আমার নাম ফিনা। আমার জন্ম সমুদ্রের ধারে তাই আমি সমুদ্রকে বড্ড ভালবাসি। খুব মজা করেই ছিলাম আমরা। আমি, আমার মা, বাবা আর বেশ কিছু আত্মীয়স্বজন মিলে। আমরা যেখানে থাকি সেখান থেকে দূরে জেলে পট্টি দেখা যায়। আমি যখন খুব ছোট, তখন ওরা কী করে বুঝতে পারতাম না। মাকে জিজ্ঞেস করতে মা বললেন, ‘ওরা মাছ ধরে জাল ফেলে!’ আমি চোখ বড় বড় করে দেখতাম ওদের কাজ। নুলিয়াদেরও দেখতাম ঝিনুক কুড়োতে। শান্তির জীবন ছিল আমাদের।
খুব খেলাধূলা করতাম সারাদিন ধরে। হঠাৎ এক দিন দেখি সমুদ্রের ধারে একটা বড়সড় বাড়ি হয়েছে। আমি আবার মাকে প্রশ্ন করলাম, ওটা কী মা?
মা দেখেশুনে বললেন, ‘ওটা তো একটা রিসর্ট হচ্ছে!’
রিসর্ট কী মা?
‘ওটা হোটেলেরই মতন, কিন্তু খুব বিলাসবহুল। সমুদ্রের তীরে যারা বেড়াতে আসবে তারা থাকবে।’
ও। আমার মতন বাচ্চারা আসবে মা? আমি তাদের সঙ্গে খেলতে পারব?
‘ফিনা, তোমাকে কত বার বলেছি না অচেনা লোকেদের সঙ্গে কথা বলবে না! কার মনে কী অভিসন্ধি আছে বলা তো যায় না!’
অভিসন্ধি কী মা?
‘কার মনে কী মতলব আছে।’
ও! একটু দমেই গেলাম আমি। |
বাচ্চারা সব আসবে, খেলাধুলো করবে অথচ আমার তাদের সঙ্গে খেলার অনুমতি নেই! (‘অনুমতি’ কথাটা মা আগেই শিখিয়েছেন তাই মানেটা জানি!) জেলেদের বা নুলিয়াদের বাচ্চাদের সঙ্গেও খেলতে দেন না মা আমাকে। মাঝে মাঝে খুব রাগ হয় আমার। আমাদের আত্মীয়দের মধ্যে বা আশপাশে আমার বয়সের কেউ নেই। সব হয় বড়, নয়তো এক্কেবারে পুঁচকে! তাদের সঙ্গে খেলে কোনও মজা নেই।
কিছু দিন বাদেই রিসর্টটা চালু হয়ে গেল। শহর থেকে অনেক লোক আসে ওখানে থাকতে। তাদের বাচ্চারা নানা রকম খেলনা নিয়ে খেলে। আমার ভারী লোভ হয়, ইচ্ছে করে ওদের সঙ্গে খেলি, কিন্তু উপায় নেই। মা’র কথা তো আর অমান্য করা যায় না।
কী সুন্দর সুন্দর জামা পরে থাকে সবাই! ঝলমলে রংচঙে। ওই রকম জামা আমাদের এখানে কারও নেই। আমি হাঁ করে তাকিয়ে থাকি, লুকিয়ে লুকিয়ে দেখি! মাঝে মাঝে মাকে এটা সেটা জিজ্ঞেস করি আর মা বলেন, ‘ফিনা, অত কৌতূহল ভাল নয়! আমরা যেমন আছি তেমনই ভাল!’
আর একটা জিনিস লক্ষ করলাম। রিসর্টে যারা আসে অনেকেই বালিতে নানা রকম জিনিস ফেলে দিয়ে চলে যায়। প্লাস্টিকের প্যাকেট, খালি বোতল, ছাতা, এমনকী খেলনা পর্যন্ত! বড়রা দেখেই রেগে যান, বলেন, ‘এই উপদ্রব শুরু হল!’
