|
|
|
|
দশ বছর পর বৃদ্ধি সব শ্রেণিতে |
দীনেশের পথ ধরেই রেল ভাড়া বাড়ালেন পবন |
অনমিত্র সেনগুপ্ত • নয়াদিল্লি |
প্রায় দশ মাস আগে যে পদ্ধতিতে রেল ভাড়া বাড়িয়েছিলেন দীনেশ ত্রিবেদী, আজ সেই পথেই হাঁটলেন বর্তমান রেলমন্ত্রী পবন বনশল। কিলোমিটার প্রতি ২ থেকে ১০ পয়সা ভাড়া বাড়ালেন তিনি, এবং বাড়ালেন সব শ্রেণিতেই। তার ফলে দীর্ঘ দশ বছর পরে আবার ভাড়া বাড়ল রেলে। যে ঘোষণার পরে মন্ত্রকের বক্তব্য, এ বার লোকসানের বহর কিছুটা কমবে।
গত কয়েক মাস ধরেই দ্বিতীয় দফার সংস্কার শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। যার অন্যতম লক্ষ্য, সরকারের ঘাড় থেকে ভর্তুকি বাবদ খরচের বোঝা কমানো। সেই সূত্র ধরেই ভর্তুকিতে দেওয়া রান্নার গ্যাস সিলিন্ডারের সংখ্যা বেঁধে দেওয়া হয়েছে, বাড়ানো হয়েছে ডিজেলের দাম। পাশাপাশি খুচরো বিক্রয় থেকে শুরু করে পেনশন-বিমা ক্ষেত্রকে বিদেশি লগ্নির জন্য খুলে দিয়ে অর্থনীতিকে বলীয়ান করার রাস্তায়ও হাঁটছেন। এই পরিস্থিতিতে এবং দীর্ঘদিন পরে রেল কংগ্রেসের হাতে আসায় ভাড়া বৃদ্ধি সময়ের অপেক্ষা ছিল বলেই মনে করছেন রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জনেরা। পবন বনশলও একাধিক বার সেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। শুধু প্রশ্ন ছিল: কবে বাড়বে ভাড়া? বাজেটে না বাজেটের আগেই? |
দূরের পাল্লা |
কলকাতা থেকে |
স্লিপার |
এসি ৩ |
এসি ২ |
এসি ১ |
দিল্লি |
৫১৩
(৪২৬) |
১৩৩০
(১১৮৫) |
১৯৩২
(১৮৪৫) |
৪০৫৫
(৩৯১০) |
চেন্নাই |
৫৬১
(৪৬১) |
১৪৫৫
(১২৮৮) |
২১২৫
(২০২৫) |
৩৬৬৯
(৩৫০৩) |
মুম্বই |
৬২৬
(৫০৮) |
১৬২২
(১৪২৫) |
২৩৮৩
(২২৬৫) |
৪১২২
(৩৯২৫) |
বেঙ্গালুরু |
৬২৬
(৫০৮) |
১৬২২
(১৪২৫) |
২৩৮৩
(২২৬৫) |
নেই |
* ভাড়া বেড়ে হল (বন্ধনীর মধ্যে আগের ভাড়া)। বর্ধিত অংশের পরিষেবা
কর ধরা হয়নি।
• লোকাল ট্রেনে ন্যূনতম ভাড়া হল ৫ টাকা। |
|
গত সোমবার রেলের আর্থিক হাল নিয়ে আলোচনায় বসেছিলেন যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়া ও রেলমন্ত্রী। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি বছরে শুধু যাত্রিভাড়া অংশেই প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হতে চলেছে। দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের শুরু থেকেই সব শ্রেণিতে রেলের ভাড়া বৃদ্ধির জন্য সওয়াল করে আসছিলেন মন্টেক। এই পরিস্থিতিতে তিনি যত দ্রুত সম্ভব ক্ষতি কমানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে প্রস্তাব দেন রেলমন্ত্রীকে। মন্ত্রক জানিয়েছে, তার পরেই আজ ভাড়া বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন পবন। যা চালু হবে আগামী ২১ জানুয়ারি থেকে। রেল মন্ত্রক জানিয়েছে, যাঁরা ইতিমধ্যেই টিকিট কেটে রেখেছেন, তাঁদের কাছ থেকে যাত্রার সময়ে বাড়তি টাকা আদায় করবেন টিকিট পরীক্ষকেরা।
ভাড়া কী হারে বাড়ালেন পবন বনশল? ঠিক যে ভাবে গত ১৪ মার্চ রেল বাজেট পেশ করার সময় ভাড়া বাড়িয়েছিলেন দীনেশ। তবে সব ক্ষেত্রে অঙ্ক এক হল না। দীনেশ যেমন অসংরক্ষিত শ্রেণিতে ভাড়া বাড়িয়েছিলেন কিলোমিটার প্রতি ৩ পয়সা হারে। পবন কিন্তু সেই এই শ্রেণিকে ভাঙলেন শহরতলি (কিমি প্রতি ২ পয়সা) এবং শহরতলি নয় (কিমি প্রতি ৩ পয়সা), এই দুই ভাগে। সাধারণ সংরক্ষিত শ্রেণিতে দীনেশ বাড়িয়েছিলেন কিমি প্রতি ৫ পয়সা হারে, পবন বাড়ালেন ৬ পয়সা হারে। বাতানুকূল শ্রেণিতে দীনেশ বাড়িয়েছিলেন ১০ পয়সা/কিমি (এসি থ্রি), ১৫ পয়সা/কিমি (এসি টু) এবং ৩০ পয়সা/কিমি (এসি প্রথম)। পবন কিন্তু তিনটি শ্রেণিতেই বাড়ালেন প্রতি কিলোমিটার ১০ পয়সা হারে। এর ফলে হাওড়া-দিল্লি রাজধানী এক্সপ্রেসে বাতানুকূল প্রথম, এসি টু ও এসি টি টিয়ারে ভাড়া বেড়েছে যথাক্রমে ১৪৭, ৮৮ এবং ১৫০ টাকা। সেখানে পূর্বার মতো ট্রেনে ওই ভাড়া বৃদ্ধির পরিমাণ যথাক্রমে ১৪৮, ৯১ এবং ১৪৭ টাকা।
