শনিবারের নিবন্ধ
রকগুলো সব কোথায় গেল
ঘোষ রেস্টুরেন্টের ফুটপাথের আড্ডায় সেদিন গ্রামার নিয়ে তুমুল তর্ক। সকাল গড়িয়ে অফিসের বেলা হল। তর্ক তবু থামে না। অগত্যা স্থির হল, বিকেলের সেশনে গ্রামার বই এনে বিষয়টির সমাধান করা হবে।
বিকেলের আড্ডা চালু হতে হতে সাড়ে চারটে। দেখা গেল, কেবিন খোলার আগেই ফুটপাথে এসে দাঁড়িয়ে রয়েছেন এক সত্তরোর্ধ্ব মানুষ। অস্থির অপেক্ষা তাঁর। কী ব্যাপার? তিনি জানালেন, “আসলে সকালে আপনাদের ওই তর্কটা আমিও শুনছিলাম। কিন্তু উত্তরটা জানা হয়নি। বলা হল, বিকেলে আবার সবাই এলে গ্রামার বই এনে তর্কের সমাধান করা হবে। তাই আগে থেকে এসে দাঁড়িয়ে রয়েছি।” অন্তত পঁয়ত্রিশ বছর আগের সেই ঘটনাটি আজও মনে রেখেছেন ওই আড্ডার এক সদস্য দীপক ভট্টাচার্য।
আড্ডা-প্রিয় উত্তর কলকাতার এই ভূখণ্ডের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে এমন অনেক মণিমাণিক্য। দক্ষিণে আড্ডা একেবারেই ছিল না, তা নয়। তবে সেগুলি প্রায় সবই ছিল কোনও না কোনও রেস্তোরাঁ-কেন্দ্রিক। কালীঘাটের সাঙ্গুভেলি, গড়িয়াহাটের পানিয়ন (এখন নেই), পূর্ণ সিনেমার কাছে দু-একটি কেবিন, দেশপ্রিয় পার্কের সুতৃপ্তি-র মতো হাতে গোনা কয়েকটি জায়গায় বসত সেই সব বৈঠক। বিশিষ্টদের আনাগোনাও হত। তবে তা ঠিক উত্তরের মতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলত না।
‘বাঙালির আড্ডা’ সংকলন গ্রন্থের মুখবন্ধে লীনা চাকী লিখেছেন, “বাঙালির এক চলমান সংস্কৃতি হল আড্ডা, যা আজও স্বীকৃত শিল্পকলা নয়। অথচ এই আড্ডা থেকেই উঠে এসেছে সৃষ্টিশীল ভাবনা ও কর্ম। অভিনব সব যোগাযোগ ঘটে গেছে আড্ডা থেকেই। আমরা সেই সব আড্ডার দিকে কাঙালের মতো তাকিয়ে থাকি।”
যতীন্দ্রমোহন অ্যাভিনিউয়ের উপর শ্যামবাজার এ ভি স্কুলের দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা ঘোষ রেস্তোরাঁটি আজ আর নেই। কিন্তু সেখানকার ফুটপাথের বেঞ্চিতে বসা আড্ডার স্মৃতিতে ঘুরে ফিরে আসেন সাবেক নান্দীকারের অজিতেশ-অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়-রুদ্রপ্রসাদেরা। কখনও বা ঢুকে পড়েন মোহিত চট্টোপাধ্যায়। ফুটপাথের বেঞ্চে এমন সম্মিলন থেকে কী পাওনা হতে পারে, প্রতিভার উদ্গিরণ ছাড়া!
