|
|
|
|
নন্দীগ্রামের পথে |
জনজোয়ারে বন্দি কনভয় ছেড়ে মোটরবাইকে বুদ্ধ |
আনন্দ মণ্ডল • চণ্ডীপুর |
তাঁর সরকারের বিদায়পথ এঁকে দিয়েছিল নন্দীগ্রাম। চার বছর বাদে শনিবার সেই নন্দীগ্রাম-সংলগ্ন চণ্ডীপুরে সভা করতে এসে জনজোয়ারে আটকে পড়লেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। শেষ পর্যন্ত গাড়ি থেকে নেমে মোটরবাইকে চেপে সভাস্থলে পৌঁছতে হল তাঁকে। সভায় শিল্পায়নের পক্ষে সওয়াল করে তিনি বললেন, নন্দীগ্রামকে আমরা দ্বিতীয় হলদিয়া করতে চেয়েছিলাম।
কৃষকসভার সমাবেশে মানুষের ঢল দেখে বুদ্ধবাবু, রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র-সহ সিপিএমের নেতারা উচ্ছ্বসিত। জেলায় দিনের পর দিন আক্রান্ত হয়ে এ বার তৃণমূলকে পাল্টা চ্যালেঞ্জের সুর তাঁদের কণ্ঠে। তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য এই ভিড়কে গুরুত্ব দিতে নারাজ। মুকুল রায়ের কথায়, “ভিড় হয়েছে তো কী হল? সিপিএম একটা সভা করেছে। লোক এসেছে। এটাকে কোনও গুরুত্ব দিচ্ছি না।” তাঁর পাল্টা দাবি, এ দিন পশ্চিম মেদিনীপুরে মুখ্যমন্ত্রীর সভায় লক্ষ মানুষের ভিড় হয়েছে। আর তমলুকের সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী জানিয়েছেন, তিনি মেদিনীপুরে ছিলেন। তাই কত লোক সমাগম, তা নিয়ে কিছু বলতে পারবেন না। |
|
বুদ্ধ-বাহন। শনিবার। —নিজস্ব চিত্র |
রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেরই প্রশ্ন, তিন বছরের মধ্যে কী এমন হল যে, বুদ্ধবাবুর সভায় এত লোক হল? তা হলে কি পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে আবার নতুন কোনও পরিবর্তনের ইঙ্গিত? বিশেষ করে বুদ্ধবাবুই যখন পঞ্চায়েত ভোটের প্রচারে সিপিএমের অন্যতম প্রধান মুখ। মঞ্চে বুদ্ধবাবু বলেন, “রাস্তায় আসার পথে এত মানুষের ভিড় যে, মিটিংয়ে এসে পৌঁছতে পারব কিনা, বুঝতে পারছিলাম না। কত হুমকি হয়েছে। কত ভয় দেখিয়েছে ওরা (তৃণমূল)। বাধা দিয়েছে। তার পরও এই বিশাল জমায়েত ওদের জবাব দিয়েছে।” সূর্যবাবুর কটাক্ষ “ভিড়ের জন্য তৃণমূলকে ধন্যবাদ। ওরা হম্বিতম্বি না করলে এত মানুষ হত না।”
সভায় কত লোক হয়েছিল? জেলার নেতা অশোক গুড়িয়া (ইনিও দীর্ঘ দিন জেলে ছিলেন) দাবি, লক্ষাধিক লোক হয়েছে। পুলিশ বলছে, লোক ১৫ হাজার। এলাকার বাসিন্দাদের বক্তব্য, ওই মাঠ ঘিরে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ ছিল। পঞ্চায়েত ভোটের আগে সিপিএমের এই বিপুল সমাবেশ কি তাৎপর্যপূর্ণ নয়? মানতে চাননি মুকুলবাবু। তাঁর দাবি, “পূর্ব মেদিনীপুরে এখনও তৃণমূল এগিয়ে রয়েছে। গুটিয়ে রয়েছে সিপিএম।”
