|
|
|
|
চাল কিনবে কে, প্রশ্ন চাষিদের |
হাতেগোনা চালকল, আসরে নামেনি সমবায় |
প্রশান্ত পাল • পুরুলিয়া |
মুষ্টিমেয় চালকলে ধান বিক্রি করতে গিয়ে নানা সমস্যায় পড়ছেন চাষিরা। এমন অভিযোগ তো রয়েছে। কিন্তু দু’মাস আগে বৈঠক করেও ধান কিনতে জেলার অধিকাংশ সমবায় সমিতিকে এখনও নামাতে পারেনি পুরুলিয়া জেলা প্রশাসন। ফলে রাজ্যের অন্য জেলাগুলির মতো এই রুখাসুখা জেলাতেও চাষিদের ভরসা সেই আড়তদারেরাই।
পুরুলিয়া জেলায় মাত্র ১৪টি চালকল রয়েছে। তার মধ্যে সর্বাধিক তিনটি চালকল রয়েছে হুড়া ব্লকে। সেখানেই খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা গেল চালকলে ধান বিক্রি করতে না পেরে অনেক চাষি আড়তদারদের কাছে সরকার নির্ধারিত সহায়ক মূল্যের কমেই ধান বিক্রি করছেন। পুখুরিয়া গ্রামের চাষি চক্রধর মাহাতোর অভিযোগ, “গত শুক্রবার এক চালকলে ধান নিয়ে গিয়েছিলাম। একটি চালকলের কর্মীরা জানালেন ম্যানেজার নেই। তাই চাল কিনবে না। অন্য একটি চালকলে বলা হল, এখনও চাল কেনার নির্দেশ আসেনি। কয়েক দিন পরে শিবির হবে। তখন কেনা হবে।” তিনি জানান, বাড়িতে টাকার প্রয়োজন থাকায় শেষে চালকলের উল্টো দিকের এক আড়তদারের কাছে ৯৮০ টাকা কুইন্টাল দরে (সরকার নির্ধারিত ধানের সহায়ক মূল্য ১২৫০ টাকা প্রতি কুইন্টাল) ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। স্থানীয় হাতিমারা গ্রামের প্রৌঢ়া সাগরি হাঁসদাও বলেন, “এক জনের কাছে ২০০ টাকা ধার করে নাতিকে হাট থেকে জামা-প্যান্ট কিনে দিয়েছি। ওই টাকা শোধ করতে যেখানেই হোক ধান বিক্রি করতে হবে।” কাশীপুর ব্লকেও চালকল রয়েছে। এই ব্লকের পাড়াশোল গ্রামের চাষি বিশ্বনাথ মাহাতোর কথায়, “কে কিনবে কিছুই জানি না। বরাবর আড়তদারদের কাছেই ধান বিক্রি করা হয়। এ বারও গ্রামে আড়তদারের লোক এসেছিল। কমবেশি ৯০০ টাকা দরে তাঁর কাছেই ধান বিক্রি করেছি।” |
 |
আড়তদারের কাছে চলছে ধান বিক্রি। হুড়ার লালপুরে ছবিটি তুলেছেন প্রদীপ মাহাতো। |
চালকলে চাষিদের ফিরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ শুনে পুরুলিয়া জেলা রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মনোজ ফোগলা বলেন, “এরকম হওয়ার কথা নয়। আমাদের সদস্যদের নির্দেশ দেওয়াই রয়েছে চাষি ধান বিক্রি করতে এলে বিধি মোতাবেক ধান কিনতে হবে।” তিনি জানান, ধানে যদি ১৭ শতাংশের বেশি জলীয় বাষ্প বা ২ শতাংশের বেশি খাদ থাকে, তাহলে চাষিদের সরকারি নির্দেশিকা বুঝিয়ে ধান কিনতে হবে (বিধি মোতাবেক ধানে ১৭ শতাংশ পর্যন্ত জলীয় বাষ্প ও ২ শতাংশ পর্যন্ত খাদ-সহ ধান কেনা যায়)। মনোজবাবু জানান, ওই অভিযোগ সর্ম্পকে তিনি খোঁজ নেবেন। জেলা খাদ্য ও সরবরাহ নিয়ামক সাধন পাঠক এমন অভিযোগ থাকলে চাষিদের খাদ্য দফতরের আধিকারিকদের জানাতে পরামর্শ দিয়েছেন। মনোজবাবু জানান, রাজ্য সরকার এ বার জেলার চালকলগুলিকে ৩০ হাজার