ঠিক উল্টো ফুটপাথে কোনাকুনি তাকালেই রাজবল্লভপাড়ার মোড়ে ‘মস্কো’। কলকাতার এক অন্যতম আড্ডাক্ষেত্র। বিশাল গাড়ি বারান্দার তলায় মুখোমুখি দুটি বেঞ্চি পাতা। পার্কের বেঞ্চ যেমন হয়, ঠিক তেমন। স্মৃতি হাতড়ে ৭৮ বছরের গোপাল ঘোষ বললেন, “পাশের জগৎ মুখার্জি পার্কে তখন বেঞ্চি বসানোর কাজ চলছিল। আমরা সেখান থেকেই দুটো তুলে নিয়ে চলে এলাম। একা হাতে এমন বেঞ্চ তুলে আনার কায়দা আছে। আমি জানতাম।” তাঁর হিসেবে সে সব ৪৯-৫০ সালের কথা।
এই আড্ডার বয়স কিন্তু তার চেয়েও বেশি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে-পরে সেই সময় মূলত কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন লোকেরা জড়ো হতেন এখানে। কমিউনিস্টদের কাছে তখন স্বর্গ বলতে সোভিয়েত রাশিয়া। রাজবল্লভপাড়ার এই বামপন্থীদের আড্ডাস্থলটিও তাই অচিরেই চিহ্নিত হল ‘মস্কো’ নামে। বামপন্থী চিত্র-সাংবাদিক শম্ভু বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন এই আড্ডার গোড়ার দিকের এক সংগঠক। তাঁরই সূত্রে বহু নামী নেতাও এখানে এসে বসেছেন।
তখন অবশ্য বসার জন্য এমন বেঞ্চ পাতা ছিল না। আড্ডা চলত ফুটপাথে রাখা সিমেন্টের স্ল্যাবে পিছন ঠেকিয়ে। যাঁর বরাতে সেটুকুও জুটত না, তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই চালিয়ে যেতেন। হাত বাড়ালেই ছিল পটলের চা-তেলেভাজার দোকান। আড্ডা জমানোর পক্ষে সেই দোকানের অবদানও প্রায় ঐতিহাসিক।
সকাল থেকে শুরু হয়ে দফায় দফায় আড্ডা চলত মাঝরাত পেরিয়ে। শুধু মুখগুলি বদলে যেত বয়সের সঙ্গে মানিয়ে।
বিভিন্ন সময়ে এই আড্ডায় দেখা মিলেছে মোহিত মৈত্র, অমর মুখোপাধ্যায়, শম্ভু ভট্টাচার্য, হেমাঙ্গ বিশ্বাস থেকে শুরু করে সরোজ দত্ত, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পর্যন্ত অনেকের। দাদা অমরের সুবাদে আড্ডায় এসেছেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়। কয়েকবার দেবব্রত বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী, নির্মলেন্দু চৌধুরীও। আসলে সেই কাল যে গণনাট্যেরও রমরমার।
সমসময়ের বাম-রাজনীতি থেকে গণ-সংস্কৃতি সব কিছু নিয়ে তৈরি হয়েছিল এই আড্ডা-বৃত্ত। বোঝাই যায়, এখানে যাঁরা ভিড় জমাতেন, তাঁরা সকলেই স্থানীয় নন। কিন্তু আলোচনার উৎকর্ষ এবং জমায়েতের চরিত্র তাঁদের টেনে আনত এখানে। শীতের রাতে কাঠের আগুন জ্বেলে গোল হয়ে বসে গা-গরম করে চালিয়ে যেতেন আড্ডাধারীরা।