তবে আমি উপদ্রব মানে ঠিক বুঝি না। এক বার সমুদ্রতটে কেউ যখন ছিল না, তখন আমি চুপি চুপি গিয়ে একটা খেলনা তুলে নিয়ে চলে এলাম! মা’র তার পর সে কী বকুনি আমাকে ‘কেন তুলে এনেছ খেলনা? অন্য কারও জিনিস না জিজ্ঞেস করে নিতে নেই জানো না? তা ছাড়া ওটা থেকে যদি কোনও অসুখবিসুখ আসে, তখন কী হবে?’
আমি মাথা নিচু করে বকুনি শুনলাম। সত্যি অসুখের কথা আমি একদম ভাবিনি! যা-ই হোক, বকার পর মা খেলনাটাকে ভাল করে ধুয়েটুয়ে দিলেন। তখন আমার ফুর্তি পায় কে! আমি সেটা নিয়ে খুব মজা করলাম। অন্য পুঁচকেগুলোও দেখতে পেয়ে ছুটে এল খেলার জন্যে। আমি তাদেরকেও খেলতে দিলাম। সবার সঙ্গে মিলেমিশে খেলতে হয় মা শিখিয়েছেন যে!
সেই রকমই এক দিন আমি ছোটদের সঙ্গে ওই খেলনাটা নিয়ে খেলছি এমন সময় দেখি মা! মা’র মুখটা দেখে চমকে উঠলাম! মা’র মুখ ওই রকম কেন?
আমি ভীষণ ভয় পেয়ে মা’র কাছে ছুটে গেলাম, ‘মা, তোমার কী হয়েছে?’
মা অনেক কষ্টে বললেন, ‘আমার শরীরটা একদম ভাল লাগছে না রে ফিনা!’
এ বার সত্যি ঘাবড়ে গেলাম। পুঁচকেগুলোও ভয় পেয়ে খেলা ছেড়ে পালাল। বাবা আর অন্য আত্মীয়রা কোথাও গিয়েছেন। এখনই মা’র শরীর খারাপ হয়েছে, আমি কী করব ভাবছি। মা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন অথচ আমি কিছুই করতে পারছি না। এত অসহায় লাগছিল নিজেকে যে কী বলব!
হঠাৎ দেখতে পেলাম সমুদ্রের ধারে দুটো ছোট ছেলেমেয়ে খেলা করছে। নাহ্, আর চুপ করে থাকা যাবে না। যে যাই বলুক রিসর্টে যারা আছে তাদের সাহায্যই নিতে হবে!
ভয় পেয়ো না মা, আমি আছি। আমি একটা কিছু করবই! বলে আমি এগিয়ে চললাম বাচ্চাগুলোর দিকে।
মা যন্ত্রণার মধ্যেও ডেকে বললেন, ‘যেয়ো না ফিনা, ওরা কী করবে তার ঠিক নেই!’
কিন্তু ওই প্রথম আমি মা’র কথা অগ্রাহ্য করলাম! বাচ্চাগুলো কত আর খারাপ হবে ভেবে আমি ওদের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। মাও এলেন আমার পিছন পিছন!
মেয়েটাই প্রথমে আমাকে দেখতে পেল। ও ছেলেটার হাত ধরে টেনে বলল, ‘এই প্রিন্স ওই দেখ!’
ওদের মুখে হাসি দেখে ভরসা পেলাম আমি। সাহস করে বললাম, ‘তোমরা আমাদের সাহায্য করতে পারবে? বাড়িতে আর কেউ নেই আর আমার মা’র খুব শরীর খারাপ!’ বলে আমি মা’র দিকে ইশারা করে দেখালাম।
মাকে দেখেই ওরা বুঝতে পারল মা’র শরীর খারাপ। ওরা যে কিছু করতে পারবে না আমি জানতাম। ওরা তো আর ডাক্তার নয়, নেহাতই বাচ্চা! আমাকে ওরা বলল, ‘আমাদের নাম পিঙ্কি আর প্রিন্স। তুমি দাঁড়াও আমরা সাহায্যের জন্যে লোক ডেকে নিয়ে আসছি।’
তার পর ওরা পাঁই পাঁই করে ছুটে ভিতরে চলে গেল। একটু পরেই ফিরে এল দু’তিন জন লোককে সঙ্গে নিয়ে।
লোকগুলো ধরাধরি করে মাকে নিয়ে চলল। আমি হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার চোখে জল এসে গেল।
পিঙ্কি আর প্রিন্স আমার কাছে এসে বলল, ‘ভয় পেয়ো না! আমাদের বাবা ডাক্তার। তোমার মা খুব তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে যাবে।’
ওদের সরল হাসি মুখ দেখে আমার ভয়টা কিছুটা কমল। আমিও ওদের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। ব্যস, সেই থেকেই পিঙ্কি আর প্রিন্স আমার প্রাণের বন্ধু হয়ে গেল! মা ভাল হয়ে যাবেন জেনে নিশ্চিন্ত হয়ে আমি ওদের সঙ্গে খেলা জুড়ে দিলাম। কী মজাটাই না হল!
