কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে দলীয় কর্মীদের হাতে তৃণমূলের প্রবীণ বিধায়ক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের নিগ্রহের স্মৃতি এখনও টাটকা। তৃণমূল ছাত্র পরিষদের (টিএমসিপি) সমর্থকেরা সোমবার অবস্থান-বিক্ষোভ, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে হুমকি দিয়ে ফের বুঝিয়ে দিলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতির দাপাদাপি চলবেই!
টানা ৩ ঘণ্টা অবস্থান-বিক্ষোভ চালিয়ে তাঁদের রাজ্য সভাপতি শঙ্কুদেব পণ্ডার নেতৃত্বে টিএমসিপি সমর্থকেরা নানা প্রশ্নে উপাচার্যের জবাবদিহি চাইলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবার্ষিকী হলে সিপিএম-কে তাদের দৈনিক মুখপত্রের প্রতিষ্ঠা দিবসের অনুষ্ঠান করার অনুমতি কে দিয়েছেন, উপাচার্য সুরঞ্জন দাস তাঁর দফতরে সিপিএম নেতা লক্ষ্মণ শেঠের সঙ্গে কেন কথা বলেছেন, এই প্রশ্নের জবাব চাই টিএমসিপি নেতৃত্বের। সময় ৪৮ ঘণ্টা!
গত এপ্রিলে ভাঙড় কলেজে আরাবুল-কাণ্ডের পরে সেখানে গিয়ে এক জনসভায় শঙ্কুদেব বলেছিলেন, “কলেজে সিপিএম করলে ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে বুঝে নেব!” কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে এ দিনও তাঁর একই রকম রণং দেহি ভাব দেখা গিয়েছে। তৃণমূল সূত্রের খবর, ভাঙড়ে ওই উক্তির পরে শঙ্কুদেবকে ভর্ৎসনা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু শঙ্কুদেব যে তা থেকে শিক্ষা নেননি, এ দিন তিনি তার প্রমাণ দিয়েছেন। |
শঙ্কুদেব এবং সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক তমোঘ্ন ঘোষের নেতৃত্বে টিএমসিপি-র এক দল সমর্থক এ দিন বেলা সওয়া ১১টা নাগাদ কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে হাজির হন। শতবার্ষিকী হল ভাড়া দেওয়া নিয়ে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে ঘণ্টা তিনেক উপাচার্যের ঘরের সামনে অবস্থান করেন তাঁরা। তৃণমূলের পতাকা হাতে স্লোগান দেন।
কেন এই বিক্ষোভ? উপাচার্যের সঙ্গে এক প্রস্ত আলোচনার পরে শঙ্কুদেব জানান, অনেক কলেজের ছাত্র সংসদ আবেদন করলেও শতবার্ষিকী হলে তাদের অনুষ্ঠানের অনুমতি দেওয়া হয়নি। ওই সব কলেজের ছাত্র সংসদ টিএমসিপি-র দখলে। সভাপতির অভিযোগ, ছাত্র সংসদ অনুষ্ঠান করলে রাজনীতি এসে পড়তে পারে, এমন আশঙ্কা থেকেই হল ভাড়া দেওয়া হচ্ছে না বলে জানান কর্তৃপক্ষ। শঙ্কুদেবের কথায়, “অথচ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বিমান বসু ওই হলে অনুষ্ঠান করে যাচ্ছেন। রাজনীতির আখড়া করছেন! পরিবেশ নষ্ট করছেন। এর পরে ওখানে সিটু, কৃষক সভার অনুষ্ঠানও হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সংগঠনগুলি সভা করে কী করে?” টিএমসিপি সমর্থকেরা উপাচার্যের ঘরের সামনেও স্লোগান তোলেন ‘কর্তৃপক্ষের লাল গোলামি’ বন্ধ করতে হবে।