এই আড্ডার সদস্য ছিলেন চিত্রকর অশোক গুপ্ত। “অশোক গুপ্তের আঁকা বুলগানিন, ক্রুশ্চভের প্রতিকৃতি নিয়ে সে এক বিরাট কাণ্ড!”বলছিলেন গোপাল ঘোষ। সেবার বুলগানিন, ক্রুশ্চভের এলেন কলকাতায়। তখনও ভিআইপি রোড হয়নি। তাই দমদম থেকে শ্যামবাজার হয়ে এই সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ধরেই যেত ভিআইপি-দের কনভয়। মস্কো-র বারান্দা থেকে অশোক গুপ্তের আঁকা রাশিয়ার দুই নেতার বড় বড় ছবি ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই ছবি চোখে পড়ে ওই দুই বিদেশি অতিথির। রাজবল্লভপাড়ার মোড়ে এক মিনিট থেমে যায় তাঁদের কনভয়। “ছবি দেখে এতটাই অভিভূত হয়েছিলেন তাঁরা”, গর্বিত স্মৃতিচারণ এই প্রবীণ ‘মস্কো’ সদস্যের।
সোভিয়েতের ভাঙনের মতো এই মস্কো-র আড্ডাও চেহারা-চরিত্রে আজ অনেকখানি ভেঙেছে। নতুন থেকে নতুনতর প্রজন্মের হাত ধরে বদলেছে আলোচনার গতি-প্রকৃতি। কিন্তু সেই পুরনো বেঞ্চে নতুন মুখের মেলা আজও বসে। এই আড্ডার নেশা এতটাই প্রবল যে, এ পাড়া ছেড়ে চলে যাওয়া কেউ কেউ নিত্য বাস ভাড়া দিয়েও বছরের পর বছর এখানে হাজিরা দিয়ে চলেছেন। তাঁদেরই একজন দিলীপ রায়। যাঁর নিজের কথায়: “বরানগর থেকে রোজ আসতে-যেতে আমি এত দিনে কয়েক লক্ষ টাকা শুধু বাসভাড়াই দিয়েছি। তবু আসছি। আসব।”
নাম-মাহাত্ম্যে আরও এক মস্কো আছে উত্তর কলকাতার আড্ডা জগতে। সেটি আহিরিটোলায়। সেখানে জনৈক শ্যামদা-র রেস্তোরাঁতেও বামপন্থীরা বসতেন বলে লোকমুখে ওই আড্ডাস্থলের নাম হয়ে গেছে মস্কো কেবিন। শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ে এখন উঠে যাওয়া কফি হাউসও ছিল আর এক উল্লেখযোগ্য আড্ডার ঠিকানা। সেই সভা আলো করে থাকতেন মূলত নাট্য-ব্যক্তিত্বেরা।
আসলে আড্ডা ব্যাপারটা যেহেতু সমমনস্কদের সঙ্গ ছাড়া কিছুতেই জমে না, তাই এক একটি আড্ডাস্থল একেকভাবে পরিচিত হয়ে গিয়েছে তার সদস্যদের নিরিখে। মস্কো-র বামপন্থীদের আড্ডার সঙ্গে শ্যামবাজারের কফি হাউসের নাটুকে আড্ডা এইভাবেই আলাদা মাত্রা পায়। ঠিক যেমন ’৫০-এর কলেজ স্ট্রিটে দুই প্রকাশকের দফতরে নিয়মিত আড্ডা বসত তারকা-লেখকদের। প্রকাশনার মহলে প্রবীণ সবিতেন্দ্রনাথ (ভানু) রায়ের স্মৃতিচারণে এমন আড্ডার ছবি রয়েছে। সেইসব সান্ধ্য মজলিশে তিনি দেখেছেন প্রবোধ সান্যাল, প্রমথনাথ বিশী, কালিদাস রায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীতি চট্টোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সজনীকান্ত দাসের মতো ব্যক্তিদের।
কবি-সাহিত্যিকদের আরও কিছু আড্ডা ছড়িয়ে ছিল শহরের এদিক-ওদিক। উদাহরণ: সুনীল-শক্তি-শরৎ-দীপক মজুমদারদের নিয়ে গড়া কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর ‘কলকাতা শাসন করা’ আড্ডা। কিংবা পাইকপাড়ায় অপেক্ষাকৃত বয়স্ক সাহিত্যিকদের আড্ডা। রসে-বশে-নেশায়-পেশায় জমজমাট হলেও সেগুলিকে একেবারে রকে বসা আড্ডা বললে হয়তো পুরোপুরি ঠিক বলা হবে না। পঞ্চাশের দশকেই উত্তর কলকাতায় তখনকার পরিচিত সাংবাদিকদের একটি আড্ডা বসত হাতিবাগানের কাছে ফড়িয়াপুকুরে অধুনালুপ্ত নগেন্দ্র কেবিনে। সেখানে খবরের কাগজে না-লেখার যোগ্য বিষয় নিয়েই চর্চা হত বেশি। কিন্তু মজলিশের মেজাজে সেই আড্ডা ছিল সব দিকেই বর্ণময়।
