দেবজিৎ ভট্টাচার্য • কলকাতা
সুরবেক বিশ্বাস • কলকাতা |
পুলিশের খাতায় তারা এখনও পলাতক। তাদের নামে ঝুলছে আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানা। এহেন ৩২ জন আত্মসমর্পণকারী মাওবাদীর হাতে শনিবার মেদিনীপুরের কলেজ মাঠে হোমগার্ডের নিয়োগপত্র তুলে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মোট ৩৩ জনকে চাকরি দেওয়া হবে বলে তালিকা প্রকাশ করা হলেও এ দিন কলেজ মাঠে আসেনি সুচিত্রা মাহাতো।
সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সুচিত্রা মাহাতো, জাগরী বাস্কে, বাসন্তী টুডুদের মতো কট্টর মাওবাদীরা আত্মসমর্পণ করলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনও মামলাই প্রত্যাহার করা হয়নি। তাদের নামে পুলিশ ও সাধারণ মানুষকে খুন করা এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এখনও বহাল। মামলা চলছে ইউএপিএ আইনে। ফলে এই মাওবাদীদের কী ভাবে হোমগার্ডের মতো নিরাপত্তারক্ষীর চাকরি দেওয়া হল, সেই প্রশ্ন উঠেছে।
সিআইডি-র অতিরিক্ত ডিরেক্টর জেনারেল শিবাজী ঘোষও কবুল করেছেন, “আত্মসমর্পণকারী মাওবাদীদের বিরুদ্ধে একটাও মামলা প্রত্যাহার করেনি সরকার। ওই সব মামলায় জামিনও পায়নি কেউ।” এই পরিস্থিতিতে তাদের হোমগার্ডে নিয়োগ আদতে জটিলতাই বাড়াবে বলে মনে করছেন পুলিশের একাংশ। আইজি (পশ্চিমাঞ্চল) গঙ্গেশ্বর সিংহ বলেছেন, “ওই প্রাক্তন মাওবাদীদের হোমগার্ডের নিয়োগপত্র দেওয়া হচ্ছে। |
|
|
|
|
(বাঁ দিক থেকে) ছেলের সঙ্গে রাজারাম সোরেন, চিরঞ্জীব মাহাতো,
জাগরী বাস্কে, শোভা মান্ডি। হাতে নিয়োগপত্র। শনিবার মেদিনীপুরের কলেজ মাঠে। |
|
সন্দেহ নেই, এতে আইনি জটিলতা তৈরি হয়েছে।” তবে ওই পুলিশকর্তার বক্তব্য, সমাজের মূল স্রোতে ফেরার সুযোগ দেওয়া হবে এই আশ্বাসেই মাওবাদীরা আত্মসমর্পণ করছে। আইনের গণ্ডির মধ্যে থেকে কী ভাবে তা করা যায়, সেই চেষ্টাই চলছে।
স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তার মতে, ওই মাওবাদীরা সকলেই অভিযুক্ত, আইনের চোখে দোষী সাব্যস্ত হয়নি। এর পর সরকার যদি তাদের বিরুদ্ধে মামলা চালাতে না চায়, তা হলে তারা সকলেই বেকসুর হয়ে যাবে। ফলে তাদের চাকরি দিতে অসুবিধা নেই। তা ছাড়া, সরকারি কোষাগার থেকে বেতন দেওয়া হলেও হোমগার্ডের চাকরি সরকারি নয়। হোমগার্ডরা সরকারি সার্ভিস রুলের আওতায় পড়েন না। দীর্ঘ আলোচনার পরেই ওই প্রাক্তন মাওবাদীদের চাকরি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানান স্বরাষ্ট্র দফতরের ওই কর্তা।
