অভিনব কৌশল মাওবাদীদের |
জওয়ানের দেহের মধ্যে ব্যাটারি-সহ বিস্ফোরক
প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায় • রাঁচি |
নিরীহ মৃতদেহ নয়! জীবন্ত বোমা! লাতেহারের জঙ্গল থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য মাওবাদী জঙ্গিদের পাঠানো এই ‘উপঢৌকন’-কে শুধু অভিনব নয়, দেশের জঙ্গি ইতিহাসে নজিরবিহীন বলছেন নিরাপত্তা কর্তারা।
বিস্ফোরক পুরে মানবশরীরকে বোমা বানিয়ে জঙ্গল থেকে শহরের হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছিল জঙ্গিরা। যা প্রথমে বুঝতেই পারেনি সিআরপিএফ-এর তাবড় কর্তারা। ময়নাতদন্তের জন্য লাতেহারের জঙ্গল থেকে হেলিকপ্টারে করে, জঙ্গি হানায় হত সিআরপিএফের মৃত জওয়ানের দেহ এনে কয়েক ঘন্টা রাখা হয়েছিল রাঁচির রাজেন্দ্র মেডিক্যাল ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্স (রিমস)-এর মর্গে। বিস্ফোরণ হলে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু অনিবার্য ছিল। কিন্তু ডাক্তারদের তৎপরতায় শেষরক্ষা হল। অত্যাধুনিক কায়দায় তৈরি করা এই ‘মানব বোমা’ ব্যবহার করার চেষ্টা দেশে এই প্রথম বলেই দাবি পুলিশ কর্তাদের। বোমাটি শেষ পর্যন্ত নিস্ক্রিয় করা হল। কিন্তু তা করতে গিয়ে কার্যত ঘাম ছুটে গেল বম্ব ডিজপোজাল স্কোয়াডের। |
লড়াইয়ের পরে: লাতেহারে সিআরপি বাহিনী। ছবি: পি টি আই |
লাতেহারে সিআরপিএফ ও মাওবাদীদের মধ্যে সংঘর্ষের পর হেলিকপ্টারে করে আহত জওয়ানদের চিকিৎসার জন্য রাঁচিতে নিয়ে আসা হয়। আর বুধবার রাতে নিহত পাঁচ জওয়ানের মৃতদেহও হেলিকপ্টারে করে ময়নাতদন্তের জন্যে নিয়ে আসা হয় রিমসে। রাঁচির পুলিশ জানাচ্ছে, মাওবাদীদের গুলিতে নিহত বাবুলাল পটেল নামে এক সিআরপি জওয়ানের মৃতদেহও হেলিকপ্টারে করে লাতেহার থেকে বুধবার রাতে নিয়ে আসা হয় রিমসের মর্গে। কিন্তু সেই জওয়ানের শরীরকেই যে ‘মানব বোমা’ তৈরি করে দিয়েছে জঙ্গিরা তা জঙ্গল থেকে মৃতদেহ তোলার সময় বোঝা যায়নি। ফলে দেড় থেকে দু’কিলোগ্রাম ওজনের বিস্ফোরক ভর্তি জওয়ানের দেহ হাসপাতালের মর্গে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। বৃহস্পতিবার সকালে হাসপাতালের ডাক্তাররা ময়নাতদন্তের জন্য ওই জওয়ানের ইউনিফর্ম খুলতেই তাঁদের নজরে পরে, জওয়ানের পেটে বেখাপ্পা ধরনের সেলাই।
রিমসের ময়নাতদন্তকারী দলের ডাক্তার, বিনয় কুমার জানান, “মৃতদেহটির নাভির উপর থেকে সোজাভাবে একটানা সেলাই করা ছিল। সাধারণ ভাবে ময়না তদন্তের সময় দুটি সেলাইয়ের মাঝে খানিকটা জায়গা ছাড়া হয়। তা ছাড়া সেলাইয়ের জায়গাতে পোড়া দাগও ছিল।” সব মিলিয়ে ডাক্তারদের সন্দেহ হয়। বিষয়টি রিমসের পক্ষ থেকে সিআরপিএফ-এর মেডিক্যাল ইউনিটকে জানানো হয়। সেই সময় মেডিক্যাল ইউনিটের এক ডিআইজি হাসপাতালে ছিলেন। তাঁকে বিষয়টি প্রথমে জানানো হয়। পরে ওই ডিআইজি এবং রিমসের ডাক্তাররা ময়নাতদন্ত না করার সিদ্ধান্ত নেন। ফের মৃতদেহটি পরীক্ষা করে দেখা যায় দেহের ভিতরে বিস্ফোরক রাখা রয়েছে। |
