|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
কবি যেন মুখোমুখি রাগালাপে |
আবীর মুখোপাধ্যায় |
‘তরুণ কবির স্পর্ধা’ সিরিজ (১-২১)। সপ্তর্ষি, প্রতিটি ২২.০০ |
সময়ের হাত ধরে কবিতার ভুবনকেও হাঁটতে হয়, নইলে নতুন সময়ের কবিতা সময়ে লেখা হয় না। ‘কবির অভিভাষণ’-এ সেই যে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘নতুন প্রাণ নতুন রূপ সৃষ্টি করে, কিন্তু পুরাতনের জীবনধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হলে সে প্রাণশক্তি পায় না’। তবে, ‘পুরাতনকে অশ্রদ্ধা করবার স্পর্ধা যেন তার না হয়’। কবিতার বইয়ের একটি সিরিজের নাম যখন ‘তরুণ কবির স্পর্ধা’, তখন সেই আশঙ্কা প্রথমেই তৈরি হয়েছিল।
বাংলা প্রকাশনায় কবিতার সিরিজ নতুন নয়, সিগনেটের ‘এক পয়সায় একটি’-তে পাঠক পেয়েছেন জীবনানন্দ দাশের বনলতাকে। তবু দীর্ঘ দশক-বিরতির পর, বাংলা কাব্য ভুবনে নব্য সংযোজন এই সিরিজটি। এ পর্যন্ত একুশজন কবির একুশটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এঁরা সকলেই কবিতার ভুবনে নবীন। তরুণ কি? প্রকাশক জানাচ্ছেন, ‘কবিদের বয়স অনূর্ধ্ব পঁয়ত্রিশ’।
নান্দনিক দায়বদ্ধতার জায়গাটিতে কেবল দুমড়ে মুচড়ে নয়, নব্য এই সিরিজে কেউ কেউ সামাজিক অন্ধকার এবং অন্ধত্বের অনুষঙ্গে মিথের উজ্জীবন নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন ছন্দের বারান্দায়। কারও সিদ্ধি ছন্দহীন সাম্প্রতিকতায়। উত্তমপুরুষে মিথকথনে অনেকেই শব্দ ব্যবহার ও বাক্যের গঠনরীতির জায়গায় ইমেজিস্ট। তবে শিকড়চ্যুত নন প্রায় কেউ-ই। বরং খানিকটা তাড়িত হলেও বিস্ময়কর ভাবে অনেকের কবিতা মাটির গন্ধমাখা, অনেকে আবার শহরমুখী চিত্রকল্পের মহতী বিস্তারে উত্তীর্ণ।
সিরিজের প্রথম পর্বে প্রকাশিত সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাব্যগ্রন্থ বৃষ্টিরাশির মেয়ে-র ‘ভাল আছি’-র মতো কবিতা স্তবক অথবা, ‘ঈশ্বর বৃষ্টি নামাক’-এর মতো তুলনায় দীর্ঘ কবিতায় পূর্বজ স্মৃতিকাতরতা যেমন আছে, স্মৃতি উপভোগ্যও হয়ে উঠেছে শাব্দিক প্রদর্শন সরিয়ে কাব্যের বহুস্তরগামিতায়। তাঁর আত্ম-অনুসন্ধান পাঠককে কাব্যের পর্ব থেকে পর্বান্তরে নিয়ে যায়। মিথকথনে
‘রাশি-বৃষ্টি
লগ্ন-হিংসুটে
স্বভাব-মনখারাপিয়া’
কবি বইয়ের নামকবিতায় লেখেন
‘শব্দের মত করে লিখিনি কখনো
পুরোন জ্বরের মত কবিতা আসেনি’।
হিমালয় জানার কাব্যগ্রন্থ ভূতের শহর থেকে-তেও এই আত্মকথনের ভিড়। ২৬টি কবিতার শব্দে, স্তবক বিভাজনে, অন্ত্যমিল অথবা বাক্যগঠনে তাঁর ইমেজারি ক্লিশে নয়, বরং মেধাবী প্রয়োগ। প্রতীক ও চিত্রকল্পে কবি সঞ্চারিত করে দেন রহস্যময়তা। রোমান্টিকতা ও এই রহস্যময়তাই তাঁর কবিতার উপাদান। ‘তোমাকে বলিনি’ শীর্ষক কবিতার প্রথম লাইনেই যখন লেখেন, ‘মাটির ভেতরে আজ টেলিফোন বাজছে সারা রাত’ অথবা ‘ভোর’ কবিতায় যখন লেখেন