কিন্তু রাজ্যের একাধিক পুলিশকর্তার বক্তব্য, আত্মসমর্পণকারী মাওবাদীদের পুনবার্সনের নামে দেশের আইন এড়িয়ে যাচ্ছে রাজ্য সরকার। ওই মাওবাদীদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ থাকলেও আত্মসমর্পণের পরে তাদের গ্রেফতার পর্যন্ত করা হয়নি। সিআইডি-র এক কর্তা বলেন, “শিলদার ক্যাম্পে ২৪ জন ইএফআর জওয়ানকে খুন করে অস্ত্র লুঠ ও সাঁকরাইল থানার ওসি-কে অপহরণের মতো মামলায় সুচিত্রার বিরুদ্ধে এক বছর আগেই চার্জশিট জমা পড়েছে। পুলিশকর্মী পার্থ বিশ্বাস ও সমাজকর্মী সৌম্যজিৎ বসুকে অপহরণ করে খুনের মামলার এফআইআরে নাম আছে জাগরীর।” তা হলে আত্মসমর্পণের পরে পুলিশ কেন তাদের নিজেদের হেফাজতে নেয়নি, সে প্রশ্নও তুলেছেন পুলিশকর্তাদেরই একাংশ।
|
জনজোয়ার: মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভায় মানুষের ঢল। শনিবার মেদিনীপুরে। |
মহাকরণের এক কর্তা বলেন, “আসলে গ্রেফতার করলে ওদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে পেশ করতে হবে। তখন পুরো বিষয়টি চলে যাবে বিচার ব্যবস্থার অধীনে। সরকারের নিয়ন্ত্রণ খাটবে না।” মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের এক অফিসার বলেন, “আত্মসমর্পণের পরে গ্রেফতার করা হলে আর কোনও মাওবাদী ওই পথে এগোনোর সাহস পাবে না। তাই সরকারকে কিছুটা নমনীয় হতেই হয়েছে।” কী ভাবে? স্বরাষ্ট্র দফতর সূত্রে বলা হচ্ছে, ওই মাওবাদীদের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং শারীরিক সক্ষমতা দেখা হয়নি। বাকি সব নিয়ম অন্য হোমগার্ডদের মতোই।
তারা দৈনিক ৩১০ টাকা ভাতা পাবে। কিন্তু মহার্ঘ ভাতা পাবে না। তাদের কোনও পদোন্নতিও হবে না। প্রাক্তন মাওবাদীদের হোমগার্ড করার সিদ্ধান্ত সমর্থন করে ওই অফিসারের প্রশ্ন, “আত্মসমর্পণকারী নাগা জঙ্গিদের নিয়ে বিএসএফের একটা ব্যাটেলিয়ন তৈরি হয়েছে। তা হলে এখানে ‘গেল গেল’ রব উঠছে কেন?”
কিন্তু পুনর্বাসন দিতে গিয়ে আইনকে বলি দিতে হবে? প্রশ্ন তুলেছেন পুলিশকর্তাদের একাংশ। তাঁদের বক্তব্য, সরকারের উচিত ছিল সক্রিয় হয়ে ওই মাওবাদীদের বিরুদ্ধে মামলাগুলির নিষ্পত্তি করা। এবং যত দিন তা না হয়, তত দিন তাদের সঙ্গে আইন মোতাবেক আচরণ করা। এক পুলিশকর্তার কথায়, “ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা কিংবা ছত্তীসগঢ় তো আইনের পথে হেঁটেই আত্মসমর্পণকারী মাওবাদীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছে। ঝাড়খণ্ড হাজারিবাগে ১০০ ঘরের পৃথক মুক্ত কারাগার তৈরি করেছে। ওড়িশার সম্বলপুরেও তৈরি হয়েছে এমন জেল।
ত্রিপুরায় যেখানে আত্মসমর্পণকারী জঙ্গিদের রাখা হয়েছিল, সেই এলাকাকে রাজ্য মুক্ত কারাগার হিসেবে ঘোষণা করেছিল। কিন্তু এখানে তেমন কিছু করা হয়নি।”