এই সিআরপি জওয়ানের দেহেই ভরা ছিল বোমা। —নিজস্ব চিত্র |
ঘটনাটি জানাজানি হলে হাসপাতালের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াতে পারে, তাই অতি সাবধানে জওয়ানের দেহটি মর্গের বাইরে নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে এসে একটি খোলা মাঠে রাখা হয়। ঝাড়খণ্ড পুলিশের আইজি সত্যনারায়ণ প্রধান জানান, এত বিস্ফোরক শরীরের মধ্যে পুরে এত সূক্ষভাবে সেলাই করা হয়েছিল যে সুতোয় টান পড়লেই বিস্ফোরণ ঘটতে পারত। ডাক্তারদের জন্যই কোনও বড় বিপদের হাত থেকে রেহাই পাওয়া গিয়েছে। এরপরেই বিস্ফোরক নিস্ক্রিয় করার জন্য চাইবাসা এবং খুঁটি জেলা থেকে দু’টি বম্ব ডিজপোজাল স্কোয়াডের অফিসাররা আসেন। কিন্তু বিস্ফোরক রাখার ধরন দেখে তাঁরা তাজ্জব বনে যান। অনভিজ্ঞতার কারণেই কী ভাবে জওয়ানের দেহ থেকে বিস্ফোরক আলাদা করা যাবে তা বুঝে উঠতে পারেননি বিশেষজ্ঞরা। বিস্ফোরক শরীর থেকে আলাদা করার জন্য বম্ব স্কোয়াডের অফিসাররা দিল্লিতে ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ড (এনএসজি)-র সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সেখান থেকে বিস্ফোরক আলাদা করার কৌশল জানানো হয়।
কীভাবে শেষ পর্যন্ত আলাদা করা গেল বিস্ফোরক? বম্ব ডিজপোজাল স্কোয়াডের অফিসাররা জানিয়েছেন, জওয়ানের পেট কেটে একটি স্টিলের কৌটোর মধ্যে বিস্ফোরক পুরে রেখে দেওয়া হয়েছিল। সেটির সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল একটি ব্যাটারি সংযোগ। আর তার সঙ্গে যুক্ত ছিল একটি ‘প্রেসার রিলিজ ডিভাইস আর ডিটোনেটর’। কোনও ভাবে পেটের সেলাই খুললে চাপ কমত। আর চাপ কমলেই শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটত।
এনএসজি-র পরামর্শ মতো মৃতদেহ থেকে বিস্ফোরক আলাদা করতে প্রথমে মৃতদেহের পেটে অনেকখানি জল ঢোকানো হয়। আর তারপর পেটের মধ্যেই একটি ছোট বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ব্যাটারি থেকে বিস্ফোরক ভর্তি কৌটোর সংযোগ আলাদা করা হয়। এর পরে পেটে কেটে বিস্ফোরকটি বের করে আনা হয়। নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে গিয়ে সেটি ফাটিয়ে বিস্ফোরক নষ্ট করে ফেলা হয়। তবে ব্যাটারি সংযোগ ছিন্ন করার জন্য ছোট ওই বিস্ফোরণের ফলে জওয়ানের পেটের খানিকটা অংশ উড়ে গিয়েছে। বাকি শরীর অবশ্য অবিকৃতই আছে।
গত সোমবার ও মঙ্গলবার লাতেহারের আমুয়াটিকার জঙ্গলে সিআরপিএফ বাহিনীর জওয়ানদের সঙ্গে মাওবাদী জঙ্গিদের তুমুল সংঘর্ষ হয়। ওই ঘটনায় মৃত জওয়ানদের দু’টি দেহ ছিন্নভিন্ন করে বিস্ফোরক ভরে দিয়েছিল জঙ্গিরা। মৃতদেহ উদ্ধার করতে জওয়ানদের সঙ্গে জঙ্গলে ছিলেন স্থানীয় গ্রামবাসীরা। তাঁরা মৃতদেহ দু’টি তুলতেই ‘প্রেসার রিলিজ ডিভাইস’-এর ফলে বিস্ফোরণ ঘটে। দুই গ্রামবাসী ঘটনাস্থলেই মারা যান। পুলিশের অনুমান, এ বারে মাওবাদীরা চেয়েছিল একই জায়গায় বড় ধরনের নাশকতা ঘটাতে।
কারণ তারা জানত মৃতদেহ ময়নাতদন্ত করার সময় সেলাই করা জায়গাটিতে নাড়াচাড়া পড়বেই। আর তখনই ঘটবে বড় ধরনের বিস্ফোরণ। |
|