সরকার ‘পরিবর্তন’ হয়েছে, দুর্নীতি থামেনি।
সুন্দরবনে নলকূপ বসানো নিয়ে বাম আমলে যে দুর্নীতির শুরু, সেই ‘ধারাবাহিকতা’ বজায় রয়েছে বর্তমান সরকারের সময়েও অর্থ দফতরের বিশেষ অডিটে অন্তত এমনটাই ধরা পড়েছে।
সরকারি নথি বলছে, ২০০৯-এর ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১২-এর ফেব্রুয়ারির মধ্যে ১৭টি ব্লকে ৪৩৬টি নলকূপ বসানোর কাজ হাতে নিয়েছিল সুন্দরবন পরিকাঠামো উন্নয়ন নিগম। বরাদ্দ ধরা হয়েছিল ৮ কোটি ৪৮ লক্ষ টাকা। অডিট-দল দেখেছে, ওই কাজ করতে গিয়ে কোথাও ‘জরুরি’ পরিস্থিতি দেখিয়ে দরপত্র ডাকার প্রক্রিয়া এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে, কোথাও সরকারি বিধি অমান্য করে একই লোকের চারটি সংস্থাকে কাজের বরাত দেওয়া হয়েছে, কোথাও আবার নদী তীরবর্তী গ্রামের বদলে পাকা রাস্তার ধারে নলকূপ বসিয়েছে পরিকাঠামো উন্নয়ন নিগম। এর ফলে সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষের কাছে ওই প্রকল্পের সুফল অধরাই থেকে গিয়েছে।
সরেজমিন তদন্ত করতে গিয়ে অডিটররা দেখেছেন, কোথায় কোথায় নলকূপ বসানো হয়েছে সরকারি নথিতে তার বিস্তারিত বিবরণ নেই। বেশ কিছু কাগজে জমির দাগ নম্বরও লেখা হয়নি। কোথাও বা একই জায়গায় দু’টো নলকূপ বসানোর উল্লেখ থাকলেও তার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারেনি উন্নয়ন নিগম। ফলে কোন প্রকল্পে ওই নলকূপগুলি বসানো হয়েছে, তা নির্দিষ্ট ভাবে জানা সম্ভব হয়নি বলে মন্তব্য করা হয়েছে অডিট রিপোর্টে। তদন্তে জানা গিয়েছে, ক্যানিং, কুলতলি, কাকদ্বীপ ও জয়নগরের মতো ব্লকগুলিতে পাকা রাস্তার পাশে নলকূপ বসানো হলেও তার জন্য নৌকা খরচ দাবি করেছেন ঠিকাদারেরা। অডিট রিপোর্ট বলছে, মেটানোও হয়েছে সে টাকা।
সরকারি বিধি অনুযায়ী, দরপত্র চূড়ান্ত করার জন্য ঠিকাদারদের অন্তত ১৪ দিন সময় দেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু সুন্দরবনে নলকূপ বসাতে গিয়ে বহু ক্ষেত্রে ওই নিয়ম এড়িয়ে পছন্দের লোককে কাজের বরাত পাইয়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। |
রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০০৯-এর ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১১-র ডিসেম্বর পর্যন্ত নলকূপ বসাতে পাঁচটি ঠিকাদার সংস্থাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বরাত দিয়েছিল তৎকালীন সুন্দরবন উন্নয়ন দফতর। তার মধ্যে একটি বাদে বাকি চারটিরই মালিক এক ব্যক্তি। রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “এক ব্যক্তির একাধিক ঠিকাদারি লাইসেন্স থাকতেই পারে। কিন্তু কোনও মতেই তাঁকে একই প্রকল্পে কাজ দেওয়া যায় না।”
অর্থ দফতরের বিশেষ অডিটে এ ভাবেই একের পর এক দুর্নীতি সামনে এসেছে। এ ব্যাপারে বাম আমলের সুন্দরবন উন্নয়নমন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, নলকূপ বসানোর দায়িত্ব ছিল সুন্দরবন পরিকাঠামো উন্নয়ন সংস্থা ও জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের উপরে। ওরাই বলতে পারবে ঠিক কী হয়েছে। বর্তমান সরকারের যে সময়ে নলকূপ-দুর্নীতি হয়েছে বলে অর্থ দফতরে রিপোর্ট জমা পড়েছে, সেই প্রাক্তন সুন্দরবন উন্নয়নমন্ত্রী শ্যামল মণ্ডল বলেন, দুর্নীতি যা হয়েছে সব আগের আমলে।
নতুন সরকারে সুন্দরবন পরিকাঠামো উন্নয়ন সংস্থার চেয়ারম্যান, বর্তমান সুন্দরবন উন্নয়নমন্ত্রী মন্টু পাখিরা বলেন, “সবে দায়িত্ব নিয়েছি। দুর্নীতির অনেক কথাই কানে এসেছে। কাউকে ছাড়া হবে না। সচিবের কাছে সমস্ত নথি চেয়ে পাঠিয়েছি।” ওই প্রকল্পে যে অফিসারের দিকে সরকারি অর্থ অপব্যবহারের মূল অভিযোগ, সুন্দরবন পরিকাঠামো উন্নয়ন সংস্থার সেই ম্যানেজিং ডিরেক্টর সুভাষচন্দ্র বসু বলেছেন, নলকূপ বসাতে দুর্নীতি হয়েছে, মনেই করতে পারছি না। সুভাষবাবুর কাজকর্ম নিয়ে দফতরের বিভিন্ন বৈঠকে একাধিক বার সরব হয়েছিলেন সুন্দরবন উন্নয়ন পর্ষদের বর্তমান চেয়ারম্যান, সাগরের তৃণমূল বিধায়ক বঙ্কিম হাজরা। তাঁর বক্তব্য, “আগের মন্ত্রীকেও আমি আমার অসন্তোষের কথা জানিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি কোনও ব্যবস্থা না নেওয়ায় আমিও চুপ করে যাই।” |