এই ভাড়ার তালিকায় কলকাতা মেট্রোকে রাখা হয়নি। রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী জানিয়েছেন, “কলকাতা মেট্রোর ভাড়াকে শহরতলির লোকাল ট্রেনের ভাড়ার সঙ্গে এক সারিতে রাখা হয় না। তাই আজ ওই ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে কোনও কিছু জানানো হয়নি। খুব শীঘ্রই মেট্রোর ভাড়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবে রেল মন্ত্রক।”
যে দীনেশের সূত্র মেনে এ দিন রেল ভাড়া বাড়ালেন পবন, বাজেট পেশের পরেই তাঁকে চাকরি খোয়াতে হয়েছিল। আজ ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে মুখ খুলতে চাইলেন না প্রাক্তন রেলমন্ত্রী। বললেন, “এ বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই।” আর অধীরবাবু বললেন, “দশ বছর ভাড়া না বাড়ায় যাত্রীরা এই বৃদ্ধির জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিলেন। যাত্রীস্বাচ্ছন্দ্য ভাল ভাবে দেওয়া গেলে এই বাড়তি ভাড়া মেনে নিতে আপত্তি করবেন না তাঁরা।”
স্বাভাবিক ভাবেই বিরোধীরা এই
বৃদ্ধি নিয়ে সরব হয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে যিনি এই মন্ত্রকের দায়িত্ব সামলেছেন, সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন বলেন, “ওদের আর কত টাকা চাই? আর কত বাড়াবে?” ফেসবুকে তিনি প্রশ্ন তোলেন, “বাজেটের আগে এ ভাবে ভাড়া বাড়ানো কি নৈতিক ভাবে ঠিক কাজ?” তাঁর পরে কয়েক মাস দায়িত্বে ছিলেন মুকুল রায়। নেত্রীর সুরে সুর মিলিয়ে তাঁর বক্তব্য, “দিল্লিতে লুঠ চলছে।”
একই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, আগামিকাল, বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টায় রেলভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে মিছিল-মিটিং করবে তৃণমূল। বিজেপি-সিপিএমও বর্ধিত যাত্রিভাড়া প্রত্যাহারের পক্ষে সওয়াল শুরু করেছে। বিজেপির সাংসদ রাজনাথ সিংহের অভিযোগ, “এই সিদ্ধান্ত হয় এখনই প্রত্যাহার করা হোক, না হলে বাজেট পর্যন্ত অপেক্ষা করুক কেন্দ্র।” এই সূত্রে প্রশ্ন উঠেছে, আর মাস দেড়েক পরেই যেখানে রেল বাজেট, সেখানে এটুকু সময়ও কেন অপেক্ষা করলেন না রেলমন্ত্রী?
রেলমন্ত্রী জানিয়েছেন, ভাঁড়ারে আর পয়সা নেই। পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, অর্থের অভাবে দৈনন্দিন কাজ আটকে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। তাই যাত্রিভাড়া না বাড়িয়ে পথ ছিল না। পরিসংখ্যান দিয়ে তিনি জানান, “ভাড়া না বাড়ানোয় গত দু’বছরে যথাক্রমে ১ হাজার ৫৯ কোটি (২০০৯-১০), ১৯ হাজার ৯৬৪ কোটি (২০১১-১২) টাকা ক্ষতি হয়েছে। চলতি আর্থিক বছরে যে লোকসানের বহর বেড়ে ২৫ হাজার কোটি হতে যাচ্ছিল।” কিন্তু আজকের সিদ্ধান্তের ফলে কিছুটা ক্ষতি কমবে বলে জানিয়েছে রেল। মন্ত্রক জানিয়েছে, এই সিদ্ধান্তের ফলে চলতি আর্থিক বছরে (বাকি আড়াই মাসে) রেলের ঘরে বাড়তি ১১০০ থেকে ১২০০ কোটি টাকা আসতে চলেছে। আর আগামী আর্থিক বছরে ওই বর্ধিত ভাড়ার হার এক থাকলে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার কোটি টাকা আয় বেশি হবে রেলের। রেলমন্ত্রী থাকাকালীন মমতা যে যাত্রিভাড়া এক রাখতে অন্য খাত থেকে আয়ের যুক্তি দিতেন, তাকে খারিজ করে পবনের বক্তব্য, “ইনপুট কস্ট বা রেল চালানোর খরচ ফি-দিন বাড়ছে। তাই ভাড়াও বাড়াতেই হত।”
রাজনীতির কারবারিরা অবশ্য বলছেন, আগামী লোকসভা ভোটের আগে দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট পেশ হবে এ বছরেই। এখন কঠোর পদক্ষেপ নিলেও ভোটের কথা মাথায় রেখে জনগণের মন পেতে বাজেটে বেশ কিছু জনমোহনী সিদ্ধান্ত নিতে পারে মনমোহন সরকার। তাই তখন ভাড়া বৃদ্ধির মতো অপ্রিয় সিদ্ধান্ত না নিয়ে আগেভাগেই সেই কাজটা সেরে ফেলা যুক্তিসঙ্গত বলে মনে করেছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। পবনও আজ জানিয়েছেন, এর পরে বাজেটে আর ভাড়া বাড়বে না। |
|
|
|
|
|