‘শান্ত অ্যাপার্টমেন্ট, স্নান সেরে এসে
তোমাকে গানের পাশে ঘুমন্ত দেখার বিস্ময়’
মনে হয়, এই তরুণ কবি কাব্যের লিরিকধর্মিতা নষ্ট না করেও দৃশ্যের জাল বুনে দ্যুতিময় সংস্থান করে নিলেন বাংলা কবিতার ভুবনে। একই ভাবে আমরা আশাবাদী রাকা দাশগুপ্তের কাগজফুলের বন বইয়ের ‘রূপকথা’, ‘কোনও পঞ্চদশীকে’ বা, ‘অণুপল্লবী’-র মতো কবিতায়, তাঁর ধ্বনিসাম্যের অনুপম অভিঘাতে। অথবা, সৈকত চক্রবর্তীর একুশের একপ্রান্তে-র সফল ও সমিল চতুষ্কের নির্মাণে, শ্রবণ-সুখ ধ্বনি সুষমায়।
বাক্ ব্যবহার কোথাও কোথাও অতিকথন, তবু অনেকের লেখায় শব্দের ভিতর অজস্র দ্যুতি ছড়ানো। তোর্সা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্মাদ উইন্ডমিল-এর কবিতাগুলি যেমন, বিস্ময়কর রকমের সতেজ ও বহুবর্ণ। ‘ডাকনাম’ কবিতায় তোর্সা প্রথম স্তবকের শুরুতে বলেন,
‘মাঝে মাঝে ঈশ্বর আসেন আমার ঘরে
আমার আত্মার বিনিময়ে
তোমার চুলের সুগন্ধ দিয়ে যান।’ দৃশ্যসুখের এই অমরতাকে যখন বহুমাত্রিক বিস্তারে এনে ফেলেন, শেষ লাইনে পৌঁছে বলেন, ‘এরই নাম বিলাসখানি টোড়ি’, তখন মনে হয় কবি যেন তান-তোড়-ঝালার বিস্তার শেষে সমে ফিরলেন! এই সাংগীতিক সুষমা দেবারতির ডিসটিউনড পিয়ানো-র উত্সর্গপত্রেও পাই—
‘যে টিউন করতে পারে
তাকে’।
মনে হয় কবি যেন মুখোমুখি রাগালাপে বসলেন। আবার জিত্ মুখোপাধ্যায়ের সন্ধ্যার সারিন্দা হাতে নিলে দু’মলাটের ভিতর থেকে দুই বাংলার লোকায়ত গানের সহজিয়া সুরটি কানে এসে লাগে। জিতের কবিতা ভিড় করে মাজারের সন্ধ্যায় কখনও এসে দাঁড়ান দরবেশ, মুর্শিদ। বুদ্ধপূর্ণিমার ছায়ায়,
‘মৃদুকণ্ঠে পীর বলে ওঠেন:
হে তথাগত!’
শেষ কবিতা ‘পারানি’-র শেষ লাইনে গিয়ে কবিকে লিখতে হয়, ‘মা, তোমরা সবাই এসো -
আমায় একটু পুনর্জন্ম অবধি- পৌঁছে দাও’।
কবিতার এক শরীর থেকে অন্য শরীরে, দুটি ডানা মেলে উড়ে গেছে স্বপ্ন। শ্রীময়ী ভট্টাচার্যের লাইফ ইন্ এ মেট্রো-য় এই উড়ান শহরমুখি চিত্রকল্পকে ভর করে। মুক্তছন্দে যেন বা স্বপ্নপ্রবণ এক মানুষেরই আত্মকথন। কাব্যের পাতায় পাতায় শীর্ষকের ইশারায় হেঁটে শ্রীময়ী যখন লেখেন,
‘লয় কমে আসছে স্বভাবে
যেভাবে স্টেশনে এলে,
ঝুঁকে ঝুঁকে থামে সুখী ট্রেন...’;
নাম কবিতায় এসে পাঠককে থামতে হয়, থামতেই হয়। কবি আসলে চিত্রকর, হিয়া মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় শরীরের আগুনের সঙ্গে শব্দ-ছবিতে অনায়াসে মিশে যায় ছারখার দাবানল। তাঁর মোহময় পেস্ট্রির দিন বইয়ে অনেক সময় কবিতা হয়ে ওঠার পর্বে স্খলন ঘটে। কিন্তু, সাদামাঠা ছত্র ছুঁয়ে ছুঁয়ে শুদ্ধতার শিখরে উত্তরণ ঘটে, যখন হিয়া বলেন,
‘রাত্রি গভীর হলে যে বালিকা সিলিংমুখর
নিজেরই অতল খুঁড়ে ডেকে ওঠে- ‘মাথুর! মাথুর!’
