হুল্লোড় |
দুখ মে ভি এক সুর হ্যায়
ওয়ান ডে থেকে সচিনের অবসরের কথা শুনে তাঁর- গুলাম আলির একটা গজলের লাইন মনে পড়ে যায়।
কলকাতার মেহফিলের পরে শিল্পী স্বয়ং শোনালেন। মুখোমুখি প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত |
ঘরে ঢুকে প্রথমেই চোখ চলে যায় দু’টো ছবির দিকে। দুটোই কলকাতায় তোলা।
প্রথমটা একটা কনসার্টের ছবি। যেখানে মেহদি হাসানের সঙ্গে গুলাম আলি। অন্যটা জগজিৎ সিংহের সঙ্গে তোলা, গুলাম আলির এক অন্তরঙ্গ মুহূর্ত। দু’টি ছবিই আক্ষরিক অর্থে অমূল্য। দেখেই মনটা কেমন ভারী হয়ে গেল।
যেন একটা পেছনে ফেলা আসা যুগের দিকে ফিরে তাকানো।
কলকাতায় এসেছিলেন দক্ষিণ কলকাতা সংসদের এক কনসার্টে।
গজলের কিংবদন্তি গুলাম আলি ছবি দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকলেন খানিকক্ষণ নিঃশব্দে। ঠোঁটে খেলে যায় হাসির রেখা। তারপর নরম গলায় বললেন,“দুখ মে ভি এক সুখ হোতা হ্যায়।” মহান সঙ্গীতজ্ঞ তো এই ভাবেই তৈরি হন। তিনিই বড় মাপের শিল্পী যিনি বেদনার মধ্যেও পেয়ে যান দুঃখ ভোলার আনন্দ।
সারা জগৎ যখন ‘ফাসলে অ্যায়সে হোঙ্গে ইয়ে কভি সোচা না থা’ গুনগুন করে, তিনি তখন তাঁর পরিজন হারানোর দুঃখকে ছাপিয়ে যান সঙ্গীতের মূর্ছনায়। মনে মনে ভাবেন স্বর্গে একটা বিশাল সঙ্গীতের মেহফিল বসেছে। মেহেদি হাসান, জগজিৎ সিংহ, পণ্ডিত ভীমসেন জোশী এবং পণ্ডিত রবিশঙ্কর সবাই উইংসের আড়ালে দাঁড়িয়ে। অপেক্ষা করছেন কখন ডাক পড়বে।
তেত্রিশ বছরের পুরনো বন্ধু বাদল ধর চৌধুরীর বাড়িতেই তিনি ওঠেন কলকাতায় এলে। ধীরে ধীরে সেই বাড়ির বসার ঘরে এসে বসেন গুলাম আলি। আজকাল তাঁর গলার অবস্থা ভাল নয়। তাই তিনি কণ্ঠের ওপর চাপ দিতে চান না। তাঁর মনের মধ্যে হয়তো উঁকি দিচ্ছে সেই আশির দশক। সেই সময়ই তো তিনি প্রথম কনসার্টে অংশ নেন মেহেদি হাসানের সঙ্গে। জলসা হয়েছিল এই কলকাতাতেই। নজরুল মঞ্চে। তার পর এই শহরে তিনি জগজিৎ সিংহের সঙ্গে অন্তত তিন চারটে অনুষ্ঠান তো করেইছেন। সেই সব সঙ্গীতময় দিনের ছবি তার মনশ্চক্ষে ভেসে ওঠে। কিন্তু অতীতের সরণি থেকে ফিরে আসেন যখন জিজ্ঞেস করা হয় গজলের দুনিয়ায় কেন আর এক জন দ্বিতীয় গুলাম আলি তৈরি হল না কেন? |
 |
সব প্রজন্মই সমান মুগ্ধ: গুলাম আলির সঙ্গে ডিকেএস
ক্লাবে রঞ্জিৎ মল্লিক ও কোয়েল। ছবি: কৌশিক সরকার |
তিনি বলেন, “ও তো উপরওয়ালা বানাতে হ্যায়। প্রত্যেক শিল্পীই আলাদা। প্রত্যেকেরই নিজস্ব কিছু চরিত্র থাকে। তবে হ্যাঁ, এক জন সফল গজল শিল্পী হওয়া সহজ কাজ নয়। শুধু গজলই বা কেন বলব? শিল্পের কোনও ক্ষেত্রেই সফল হওয়াটা যেমন তেমন কাজ নয়।”
যখন তিনি গান করেন, গানের বাণী আর সুরের মূর্ছনায় বছরের পর বছর তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠেছে নানা ছবি। “প্রত্যেকটা গজলের নিজস্ব একটা চরিত্র বা নির্যাস আছে। যখন আমি ‘হাঙ্গামা’ গাই তখন একটা উৎসবের আমেজ তৈরি হয়। যখন ‘দিল মে এক লহের’ গাই তখন গলার মধ্যে একটা নম্র ভাব আনতে হয়,” বললেন তিনি।