এখান থেকে কিছু দূরে বলরাম ঘোষ স্ট্রিটের উপর দাবার আড্ডা কিন্তু আজও সমান সজীব। রাজা আসে, রাজা যায়। বদলায় রাজ্যপাট, দিনকাল। তবে এই পাড়ার বিস্তীর্ণ রকে মন্ত্রী-গজ-ঘোড়া-নৌকোর কিস্তিমাত আজও সমান তালে চলেছে। বর্ষে বর্ষে, দলে দলে গভীর রাত পর্যন্ত দাবাপ্রেমীদের ভিড় জাগিয়ে রেখেছে এক পুরনো ঘরানা।
খেলা ঘিরে এমন আরও কয়েকটি আড্ডা আছে উত্তরে। শ্যামপুকুরের লাহা কলোনিতে ফুটবল ক্লাব শ্যামপুকুর ইউনিয়ন ঘিরে তৈরি হওয়া আড্ডা অনেক চেনা মুখের সাক্ষী। সেখানেও রকে সিমেন্টে বাঁধানো দাবার ছক বুঝিয়ে দেয়, হৃদয়ের কোন গভীরে এর অবস্থান! কিছু দিন হল আরও গোটা দুয়েক দাবার আড্ডা গজিয়ে উঠেছে রাজবল্লভপাড়ার ফুটপাথেও।
বাগবাজার মোড়ের কাছে রামকান্ত বসু স্ট্রিটে সিএবি-র প্রাক্তন কর্তা গৌতম দাশগুপ্তের পৈতৃক বাড়ির উঁচু রোয়াকে আজও যে আড্ডা বসে, তার বয়স কত? গৌতমবাবু বলেন, “আমার বাবাও এই রকে বসে আড্ডা দিয়েছেন। এখন সময় পেলেই আমিও বসি।” এখানেও খেলাই মুখ্য। সকাল থেকে দফায় দফায় আড্ডা চলে। মূল অধিবেশন অবশ্যই সন্ধ্যায়। শেষ হতে রাত দশটা-সাড়ে দশটা। হাতে নয়, মুখে আলোচনা ফুটবল, ক্রিকেট, মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ইত্যাদি।
কিন্তু আড্ডা মানেই তো শুধু ভাবগম্ভীর রাজনীতি, সাহিত্য, নাটক কিংবা ফুটবল-দাবা নয়। আড্ডা তো নির্ভেজাল ফিচলেমিরও ভাণ্ডার! নইলে পটলডাঙার ‘চাটুজ্যেদের রোয়াক’ অমন তীর্থক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে? বাংলা সাহিত্যে ওইরকম একটি আড্ডাতীর্থ উপহার দিয়ে রকের আড্ডাকে বলতে গেলে অস্কার পাইয়ে দিয়েছেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। ভাবুন তো, মধ্যমণি টেনিদাকে নিয়ে পটলডাঙার সেই চারমূর্তির রকবাজি! মাঝে মাঝেই রাগে অথবা অনুরাগে টেনিদার সেই ‘ডি-লা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস ইয়াক্ ইয়াক্’ হুঙ্কার! রক গরম করার এমন উপাদান কি সহজে মেলে?
হ্যাঁ, গল্প হলেও সত্যি। টেনিদা, পটলডাঙা, রোয়াক সব সত্যি। বলতে পারেন, বেশিটাই ঠিক। টেনিদা মানে ২০, পটলডাঙা স্ট্রিটের বাসিন্দা প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। আজ তাঁর বয়স হত তিরানব্বই। তাঁদের বাড়িতে ভাড়াটে হয়ে এসে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় টেনিদাকে যে রকে বসিয়ে প্রায় অমরত্ব দিয়ে গেছেন, সেটি অবশ্য আসলে ১৮, পটলডাঙা স্ট্রিটে মুখুজ্জেদের রক, চাটুজ্জেদের নয়। চাটুজ্জে-টা গল্পের গরু। তবে তাতে কী বা আসে যায়!