টন চালের লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছে। এ জন্য তাঁরা ৪৬ হাজার টন ধান চাষিদের কাছ থেকে কিনতে চান। ডিসেম্বর মাসের মধ্যে প্রায় সাড়ে নয় হাজার টন চাল তাঁরা প্রশাসনকে দিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের কাছ থেকে চাষিরা টাকার পরিবর্তে ‘চেক’ পাচ্ছেন। ফলে যে সব চাষির ধান বিক্রি করে সঙ্গে সঙ্গেই নগদ টাকার প্রয়োজন, তাঁরা চালকলে না গিয়ে আড়তদারদের কাছে ধান বিক্রি করছেন।
বেশি টাকা পেতে অনেক চাষি চেকেও ধানের দাম নিতে রাজি। কিন্তু কাছাকাছি চালকল না থাকায় কিংবা কাছে সমবায় সমিতি থাকলেও, সেখানে ধান কেনা শুরু না হওয়ায় তাঁরা ফাঁপরে পড়েছেন। কবে সমবায়গুলি ধান কিনতে নামতে সেই আশায় তাঁরা ধান ধরে রাখতে চাইছেন না। ঋণ নিয়ে যাঁরা চাষ করেছিলেন, তাঁরা সত্ত্বর ধান বিক্রি করে ঋণ শোধ করতে চাইছেন। এ ছাড়া সংসারের হাজার একটা প্রয়োজনেও টাকার প্রয়োজন চাষিদের। প্রশাসন সূত্রের খবর, ৮ নভেম্বর জেলা প্রশাসন বৈঠক করে ঠিক করে বেনফেডের আওতায় ৭০টি সমবায় সমিতি, অত্যবশ্যকীয় পণ্য নিগমের আওতায় ১৯টি সমবায় সমিতি ও এনসিসিএফের আওতায় ১টি সমবায় সমিতি ধান কিনতে নামবে। দ্রুত সেই কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বেনফেডের আওতাধীন ১০টি সমবায় সমিতি ছাড়া আর কোনও সমিতি এখনও ধান কিনতে নামেনি বলে প্রশাসন সূত্রেই খবর। সমবায়গুলি কেন ধান কিনছে না?
বুধবারই এ নিয়ে জেলার সমবায় সমিতি সমূহের নিবন্ধক ও অন্য আধিকারিকেরা বৈঠকে বসেছিলেন। প্রশাসন সূত্রের খবর, বেশির ভাগ সমবায় প্রশাসনের আধিকারিকদের জানিয়ে দেয়, তাঁদের কাছে ধান কেনার টাকা নেই। সঙ্কট মেটাতে প্রশাসন চালকল মালিকদের সমবায় সমিতিকে আর্থিক সাহায্য করতে বলেছে। মনোজবাবু বলেন, “সমস্ত সমবায়কে সাহায্য করতে গেলে সাত-আট কোটি টাকা দিতে হবে। অত টাকা আমাদের নেই। আমরা বড়জোড় ১০-১২টি সমবায়কে টাকা দিতে পারি।” জেলা সমবায় সমিতি সমূহের নিবন্ধক সুতনুকা চক্রবর্তী বলেন, “ধান কেনার কাজে গতি আনতে আমরা সমবায়গুলিকে নিয়ে বৈঠক করেছি। তাঁরা কিছু সমস্যার কথা আমাদের জানিয়েছেন। বিষয়টি দেখা হচ্ছে।” জেলাশাসক মহম্মদ গুলাম আলি আনসারির আশ্বাস, “সমস্যাগুলি খতিয়ে দেখে, দ্রুত সমবায়গুলির মাধ্যমে ধান কেনার চেষ্টা চলছে।”
যদিও প্রশাসনেই খবর, গত বছর ৭০টি সমবায়কে ধান কিনতে নামানোর লক্ষ নেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত অর্ধেক সমবায় ধান কিনেছিলে। ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ করা যায়নি। দুর্গাপুজোর মতোই পুরুলিয়ার বাসিন্দাদের কাছে মকর পরব বড় উৎসব। নতুন পোশাক কেনা হয়, বাড়িতে ভাল খাবারও রান্না করা হয়। মকর পরবের আগেই তাই চাষিরা ধান বিক্রি করতে চাইছেন। প্রশাসন কি তার আগে ধান কিনতে সমবায়গুলিকে নামাতে পারবে? |
|
|
 |
|
|