কথার ফাঁকে তিনি আজকের উদীয়মান গজল গায়কদের উদ্দেশ্যে কিছু পরামর্শ রাখলেন এই বলে, “যত তৈরি গলাই হোক রেওয়াজ করাটা দারুণ গুরুত্বপূর্ণ।আজও আমি চেষ্টা করি রেওয়াজ করতে। শুধুমাত্র ‘আ’ উচ্চারণ করার মধ্যেও একটা পরিমিতিবোধ থাকা দরকার। আআ করার সময় মুখটা কতটা খোলা হবে সে সম্পর্কেও একটা সম্যক জ্ঞান থাকা দরকার।” কী ভাবে গলা সাধতে হবে, সুর ছাড়তে হবে, কথা বলতে বলতে নিজেই করে দেখালেন তিনি।
ধ্রুপদী সঙ্গীত যে কতাটা গুরুত্বপূণর্ সেটা তাঁর কথায় উঠে এল। সেই প্রসঙ্গে তিনি বললেন, “কুচ ভি গাও, ক্লাসিকাল মিউজিক শিখনি চাহিয়ে।” তাঁর মতে সেটা অপরিহার্য। “গজল শিখতে হলে তার সঙ্গে উর্দু শেখাটাও খুব জরুরি। কারণ যে গান করছেন সেই গানের শব্দের অর্থ বোঝা খুব প্রয়োজন। না হলে গানের চরিত্রটাই যে ধরা যাবে না। লয় অনুযায়ী আলফাজ ঠিক করতে হবে।”
ব্যাপারটাকে বিস্তারিত ভাবে বোঝাতে গিয়ে তিনি যেন একটা ক্লাসই নিয়ে ফেললেন। তরুণ গায়কেরা প্রায়শই গজলে ‘দোস্ত’ শব্দটা ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু ওদের জানা দরকার ‘দোস্ত’ শব্দটার শেষের ‘ত’ থাকবে অনুচ্চারিত বা সায়লেন্ট। “সুরে গান গাও। কখনও কথার উচ্চারণ নিয়ে তাড়াহুড়ো করা উচিত নয়। অপ্রয়োজনে জিভের অতিরিক্ত ব্যবহার করে স্বরকে টানবেন না। গানের শব্দগুলো উচ্চারণ করার সময় মাত্রাজ্ঞান খুবই প্রয়োজন। না হলে গজলের অনুভূতিটাই নষ্ট হয়ে যাবে।” জোর দিয়ে বলেন গুলাম আলি।
|
 |
একদা জগজিৎ সিংহের সঙ্গে। ছবি সৌজন্য: বাদল ধর চৌধুরি |
বর্তমান সমস্যা হল সমঝদার শ্রোতার অভাব। অনেকেই গানের উৎকর্ষটা কোথায় ধরতেই পারেন না। “অথচ একটা সময় ছিল মেহফিলে রীতিমতো শিক্ষিত শ্রোতা থাকতেন। তাঁরা প্রচুর গানবাজনা শুনতে অভ্যস্ত ছিলেন। এবং অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে জলসা শুনতেন। সেই সব শ্রোতা আজ আর পাই না। এক জন শিল্পী বড় হয়ে ওঠেন প্রকৃত শ্রোতাদের গান শুনিয়ে।” বলে ওঠেন তিনি।
আজকের যুগের নতুন ধাঁচের গান কি তিনি শোনেন?
“কিছু গান অবশ্য ভাল। তবে অনেক গানেই পশ্চিমী সঙ্গীতের প্রভাব বড্ড বেশি। ফিউশন মিউজিক বলতে যেগুলো আজকাল হচ্ছে তার বেশির ভাগেরই গুণগত মান খুব উঁচু নয়। আমরা গানবাজনা করেছি অন্য রকম পরিবেশে। আমি গান শিখেছি উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খানের কাছে,” বললেন তিনি।
উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খান সম্পর্কে তাঁর গভীর টান থাকাটাই স্বাভাবিক। হাজার হোক উস্তাদ বড়ে গুলাম আলির নামেই তো তাঁর নামকরণ করেছিলেন তাঁর বাবা। স্মৃতির পথ বেয়ে আবার পথ চলা। মনে পড়ে যায় সেই সব দিনের কথা যখন গ্রাম থেকে দশ কিলোমিটার টাঙায় চেপে, তার পর বাসে চড়ে লাহৌর যেতেন বড়ে গুলাম আলি খান সাহেবের জলসা শুনতে।
“আজও আমি তাঁর গান শুনতে ভালবাসি। গান শুনি উস্তাদ আমির খানের। ওঁদের গান শুনলে আজও আমার শরীরে শিহরন জাগে।”
কিন্তু আজকের এই গুলাম আলি খান কি অন্যদের গজল শোনেন? সে সব গজল কি তাঁর কাছে শোনার মতো? “হ্যাঁ। শুনি। কিন্তু আমি কারও নাম নেব না। তাতে কারও বা নাম বাদ পড়তে পারে। তাতে কেউ কেউ আঘাত পেতে পারেন। আমাদের গানবাজনার জগতে কিছু অলিখিত নিয়মকানুন রয়েছে। আমি কাউকে আঘাত করতে চাই না। মেরে হিসাব সে কোই ছোটা বড়া নহি হোতা হ্যায়।”