নন্দীগ্রামের আন্দোলনের প্রভাবে জেলায় সিপিএম কার্যত মুছে গিয়েছিল। পঞ্চায়েত ভোট, নন্দীগ্রামের উপ-নির্বাচন, লোকসভা, বিধানসভা কোনও ভোটেই তারা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। সব শেষে লক্ষ্মণ শেঠের জেল-যাত্রা। তার পরেও এই সমাবেশে আশার আলোই দেখছেন সিপিএম নেতারা। বুদ্ধবাবুও তাঁর বক্তৃতায় নন্দীগ্রাম আন্দোলনের প্রসঙ্গ তুলে মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন নিজের সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা দেন। শিল্পায়নের পক্ষে সওয়াল করার পাশাপাশি তিনি অভিযোগ করেন, রাজ্য সরকার জমি নেবে না বলে প্রচার করার পরেও নন্দীগ্রামে তৃণমূল আর মাওবাদীরা এক জোট হয়ে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলিচালনার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “আমি চাইনি পুলিশ গুলি করুক। আমি মাওবাদীদের ঠেকাতে চেয়েছিলাম। পরে ভেবে দেখলাম এ ভাবে পুলিশ না-গেলেও চলত।” তৃণমূল ক্ষমতায় আসার দেড় বছর পরে নন্দীগ্রাম যে সেই পুরনো দুর্বল নন্দীগ্রামেই পড়ে আছে, তা জানিয়ে বুদ্ধবাবু দাবি করেন, “নন্দীগ্রামে মানুষ এখন আস্তে আস্তে বুঝছেন।”
চার বছর আগে নন্দীগ্রাম সংলগ্ন হেড়িয়ায় সভা করে বুদ্ধবাবু বলেছিলেন, “সিঙ্গুর হবে। মানুষ চাইলে নন্দীগ্রামও হবে।” মানুষ নন্দীগ্রাম চায়নি। বুদ্ধবাবুকেও প্রত্যাখান করেছিল। কিন্তু তৃণমূল ক্ষমতায় আসার দেড় বছরের মধ্যে মমতা-সরকারের উপরে নন্দীগ্রাম-সংলগ্ন এলাকার মানুষের বিশ্বাসে যে চিড় ধরেছে, এ দিনের সভা তার প্রমাণ বলেই রাজনীতির কারবারীদের একাংশের ধারণা। কলকাতা থেকে দিঘা-মেচেদা সড়ক ধরে চণ্ডীপুর ফুটবল ময়দানের সভায় আসার পথে সভাস্থলের প্রায় দু’কিলোমিটার দূরে বৃন্দাবনপুরে মানুষের ভিড়ে আটকে পড়ে বুদ্ধবাবুর কনভয়।
কনভয় থেকে নেমে কিছুটা পায়ে হাঁটেন বুদ্ধবাবু। তার পরে চড়েন বৃন্দাবনপুরের লোকাল কমিটির নেতা কমলাকান্ত সামন্তর মোটরবাইকে। ২০০০ সালে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে ভ্যান রিকশা চড়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ডাকাতের হাতে নিহত যুবকের বাড়ি গিয়ে ছিলেন বুদ্ধবাবু।
এ দিনের সভায় সরকারের কড়া সমালোচনা করে বুদ্ধবাবু বলেন, “এই সরকার আসার পর দু’বছরের মধ্যে সব কিছু ভেঙে পড়েছে। সার ও বীজের দাম বেড়েছে। চাষিদের দেখার কেউ নেই।” তৃণমূলের দখলে থাকা জেলা পরিষদকে কাঠগড়ায় তুলে বুদ্ধবাবু বলেন, “মেদিনীপুরের পঞ্চায়েত দেশের লজ্জা। জেলা পরিষদে দুর্নীতি। ১০০ দিনের কাজে কোটি কোটি টাকা চুরি হচ্ছে। এর শেষ দেখার দরকার।”
|
|
|
|
|
|