শিক্ষা হোক শিশুদের মনের মাপে, বলছেন শিক্ষকেরা
নাগরিকদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার সময়সীমা শেষ হতে আর তিন মাসও বাকি নেই। অথচ সরকারি স্তরে এখনও প্রস্তুতির যা হাল, কত ছাত্রছাত্রীকে শিক্ষার আঙিনায় টেনে আনা যাবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। প্রশ্ন উঠছে ইতিমধ্যে চালু থাকা ব্যবস্থার শিক্ষার মান নিয়েও। শুধু পরিমাণ নয়, মানেও কী ভাবে উৎকর্ষ আনা যায় তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু হয়ে গিয়েছে।
এই রকমই কিছু চিন্তা এবং নতুন চেষ্টার কথা উঠে এল সম্প্রতি বোলপুরে প্রতীচী-র বার্ষিক কর্মশালায়। দেখা গেল, আইন অনুযায়ী ৬ থেকে ১৪ বছরের শিশুদের মৌলিক শিক্ষার অধিকার রয়েছে ঠিকই, কিন্তু শিক্ষার মানের দিকটি অনেকটাই উপেক্ষিত রয়ে গিয়েছে।
সম্প্রতি মাধ্যমিক শিক্ষা দফতরের উদ্যোগে রাজ্য জুড়ে সমীক্ষার কাজ চালিয়েছিল ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট (কলকাতা)। তাতে উঠে এসেছে, রাজ্যের প্রাথমিক স্কুলগুলির মাত্র ১৮ শতাংশ পড়ুয়া ৮০ শতাংশের উপরে নম্বর পায়। ৫০ শতাংশের কম নম্বর পায় ২৩ শতাংশ ছাত্রছাত্রী। তৃতীয় শ্রেণির নব্বই শতাংশেরও বেশি পড়ুয়া সহজ বিয়োগ বা ভাগ করতে পারে না। শিক্ষকদেরও মত, ভাল করে বাংলা পাঠ করতে পারে না চতুর্থ শ্রেণির প্রায় ৮০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী।
শিক্ষক ও বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন, এই দুরবস্থার মূল কারণ এক দিকে যেমন শিক্ষক ও পড়ুয়ার মধ্যে ভাষাগত ব্যবধান, তেমনই রয়েছে বিষয়টি প্রাঞ্জল করে পড়ুয়াদের সামনে তুলে ধরার অক্ষমতাও। প্রথম পাঁচিল অবশ্যই ভাষাগত ব্যবধান। শিক্ষক ও পড়ুয়া যদি ভিন্ন ভাষাভাষী হন (ধরা যাক, শিক্ষকের মাতৃভাষা বাংলা, পড়ুয়ার সাঁওতালি) তবে গোড়াতেই বোঝানোর কাজটা দ্বিগুণ কঠিন হয়ে ওঠে। যে কারণে মালদহের গাজলে বাঙালি শিক্ষক জিন্নাত হোসেন নিজের চেষ্টায় সাঁওতালি ভাষা রপ্ত করেছেন। তাঁর যুক্তি, সাঁওতালি শিশুরা যদি নিজেদের মুখের ভাষা না হওয়া সত্ত্বেও বাংলা রপ্ত করতে পারে, তাহলে মাস্টারমশাই-ই বা পড়ুয়াদের ভাষা রপ্ত করতে পারবেন না কেন? তা না পারলে যোগাযোগটাই যে হবে না!
আর এক বড় বিপদ, প্রতিটি শিশুকে এক করে দেখার প্রতিষ্ঠানিক প্রবণতা। একটি শিশুর মনের বাঁক, পারা না-পারা, ভাল লাগা মন্দ লাগা অগ্রাহ্য করে বাঁধা গতে তোতাকে বুলি শেখানোর চেষ্টা করে যাওয়া। অভিজ্ঞ ও সচেতন শিক্ষকদের বেশির ভাগই মনে করছেন, সবার আগে প্রতিটি শিশুকে ‘স্বতন্ত্র ব্যক্তি’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া জরুরি। প্রত্যেকের স্বতন্ত্রতার কথা মাথায় রেখে শেখানোর পদ্ধতিতেও বৈচিত্র্য আনা দরকার। কেননা প্রত্যেকটি শিশুমনের সঙ্গে যথার্থ যোগাযোগ গড়ে তোলার রাস্তা কখনও এক হতে পারে না।
দার্জিলিংয়ের শিক্ষিকা চায়না কুণ্ডু পাল যেমন হাতেনাতে ফল পেয়েছেন খেলনা দিয়ে অঙ্ক শিখিয়ে। তাঁর মতে, ‘শিক্ষণ সামগ্রী’ মানে শুধুই ব্ল্যাকবোর্ড, চক-ডাস্টার নয়। বরং খুব বেশি করে খেলনাও। বিভিন্ন শিক্ষামূলক খেলনা বা ধাঁধা দিয়ে যেমন পড়ুয়াদের অঙ্ক শেখানো যায়, তেমনই পাটকাঠি বা কাচের গুলি ব্যবহার করেও অঙ্কের বিমূর্ত চিহ্নগুলোকে সহজেই বুঝিয়ে দেওয়া যায়। গুণ-ভাগের সাধারণ যুক্তিটুকু ধরিয়ে দিলে সহজেই তা শিখে ফেলতে পারে ছোটরা মত মালদার শিক্ষক সুনীলকুমার চট্টোপাধ্যায়ের।
সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করে, এক সঙ্গে মিলে-মিশে পড়ায় শিশুদের শেখার গতি অনেক বেড়ে যায়। তাই সীমিত সাধ্যের মধ্যেই এমন ব্যবস্থা করতে উদ্যোগী হয়েছেন অনেক শিক্ষক। যেমন স্কুলে যে দিন শিক্ষক কম থাকেন, উঁচু ক্লাসের পড়ুয়াদের নিচু ক্লাসের পড়ানোর সুযোগ দেওয়া হয়। তাতে দৈনন্দিন পড়াশোনার মধ্যে কিছুটা তাজা হাওয়া খেলে যায়।
দক্ষিণ দিনাজপুরের শিক্ষক তরুণ মজুমদার আবার স্কুলে পড়ুয়াদের উপস্থিতি বাড়াতে এক অভিনব পরীক্ষা করেছেন। স্কুলের সামনের জমিতে প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর নামে গাছের চারা পুঁতে দিয়েছিলেন তিনি। পড়ুয়ার দায়িত্ব, নিজের নাম লেখা গাছের দেখভাল করা। তাতে নম্বর মেলার কোনও আশা নেই। কিন্তু শুধু গাছের টানেই তারা রোজ স্কুলে এসেছে। উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে হাজিরা। প্রতীচীর অন্যতম কর্ণধার কুমার রানার মতে, পড়ানোটা শুধু ক্লাসঘরে সীমাবদ্ধ রাখলে তো চলবেই না, অভিভাবকদের সঙ্গে শিক্ষকদের আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠাও প্রয়োজন। অনেক ক্ষেত্রেই পড়ানোর পদ্ধতি ও মান নিয়ে অভিভাবকেরা গুরুত্বপূর্ণ মতামত দেন। শিক্ষকদের একটা বড় অংশ মনে করছেন, সব সময়ে অভিভাবকদেরই স্কুলে আসা আবশ্যক নয়। শিক্ষকদেরও গ্রামে-গ্রামে, বাড়িতে-বাড়িতে যাওয়া দরকার। এই ভাবে ‘বহুস্তরীয়’ পদ্ধতিতেই প্রাথমিক শিক্ষা সর্বজনীন হয়ে উঠতে পারে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.