প্রেম নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ অনুপম বোধ। এবং কবিতার ভুবনে যার ব্যক্তিগত প্রকাশ অমোঘ ভাবে দুঃখের পরশমণিতে। এই শহর, এই সময়ের অফুরান ভালোবাসাবাসির সেই দুঃখবোধ ঘুরে ফিরে এসেছে তরুণ কবিদের কবিতায়। রাংতায় মোড়া চকোলেট বইয়ে অনির্বাণ কর সহজ ভাষায় সেই চিত্ররচনার পক্ষপাতী। প্রত্যাশা জাগায় তাঁর ‘টুকলি’, ‘স্কাল্পচার’ ‘গল্প এবং...’ বা ‘এস এম এস’-এর মতো কবিতা। অন্য দিকে বিশ্বজিত্ রায়ের বিচ্ছেদ প্রস্তাব-এর কবিতায় শব্দমাধুর্য ছাপিয়ে যায় প্রেম, দহনের আশ্চর্য নির্লিপ্তির দার্শনিকতায়। তাঁর ‘ঘর’, ‘ছিন্নপত্র’, বা ‘কর্ণ’ কবিতা যেন বিচ্ছেদের বিষাদ-বেদনায় ভেঙে পড়া একজন মানুষের দিনলিপি।
বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো কয়েকটি পংক্তির বাক্সুষমায় দীপ্তি থাকলেও সমগ্রতায় সফলতা আসেনি শুভেন্দু পালের পাশের ফ্ল্যাটের দেবতা বা শ্রীদর্শিনী চক্রবর্তীর শীতের অব্যর্থ ডুয়ার্স এর কবিতালোক। যেমন কবিতার সমগ্রতায় উত্তীর্ণ নয় কুবলয় বসুর প্রতিপক্ষ হেরে যাচ্ছে, দেবলীনা ঘোষের বিরক্ত ঋতুর কাছে, সব্যসাচী মজুমদারের মেঘ আর ভাতের কবিতা অথবা শ্রেয়সী চৌধুরীর মনোটোনাস বাঁশি বাজে জঙ্গলের দিকে। তুলনায়, ঐত্রেয়ী সরকারের রাহুমুখে চাঁদ সংবাদ -এ কবির উচ্চারণ অস্খলিত, সটান। পিয়াল ভট্টাচার্য তাঁর উদাসীন, অলীকযাপন কাব্যের শেষে কাব্যের সিদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। চমকের অভিঘাত কাটিয়ে, ‘স্বীকারোক্তি’-র হাত ধরে পাঠকের কাছে জানতে চান, ‘হে পাঠক- সব কথা বুঝে নেবে তা কেবল দু’ মুহূর্তে পাঠে?’ প্রত্যাশা জাগায় সুমন ঘোষের বারোয়ারি কমিটির থিয়েটার বইয়ের ‘দোলাচল’, দেবব্রত কর বিশ্বাসের শ্রীগোপাল মল্লিক লেন-এর ‘সাংরাশ’ কবিতা।
দু’ ফর্মা সিরিজের বইগুলির সুশোভন প্রচ্ছদ নির্মাণ করেছেন চার শিল্পী বিপ্লব মণ্ডল, রাজীব চক্রবর্তী, অভীক মজুমদার ও মৃণাল শীল। মুদ্রণ সৌকর্য প্রশংসনীয়। |
|
|
|
|
|