাজভবন সূত্রে দাবি করা হচ্ছে, রাজ্যপাল এক্তিয়ার বর্হিভূত কাজ করেননি। তিনি রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান। সংবিধান আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। ফলে সাংবিধানিক প্রধান হিসেবে তিনি কোনও বার্তা দিতেই পারেন। রাজভবনের প্রশ্ন, রাজ্যপাল রাজনৈতিক হিংসার প্রসঙ্গে দলমত নির্বিশেষে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। শাসক দল তা নিজের ঘাড়ে টেনে নিচ্ছে কেন? তা ছাড়া, সংবিধান বলেছে, রাজ্যপাল সরকারের পরামর্শে কাজ করবেন। কিন্তু সরকারের
পরামর্শে কথা বলবেন, এমন কথা লেখা নেই। সর্বোপরি, রাজ্যপাল এক জন নাগরিক। সংবিধান তাঁকেও বাক্ স্বাধীনতা দিয়েছে।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ সুভাষ কাশ্যপও বলেন, “রাজ্যপাল কী বলতে পারেন, কী পারেন না, তার সঙ্গে সংবিধানের কোনও সম্পর্ক নেই। পরিস্থিতির বিচারে তাঁর মন্তব্য যথাযথ কি না, সেটাই প্রশ্ন। তত্ত্বগত ভাবে রাজ্যপালই প্রশাসনের সর্বময় প্রধান। কাজেই এ ক্ষেত্রে তিনি নিজের প্রশাসনের সমালোচনা করছেন।” তবে কাশ্যপ এ-ও বলেন, “আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, রাজ্যপালের উচিত মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলা। দু’জনের কথাবার্তা গোপনীয় বিষয়। প্রকাশ্যে আসে না। তবে রাজ্যপাল হিসেবে প্রত্যেকে নিজের মতো করে ঠিক করেন, তিনি কী ভাবে চলবেন।” কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী দীপা দাশমুন্সির মতে, “রাজ্যপালের সমালোচনা করা মানে সংবিধানের সমালোচনা করা। রাজ্যপালকে কোনও দল নিয়োগ করে না। যিনি এটা বলেছেন, তিনি অশোভন কথা বলেছেন।” কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়া বলেন, “রাজ্যপাল বলেছেন, গুন্ডামি চলছে। মুখ্যমন্ত্রীকে বলব, অবিলম্বে রাজ্যপালের সঙ্গে আলোচনা করুন।” তবে প্রদেশ কংগ্রেস নেতারা দাবি তুললেও রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে এই মুহূর্তে নাক গলাতে চাইছেন না কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীল কুমার শিন্দে। তাঁর বক্তব্য, “আইনশৃঙ্খলা রাজ্যের বিষয়। কেন্দ্রের এর মধ্যে না-ঢোকাই ভাল।” |
|
|
|
|
|