কোথায় আছে আত্মসমর্পণকারী মাওবাদীরা? পুলিশ লাইনের নিরাপদ আশ্রয়ে। পুলিশি পরিভাষায় ‘সেফ হাউস’। কেমন সেই নিরাপদ আশ্রয়? সরকারি সূত্র বলছে, শনিবার পর্যন্ত ৪০ জন মাওবাদী আত্মসমর্পণ করেছে। অধিকাংশকেই রাখা হয়েছে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ও পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ লাইনে অস্থায়ী ঘরে। বিজয় সিংহ সর্দার ও মৌমিতা পাহাড়িয়া আছে পুরুলিয়ায়, বাঁকুড়ায় রাখা হয়েছে বুদ্ধদেব মাহাতো ও বাসন্তী টুডুকে। তারা বাহিনীরই রান্না করা খাবার খায়, বাড়ির লোকজন নিয়মিত দেখা করতে আসে তাদের সঙ্গে। এমনকী, হাটে-বাজারে যেতে হলে পুলিশি পাহারায় সেই অনুমতি মেলে অনায়াসেই।
দু’-এক জনকে আবার ভিন্ন দরের মর্যাদা দিয়েছে রাজ্য। যেমন সুচিত্রা মাহাতো। ২০১১-এর মার্চে বিনপুরের জঙ্গলে যৌথ বাহিনীর গুলিতে স্বামী শশধরের মৃত্যুর পর কিষেণজির ছায়া-সঙ্গী হয়ে ওঠে সুচিত্রা। প্রশাসনের একটি সূত্র বলছে, আত্মসমর্পণের পর তাকে কলকাতায় একটি ঘর ভাড়া করে দেয় পুলিশ। সেখানেই সে তার বর্তমান স্বামী প্রবীর গড়াইয়ের সঙ্গে থাকে। গত পুজোয় সুচিত্রা লালগড়ে তার শ্বশুরবাড়িতেও গিয়েছিল বলে সরকারি সূত্রের খবর। একই ভাবে জাগরী বাস্কেরও গ্রামের বাড়িতে যেতে কোনও বাধা নেই। তাঁর স্বামী, প্রাক্তন মাওবাদী স্কোয়াড নেতা রাজারাম সোরেন ও ছয় বছরের ছেলেকে নিয়ে কখনও কলকাতা, কখনও পশ্চিম মেদিনীপুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে জাগরী।
কিন্তু পুলিশেরই একাংশ বলছে, নিরাপদ আশ্রয়েরও কোনও সংজ্ঞা হয় না পুলিশি অভিধানে। রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, পুলিশ যে বইটিকে বেদ বলে মানে, সেই ফৌজদারি কার্যবিধির (সিআরপিসি) কোথাও ‘সেফ হাউস’-এর অস্তিত্ব নেই। তা হলে কীসের ভিত্তিতে আত্মসমর্পণকারী মাওবাদীদের দিনের পর দিন ‘সেফ হাউস’-এর নামে নিজেদের হেফাজতে রাখছে পুলিশ। জবাব এড়িয়ে গিয়েছেন মহাকরণের পুলিশ-কর্তারা।
মাওবাদীদের যে ভাবে আদরযত্নে রাখা হয়েছে, তাতে নিহত ইএফআর জওয়ানদের আত্মীয়দের মনেও ক্ষোভ জন্মেছে। তাঁদের এক জন, রোশনকুমার মল বলেন, “আমার পিসেমশাই অর্জুন সিংহ ঠাকুরি শিলদায় মাওবাদীদের হাতে খুন হন। তাদের ব্যাপারে কড়া মনোভাবই নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু হচ্ছে উল্টোটাই।”
|
প্রকৃত অবস্থা |
ঝাড়গ্রামে ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট |
শীঘ্রই গড়া হবে |
৬-৭ বছর ধরেই চলছে |
জঙ্গলমহলে ৩ কলেজ |
কাজ চলছে |
১টির শিলান্যাস হয়েছে,
১টিতে কিছু কাজ, ১টি শুরু হয়নি |
৬টি সুপার-স্পেশালিটি হাসপাতাল |
৬টি সরকারি হাসপাতালে হচ্ছে |
কিছুই হয়নি |
|
নিমপুরায় আইটি পার্ক |
শীঘ্রই হবে |
জমি চিহ্নিত
হয়ে আর এগোয়নি |
আইটিআই-পলিটেকনিক |
২৩টি আইটিআই হবে।
প্রতি মহকুমায় পলিটেকনিক |
১৯টি ব্লকে জমির কথা রাজ্যকে জানানো
হয়েছে। পলিটেকনিক নিয়ে কিছুই হয়নি |
ঝাড়গ্রামে ২টি মিনি ইন্ডোর |
কাজ চলছে |
১ম দফায় সামান্য কাজ।
২য় দফায় বরাদ্দ মেলেনি |
৬৭টি ৫০ শয্যার হস্টেল |
হস্টেল তৈরি করা হচ্ছে |
৮টির কাজ শেষ। ২০টির সবে টেন্ডার |
|