তার পর বলেন জীবনে তাঁর নেওয়া দুটি শপথের কথা। “ওয়াদা খিলাফি নহি করতা ম্যায়। কমিটমেন্ট আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কখনও কথা দিয়ে কথার খেলাপ করিনি।” কথা শুনতে শুনতে মনে হল এ যেন গুলাম আলির গলায় সলমন খানের একটা ডায়লগ: ‘ম্যায় জব কমিটমেন্ট কর দেতা হুঁ, তো আপনে কা ভি নহি শুনতা।’
সেখান থেকেই কথা গড়িয়ে গেল বলিউডের দিকে। শোনা যায় খবরের কাগজে তাঁর প্রথম ভারত সফরের ছবি দেখে মহম্মদ রফি তাঁকে হোটেলের রুমে ফোন করেন। সময়টা ভোর সাতটা তখন। আগের রাতে একট লেট নাইট শো ছিল তাঁর। তাই ফোনে ঘুমের ঘোরে মহম্মদ রফির গলা
|
পরামর্শ |
• যত তৈরি গলাই হোক রেওয়াজ করাটা দারুণ গুরুত্বপূর্ণ।
• এমনকী ‘আ’ বলতে গেলেও পরিমিতিবোধ থাকা দরকার।
• ‘আআ’ করার সময় মুখটা কতটা খোলা হবে সে সম্পর্কেও সম্যক জ্ঞান থাকা দরকার।
• ক্ল্যাসিকাল শিখতেই হবে!
• উর্দু শেখাটাও খুব জরুরি। কারণ যে গান করছেন সেই গানের শব্দের অর্থ বোঝা খুব প্রয়োজন। না হলে গানের চরিত্রটাই যে ধরা যাবে না।
• লয় অনুযায়ী ‘আলফাজ’ চয়ন করতে হবে।
• তরুণ গায়কেরা প্রায়শই গজলে ‘দোস্ত’ শব্দটা ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু ওদের জানা দরকার ‘দোস্ত’ শব্দটার শেষের ‘ত’ থাকবে অনুচ্চারিত বা সায়লেন্ট।
• অপ্রয়োজনে জিভের অতিরিক্ত ব্যবহার করে স্বরকে টানবেন না। |
|
তিনি চিনতে পারেননি। কিন্তু রফি সাহেবের বাড়িতে যাওয়া নেমন্তন্ন তিনি গ্রহণ করেছিলেন। বাড়িতে তাঁকে ঢুকতে দেখে রফি সাহেব নাইট স্যুট পরে খালি পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। তাঁকে ওই রকম উদ্ভ্রান্তের মতো বেরিয়ে আসতে দেখে গুলাম আলি বলে ওঠেন, “আপকো তো পুরি দুনিয়া শুনতি হ্যায়।” রফি সাহেব বিনীত ভাবে সে কথার উত্তরে বলেন, “লেকিন ম্যায় আপকো শুনতা হুঁ।”
হিন্দি ছবিতে ‘নিকাহ’তে ‘চুপকে চুপকে রাত দিন’গাইলেও, বলিউড তাঁকে আর তেমন ভাবে টানে না। “আমার এখন আর হিন্দি ছবির কোনও অফার নেই। নিজের পছন্দের মতো নিজের স্টাইলে গান গাই। আমার অজয় চক্রবর্তী আর রাশিদ খানের গান ভাল লাগে,” বললেন গুলাম আলি।
স্বপ্ন দেখেন এখনও? দেখলে কী নিয়ে স্বপ্ন দেখেন তিনি?
“জব তক জিন্দা হুঁ, গলা জিন্দা হ্যায়, লোগো কে সামনে খিদমত করতা রহুঙ্গা। নতুন প্রজন্মকে শেখাতে চাই। আরামসে শিখানা চাহাতা হুঁ। কোই বিজনেসকে লিয়ে নহি।”
ভারত সফরে এসে কি ভারত পাকিস্তানের ক্রিকেট ম্যাচগুলো দেখছেন?
“সব সময় হয়ে ওঠে না। পাকিস্তানে ওয়াসিম আক্রম আমার প্রতিবেশী। তবে আজকালকার দলে সব ক্রিকেটারের নাম নিতে পারব না। সচিন অবশ্য আলাদা। ওঁর ওয়ান ডে থেকে রিটায়ারমেন্টের খবরটা শুনেছি। ভগবান নে বড়া প্যায়ার সে বনায়া হ্যায় সচিন কো। বড়ি তাকত দি উনকো।”
সচিনের কথা ভেবে কি কোনও গজলের লাইন মনে পড়ে? কিছুক্ষণের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে বলেন, “বড়ি মুশকিল সে হোতা হ্যায় চমন মে দিদা-এ-ওয়ার প্যায়দা...”
উনি বলতে চান যে অনেক কষ্টের পরে সচিনের মতো এক জনের জন্ম হয়...
এই শেরটা বোধ হয় গুলাম আলির জন্যও সমান ভাবে প্রযোজ্য। |
|