সকাল দশটার রাজাবাজার এলাকা। চলন্ত বাসের ভিতরেই এক তরুণীর হাত ধরে টানাটানি শুরু করে দিল জনা চারেক মদ্যপ যুবক। উপায় না দেখে চলন্ত বাস থেকেই লাফ দিয়ে নেমে ছুটতে ছুটতে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে পৌঁছলেন ওই তরুণী। জনা কয়েক সহপাঠীকে কোনও মতে ঘটনাটা জানিয়ে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে জ্ঞান হারালেন তিনি।
কলকাতার বুকে দিনের বেলায় আরও এক বার এই ঘটনা শহরের রাস্তায় মহিলাদের নিরাপত্তার অভাবটাকেই ফের বেআব্রু করে দিল। দিল্লির বাসে তরণীকে গণধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় দেশ জুড়ে প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছে, সে প্রতিবাদে গলা মিলিয়েছে কলকাতাও। কিন্তু তার পাশাপাশি কলকাতার বাস, কলকাতার রাস্তাই বা আলাদা কীসে, এ প্রশ্নটাও ক্রমশ জোরালো হচ্ছে।
|
অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য |
এ দিনের ঘটনার পর নিরাপত্তার দাবিতে দুপুর দেড়টা থেকে ঘণ্টা তিনেক এপিসি রোড অবরোধ করেন সায়েন্স কলেজের শতাধিক ছাত্রছাত্রী। তাতে হাজির ছিলেন শিক্ষক-শিক্ষিকারাও। সকলেরই অভিযোগ, সন্ধ্যার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ক্যাম্পাস থেকে বেরোনোর পর প্রায় রোজ দুষ্কৃতীদের অসভ্যতা ও কটূক্তির মুখে পড়তে হয় তাঁদের। সন্ধ্যার পর রাস্তায় বেরোলে রীতিমতো ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। বেশির ভাগ সময়ই দল বেঁধে ফেরেন তাঁরা। সব থেকে বেশি সমস্যায় পড়েন গবেষক-ছাত্রীরা। কারণ, কাজ সেরে বেরোতে তাঁদের অনেক রাত হয়ে যায়। এমনই এক গবেষক-ছাত্রীর বক্তব্য, “রাস্তায় বাস ধরতে দাঁড়ালে কটূক্তি তো শুনতেই হয়, মোটরবাইক নিয়ে এসে গায়ে হাত দেওয়াটাও আকছার ঘটে।” বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল টেকনোলজি বিভাগের শিক্ষিকা মহুয়া ঘোষ বলেন, “সন্ধ্যার পর এই এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় ছিনতাইয়ের ভয়ে ব্যাগ-মোবাইলও সাবধানে রাখতে হয়।” ছাত্র-ছাত্রীদের অভিযোগ, স্থানীয় এক দল যুবক এই ধরনের কুকর্ম করে বেড়ায়। পুলিশ সব কিছু জেনেও কোনও ব্যবস্থা নেয় না। ‘আর মোমবাতি নয়, এ বার কিছু করে দেখানোর সময়’, অবরোধে দাবি তোলেন ছাত্রীরা।
এ দিনের ঘটনাটা ঠিক কী হয়েছিল?
হাওড়ার বাসিন্দা ওই তরুণী রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। সহপাঠীদের তিনি জানিয়েছেন, তিনি হাওড়া থেকে রাজাবাজারগামী একটি বাসে উঠেছিলেন। লেনিন সরণিতে সেই বাসটি খারাপ হয়ে গেলে তিনি অন্য একটি বেসরকারি বাসে ওঠেন। বসেছিলেন মহিলাদের সিটে-ই। শিয়ালদহ স্টেশনের পর বাসটি মোটামুটি ফাঁকা হয়ে গেলে তাঁকে জনা চারেক মদ্যপ যুবক ঘিরে ধরে হাত ও জামাকাপড় ধরে টানাটানি করতে থাকে বলে অভিযোগ। এর পরই শিয়ালদহ ইএসআই হাসপাতালের কাছে চলন্ত বাস থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েন ওই ছাত্রী। রাস্তা দিয়ে ছুটতে ছুটতে কলেজে গিয়ে পৌঁছন।
সায়েন্স কলেজের পড়ুয়ারা জানিয়েছেন, ওই ছাত্রী আতঙ্কে থরথর করে কাঁপছিলেন। বন্ধুদের কাছে ঘটনাটা কোনও রকমে বলে অজ্ঞান হয়ে যান তিনি। অসুস্থ ওই ছাত্রীকে ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয়। খবর দেওয়া হয় তাঁর বাড়িতে। ছাত্রীর বাবা এসে মেয়েকে নিয়ে যান। এ দিন রাত পর্যন্ত পুলিশের কাছে কোনও অভিযোগ জানাননি ওই ছাত্রী। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন। কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (উত্তর) গৌরব শর্মা জানিয়েছেন, ওই অভিযোগের ভিত্তিতেই একটি যৌন
হেনস্থার মামলা রুজু করা হয়েছে। তিনি আরও জানিয়েছেন, অবিলম্বে ওই এলাকায় নিরাপত্তা বাড়ানো হবে। এ দিন বিকেল থেকেই ওই চত্বরে পুলিশি টহলদারি শুরু হয়েছে। |
রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের সামনে ধর্নায় পড়ুয়ারা। বুধবার। —নিজস্ব চিত্র |
দিল্লির ঘটনার পরপরই বাসের ভিতরে হেনস্থার অভিযোগ মিলেছিল কলকাতার ঠাকুরপুকুর ও দমদমে। সেগুলিকে ছাপিয়ে গিয়েছিল বৌবাজারের বো স্ট্রিটের ঘটনা। চলতি বছরের প্রথম দিনেই পথচলতি এক মহিলাকে কটূক্তি করেই ক্ষান্ত হয়নি দুই নেপালি যুবক। পিছন থেকে এসে তাঁর টি-শার্টের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছিল তারা। সে দিন ওই মহিলাই এক দুষ্কৃতীর হাত টেনে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। রাস্তায় উপস্থিত কোনও লোক ওই মহিলার সাহায্যে এগিয়ে আসেননি। যার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে এ দিনও। বাসের কন্ডাক্টর বা যাত্রীরা কেউই রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের ওই ছাত্রীকে সাহায্য করেননি বলে অভিযোগ। এত প্রতিবাদ, এত মিছিলের পরেও শহরের মানসিকতা আদৌ বদলাচ্ছে কি, ফের প্রশ্ন তুলে দিল রাজাবাজারের বাস। |