গত ৪ জানুয়ারি শতবার্ষিকী হলে সিপিএমের দৈনিক মুখপত্রের প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠানে ছিলেন বুদ্ধবাবু, বিমানবাবুরা। রাজনৈতিক শিবিরের একাংশের মতে, শঙ্কুদেবদের বিক্ষোভের তাৎক্ষণিক কারণ এটাই। শঙ্কুদেব বলেন, “৪৮ ঘণ্টা সময় দেওয়া হয়েছে উপাচার্যকে। কাদের চেষ্টায় সিপিএম ওই হলে সভা করছে, তার তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।”
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, কয়েকটি কলেজের অনুষ্ঠানে শতবার্ষিকী হল ভাড়া দেওয়ার পরে দেখা যায়, সেখানে চেয়ার ভাঙচুর করা হয়েছে। তাই কলেজের অনুষ্ঠানে হল ভাড়া না-দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর বাইরে বিভিন্ন সংগঠন বা সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে তাঁদের অনুষ্ঠান করেন। সিপিএমের যে মুখপত্রের অনুষ্ঠান নিয়ে তৃণমূলের আপত্তি, গত ৪৭ বছরের মধ্যে দু’এক বছর বাদ দিয়ে প্রতিবারই তাদের প্রতিষ্ঠা দিবসের অনুষ্ঠান হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবার্ষিকী হলে। এমনকী গত বছর, তৃণমূল আমলেও। তা ছাড়া, মুকুল রায়, পূর্ণেন্দু বসু, দোলা সেনের মতো তৃণমূলের নেতানেত্রীরাও বিভিন্ন সময় ওই হলে সভা করেছেন। তখন কেন শঙ্কুদেবরা আপত্তি তোলেননি, প্রশ্ন আধিকারিকদের একাংশের।
একই প্রশ্ন বামেদেরও। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমানবাবুর বক্তব্য, ভাড়া দিয়ে, ‘কশন মানি’ জমা দিয়ে তাঁরা হল নিয়েছিলেন। এখন তা নিয়ে আন্দোলনের অর্থ কী? বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের মন্তব্য, “ভাড়া না-দিলে হল রক্ষণাবেক্ষণ হবে কী ভাবে? আসলে আমরা আব্দুর রেজ্জাক মোল্লার উপরে হামলাকারীদের গ্রেফতারের জন্য ৪৮ ঘণ্টা সময় দিয়েছি। ওঁদেরও একটা ৪৮ ঘণ্টা দরকার ছিল! পিছন থেকে ওঁদের দিয়ে এ সব করানো হচ্ছে। ওঁদের (ছাত্র) দোষ দেখছি না!”
তৃণমূলের কোনও শীর্ষস্থানীয় নেতানেত্রীই এই ঘটনা নিয়ে মুখ খুলতে চাননি। তবে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেন, “আমি উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলব। এ ধরনের ঘটনা ঠেকাতে ব্যবস্থা যা নেওয়ার নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক রং দেখা হবে না।”
ঘটনাচক্রে, এই শতর্বাষিকী হলেই ১৭ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির কনভেনশন রয়েছে আসন্ন সাধারণ ধর্মঘটের সমর্থনে। সিপিআইয়ের শ্রমিক সংগঠন এআইটিইউসি-র সাধারণ সম্পাদক গুরুদাস দাশগুপ্তের কথায়, “গণতান্ত্রিক দেশে যে কোনও হলে তৃণমূল, সিপিএম বা যে কোনও দল অনুষ্ঠান করতে পারে। দিল্লিতে তো আমরা সরকারি হল ব্যবহার করতে পারি। সংসদের অ্যানেক্সিতেও আমাদের সংগঠনের অনুষ্ঠান হয়েছে। শুধু শাসক দলের কথা বলার অধিকার থাকবে, এটা তো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় হয় না!” তৃণমূল অবশ্য এ সব যুক্তি নিয়ে মাথা ঘামাতে নারাজ। বিধানসভা নির্বাচনের আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার বলেছেন, ক্ষমতায় এলে তাঁদের অন্যতম প্রধান কাজ হবে শিক্ষাকে রাজনীতি মুক্ত করা। কিন্তু তৃণমূল সরকারের দেড় বছরের শাসনকালে শিক্ষাঙ্গনে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন আরাবুল-শঙ্কুদেবরা! |