বাবা আর আত্মীয়স্বজনরা যখন ফিরে এলেন তখন সবাই একটু রেগেই গিয়েছিলেন আমার উপর, পাকামি করার জন্যে।
বুড়ো দাদু কিন্তু বললেন, ‘ও ছোট বাচ্চা, ওকে দোষ দিয়ে লাভ নেই!
আমরা কেউ ছিলাম না তাই ও ওর বুদ্ধিতে যা পেরেছে তাই করেছে। এখন দেখা যাক কী হয়।’
এক দিন, দু’দিন, তিন দিন করে পুরো এক মাস লেগে গেল মা’র সেরে উঠতে। পিঙ্কি আর প্রিন্স অবশ্য আমাকে রোজ মা’র খবর দিত। ওর মা-বাবাও এসে আমার সঙ্গে কথা বললেন আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে। হাসপাতালে বাচ্চাদের যাওয়ার নিয়ম নেই বলে আমি গিয়ে মাকে দেখতে পারতাম না। আর অন্যরা কেউ রিসর্টের লোকজনদের বিশ্বাস করে না তাই গেল না।
মা যে দিন ফিরলেন সে দিন আমার যে কী আনন্দ হল বলে বোঝাতে পারব না। মাকে জড়িয়ে ধরলাম খুশিতে। মাও আমাকে দেখতে পেয়ে আদর করে হেসে বললেন, ‘ভাগ্যিস, তুমি বুদ্ধি করে বাচ্চাগুলোকে বলেছিলে, না হলে আমাকে আর বেঁচে ফিরে আসতে হত না! ওদের হাসপাতালের মতন ব্যবস্থা আমাদের মোটেই নেই! তবে কী, ওরা বলল আমার রোগটাও অবশ্য এসেছিল ওদের জন্যেই!’
আমি এখন সুখেই আছি মা-বাবার সঙ্গে। পিঙ্কি আর প্রিন্স শহরে ওদের বাড়িতে ফিরে গিয়েছে ওদের স্কুল খুলে গিয়েছে বলে। সামনের বছর আবার আসবে, তখন আবার ওদের সঙ্গে খেলব।
প্রিন্স আর পিঙ্কিই আমার এই গল্পটা তোমাদেরকে বলতে বলেছে, যাতে তোমরা সমুদ্রের তীরে প্লাস্টিক, বোতল, খেলনা ইত্যাদি সব না ফেলো। আমার মা প্লাস্টিকটাকে মাছ ভেবে খেয়ে ফেলেছিল বলেই তো তার ওই দশা হয়েছিল।
প্লাস্টিক কেন খেয়েছিল? ওই তো বললাম না মাছ ভেবে! প্লাস্টিক বোতল ইত্যাদিগুলোকে অনেক সময় মাছের মতন দেখতে লাগে আমাদের। আর মাছ তো আমাদের সব চেয়ে প্রিয় খাবার! আমরা তো সব সময় মাছই খাই। তোমাদের মতন রান্না করেও খাই না, এমনই কাঁচাই খাই।
কাঁচা মাছ কেন খাই বুঝতে পারলে না?
ও হো, আসল কথাটাই তো তোমাদের বলা হয়নি। আমরা তো আর তোমাদের মতন মানুষ নই! আমরা তো শুশুক, মানে যাদের ইংরেজিতে বলে ডলফিন। |