নাটক শেষ। দর্শকেরা বেরিয়ে আসছেন। কলকাতার অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের মঞ্চের বাইরের বারান্দায় তখন নাটক ভাঙা দর্শকের জটলা। নান্দীকারের নাটক ছিল। রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত কথা বলছেন অনেকের সঙ্গে। হঠাৎই তার দিকে এগিয়ে গেলেন অশীতিপর এক বৃদ্ধা। বড়দিনের রাতে কলকাতা তখন ৯ ডিগ্রির আশেপাশে কাঁপছে ঠান্ডায়। ঘড়ির কাঁটাও তখন ন’টা পেরিয়েছে। কলকাতা থেকে প্রায় সওয়া একশো কিলোমিটার দূর থেকে আসা ৭৮ পার করা গৌরী চক্রবর্তীর অবশ্য তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই।
কলকাতার কোনও নাটক ভাল হচ্ছে শুনলে নবদ্বীপ থেকে গাড়ি করে ছেলে বৌমার সঙ্গে কলকাতা ছোটেন গৌরীদেবী। বহুরূপী, নান্দীকার-সহ নানা দলের বেশ কিছু নাটক তিনি এই ভাবেই দেখেছেন। নবদ্বীপে কোনও নাটকের আসরেও তাঁর উপস্থিতি অনিবার্য। গৌরীদেবী বলেন, “ছোট থেকে বাবার বাড়িতে নাটকের পরিবেশে বড় হয়েছি। সেই নজরটা রয়ে গিয়েছে। আমার ছেলেমেয়ে সকলেই নাটকের সঙ্গে যুক্ত।” তাই শীত বা দূরত্ব তাঁর পথের কাঁটা হয় না। কিন্তু সকলেই সে ভাবে পারেন না। ইচ্ছে থাকলেও কলকাতা গিয়ে নাটক দেখা হয় না অনেকেরই। সুপ্রকাশ মিত্র বলেন, “রোজ কলকাতা যাই। কিন্তু নাটক দেখতে হলে লাস্ট ট্রেন ধরতে পারব না। তাই ইচ্ছে থাকলেও যেতে পারি না। স্ত্রীকেও দেখাতে পারতাম না এতদিন।”
সেই পরিস্থিতিটাই বদলে যাচ্ছে নাট্যোৎসবের জন্য। মফস্সলের বিভিন্ন নাট্যদল শুরু করেছে নাট্যমেলা। কারও পাঁচ দিনের। কারও বারো দিনের। সেখানে রাজ্যের সেরা সব সাম্প্রতিক নাটকই থাকছে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, দেবেশ রায়চৌধুরী, গৌতম হালদার, দেবশঙ্কর হালদার থেকে কৌশিক সেনের নাটক দেখা যাচ্ছে নিজের শহরে বসেই। কৃষ্ণনগর, কল্যাণী, রানাঘাট, চাকদহ বা শান্তিপুরে নাট্যোমোদীদের তাই রীতিমতো ভাবনাচিন্তা করতে হচ্ছে, কবে কোন শহরে কোন নাটকটি দেখতে যাবেন তা নিয়ে।
নদিয়ার অন্যতম বড় নাটোৎসবের উদ্যোক্তা কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্রের কিশোর সেনগুপ্ত বলেন, “আমাদের উৎসব নাট্যপ্রেমীদের কাছে দুর্গাপুজোর সামিল।” তাঁর কথায়, “আমাদের এমন কয়েকজন প্রবাসী দর্শক রয়েছেন, যাঁরা দুর্গোৎসবের বদলে আমাদের নাট্যমেলার সময়ে বাড়ি ফেরেন। এমন অনেক মহিলা দর্শক রয়েছেন, যাঁরা তাঁদের সেরা শাড়িটি তুলে রাখেন নাট্যোৎসবের ক’দিন পরার জন্য।” এই উৎসবের উদ্বোধনী দিনে দর্শকদের দেওয়া হয় ফুল। সমাপ্তির দিন দু’টি করে নলেন গুড়ের সন্দেশ।
সারা রাজ্যের সাম্প্রতিক সেরা নাটকগুলি এক সঙ্গে বছরের শেষে দেখতে পাওয়ার প্রভাব পড়ছে স্থানীয় নাটকের উপরেও। ছন্দনীড়-এর পরিচালক এবং অভিনেতা অজয় চক্রবর্তী বলেন, “অসুবিধা কিছুটা হচ্ছে ঠিকই। সারা রাজ্যের বড় বড় দলগুলির বড় বড় প্রযোজনা দেখার পরে স্থানীয় নাটক দেখে আর স্থানীয় দর্শকদের মন ভরে না। কিন্তু তাঁরা বুঝতে পারেন না, কলকাতার দলগুলি পরিকাঠামোগত যে সুযোগ-সুবিধা পান, তা আমরা পাই না।” নবদ্বীপ নাট্যউন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ও নাট্যকর্মী দেবাশিস নন্দী বলেন, “আমরা খুব ভাল দর্শক হয়ে উঠেছি এখন। পরপর অনেকগুলি ভাল নাটক দেখার সুযোগ পাচ্ছি। তাই তুলনা করার বা বাংলা নাটকের সাম্প্রতিক ধরন ও চরিত্রটাও সামনে ফুটে উঠছে। নাটক দেখা শিক্ষিত রুচিবান নাগরিকের বিনোদন। কিন্তু তার প্রভাবে স্থানীয় স্তরে যে ভাল নাটক হবে, তা হচ্ছে না।” বাপি চক্রবর্তী বলেন, “কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া স্থানীয় দলগুলি যতটা উৎসাহ নিয়ে নাট্য উৎসব করে, ততটা উৎসাহ নিয়ে নতুন নাটক করে না।”
শান্তিপুরের কৌশিক চট্টোপাধ্যায় অবশ্য মনে করেন, “ভাল নাটক সর্বদাই ভাল নাটক। স্থানীয় কিছু দল খুবই ভাল নাটক করে। কলকাতায়ও যথেষ্ট কদর পায়। বরং নাটোৎসবের ফলে দলের সকলের একসঙ্গে বসে ভাল নাটক দেখার চোখ তৈরি হয়ে যায়। তাতে সামগ্রিক ভাবে ভাল প্রভাব পড়বে।” |