|
|
|
|
|
|
 |
পুস্তক পরিচয় ৩... |
|
অখণ্ড দর্শনের অন্তর্গত |
শিলাদিত্য সেন |
রবীন্দ্রনাথের কালের যাত্রা, রথের রশি, রক্তকরবী, মুক্তধারা, রাশিয়ার চিঠি— এ সব রচনা বরাবরই বামপন্থীদের উত্তেজনার বিষয়। কারণ, তাঁরা মনেই করেন, কবির এমন সৃজনভাবনা আসলে তাঁর রুশ ভ্রমণের (১৯৩০) পরোক্ষ ফল। প্রগতিবাদী বিদ্বজ্জনেরা তাঁদের রচনায় তেমনটা লিখেওছেন... বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক পুনর্গঠনের কাজ দেখে রবীন্দ্রনাথের যে মুগ্ধতা জন্মেছিল তা থেকেই তিনি নাকি মহাকালের চালিকাশক্তি হিসেবে বিপ্লবী জনমানুষকে একমাত্র গ্রাহ্য করতেন। ‘অতি উত্সাহে লেখা এই বক্তব্য অবশ্য খানিকটা বিভ্রমই তৈরি করে।’ অভ্র ঘোষের এই অমোঘ মন্তব্য রীতিমতো স্বস্তিই দেয় আমাদের। অভ্র অবশ্য আমাদের শুধু স্বস্তি দিয়েই ক্ষান্ত থাকেন না, তথ্য দিয়েই প্রমাণ করে দেন যে, জনশক্তির তাত্পর্য ও গুরুত্বের কথা রবীন্দ্রসাহিত্যে এল কবির রুশ ভ্রমণের পর এর আদৌ কোনও তথ্যভিত্তিই নেই।
ফোকাস অন্যদিকে সরে গেলেই ভালো/ প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ (পত্রলেখা, ২২০.০০), অভ্র তাঁর এই নতুন বইটির নাম-প্রবন্ধে লিখছেন ‘সমকালীন সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার সঙ্গে যথেষ্ট পরিচয় ছিল রবীন্দ্রনাথের। তাঁর মতো ভাবুকের পক্ষে এই পরিচয় থাকা খুবই স্বাভাবিক বলতে হবে। এটা আদৌ কোনো আশ্চর্যের খবর নয় আমাদের কাছে। কিন্তু এর অভিঘাতে যদি এমন কোনো সিদ্ধান্তের দিকে অগ্রসর হই আমরা যে, রুশ-বিপ্লব আর রুশভ্রমণের অভিজ্ঞতা কবির মানবতন্ত্রের দার্শনিক চরিত্র পাল্টে দিয়েছিল বিলকুল, তা হলে সে হবে এক অতি সরলীকরণ আর যান্ত্রিকতার দোষে দুষ্ট চিন্তা। সমাজবিজ্ঞানে আমরা যাকে রিডাক্শনিজমের দোষ বলি, এও হয়ে উঠবে তাই।’ পাশাপাশি আবার বিদ্বজ্জনেদের একাংশ বরাবরই রাশিয়ার চিঠি থেকে উল্লেখ করে এসেছেন যে, ছাঁচে-ঢালা মনুষ্যত্বের বিরুদ্ধে, একনায়কতন্ত্রের জুলুমের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন কবি, ব্যষ্টিবর্জিত সমষ্টির অবাস্তবতা যে চিরকাল ইতিহাসে টিকবে না তখনই সতর্ক করেছিলেন তিনি। তাঁদের সেই উল্লেখে মনে হতে থাকে, ‘সমাজতন্ত্র’-এর গোটা ব্যবস্থাটির প্রতিই যেন বীতরাগ ছিলেন কবি। কিন্তু এই বিপরীতের টানেই তো চিনতে হবে রবীন্দ্রনাথকে। কেবল নিজের মতের পক্ষেই ব্যবহার করব কবিকে এমন স্বার্থসিদ্ধির অভিপ্রায় অনুচিত, অথচ তেমন অভ্যেসেই রপ্ত বাঙালি। অভ্রের মত ‘রাবীন্দ্রিক মননের গড়নটি বুঝতে হলে এই দুই মতের যোগের কথাই বলতে হবে, কাটাছেঁড়া করে কেবল মুগ্ধতার দৃষ্টির কথা অথবা সমালোচনার দৃষ্টিটাকে বাড়িয়ে বললে চলবে না।’
অভ্র একের পর এক, ‘সত্যিই কি আছেন রবীন্দ্রনাথ আমদের চেতনায়’, বা ‘পাঠকের চোখে রবীন্দ্রনাথ’ ইত্যাদি নানান অধ্যায় জুড়ে প্রমাণ করতে চান যে কবির সাহিত্যচিন্তা ধর্মচিন্তা বা সমাজচিন্তা সবই এক অখণ্ড দর্শনের অন্তর্ভুক্ত, ‘সমগ্র রবীন্দ্রনাথের ওই জৈব সংহতির কেন্দ্রে আছে আত্মতার সন্ধান বা আত্মতার দর্শন।’ ভাগ্যিস অভ্র এমন একটি বই উপহার দিলেন আমাদের, নইলে রবীন্দ্রপুজোয় বাঙালির অহং তুষ্ট হলেও রবীন্দ্রনাথ তো অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছেন বারে বারে! |
|
|
 |
|
|