আমহার্স্ট স্ট্রিট থেকে বৈঠকখানার পথে যেতে পটলডাঙার ওই সরু গলিতে সেই রকের আড্ডা এখন কার্যত প্রাণহীন। কিন্তু কিছুটা বাস্তব, কিছুটা লেখকের কল্পনা মিশিয়ে রকের ফিচেল আড্ডার যে সপ্রাণ ছবি টেনিদা ও তাঁর দলবলকে ঘিরে বাঙালির মনে আঁকা হয়ে গিয়েছে, তা চির অমলিন। বাঙালির রকের আড্ডার নস্টালজিয়া তাই কোথায় যেন সেই স্মৃতির পূজার সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। মন বলে ওঠে, সেদিন ভেসে গেছে! হয়তো খুব ভুল নয় কথাটা। পাড়ায় পাড়ায় সেই রকগুলো সত্যিই গেল কোথায়! যেখানে যেটুকু আছে, তাতেই বা ক’জন আজ নিত্য বসার ফুরসত পান?
কিন্তু কেন? খুঁজতে গেলে পাওয়া যাবে এক আর্থ-সামাজিক তত্ত্ব। পুরনো পাড়া কালচার ভেঙেচুরে যাচ্ছে অনেক দিন ধরে। পাড়ার রকওয়ালা বাড়িগুলির জায়গায় দ্রুত মাথা তুলছে বহুতল ফ্ল্যাট। পাশাপাশি বদলে গিয়েছে কাজের জীবন। সকাল থেকে রাত এখন কেরিয়ারের পিছনে লেগে থাকার দিনলিপি। এমনকী পাড়া ছেড়ে ভিন্দেশে পাড়ি। রকে আড্ডার সময় কোথায় এই প্রজন্মের? পুরনো ‘রকবাজদের’ (এই বিশেষণ কিন্তু নিন্দার্থে নয়) অনেকের মুখেই এইসব ব্যাখ্যা শোনা যায় এখন। অনেকে এ-ও বলেন, সত্তরের দশকের গোড়ায় রাজনীতির অস্থির সময়টাও অনেকগুলি রকের আড্ডার শেষ ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে।
হয়তো ভুল, হয়তো ঠিক এই সব মূল্যায়ন। কিন্তু স্মৃতির পাতা ঘেঁটে কলকাতার একজন প্রবীণ আড্ডাবাজ চণ্ডী লাহিড়ী আমাদের শুনিয়েছেন আরও ‘করুণ’ এক কাহিনি। পঞ্চাশের দশকে শহরের কয়েক জায়গায় রক থেকে মেয়েদের দেখে শিস দেওয়ার অভিযোগে তৎকালীন পুলিশ কমিশনার উপানন্দ মুখোপাধ্যায় নাকি রকে বসা ছেলেদের শায়েস্তা করতে বিশেষ বাহিনী গড়েছিলেন। সেই পুলিশ-দল রকে বসা যুবকদের লম্বা চুল দেখলেই কাটিয়ে দিত। আর সেই পুলিশ কর্তার উদ্যোগেই বহু বাড়ির রক এবং খোলা বারান্দায় বড় বড় ধারালো গজাল ও কাচ ভাঙা পুঁতে দেওয়ারও ব্যবস্থা হয়েছিল সেই সময়।
রকের কফিনে পেরেকের বোধহয় সেই সূচনা!
এই আড্ডার বয়স কিন্তু তার চেয়েও বেশি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে-পরে সেই সময় মূলত কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন লোকেরা জড়ো হতেন এখানে। কমিউনিস্টদের কাছে তখন স্বর্গ বলতে সোভিয়েত রাশিয়া। রাজবল্লভপাড়ার এই বামপন্থীদের আড্ডাস্থলটিও তাই অচিরেই চিহ্নিত হল ‘মস্কো’ নামে। বামপন্থী চিত্র-সাংবাদিক শম্ভু বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন এই আড্ডার গোড়ার দিকের এক সংগঠক। তাঁরই সূত্রে বহু নামী নেতাও এখানে এসে বসেছেন।
তখন অবশ্য বসার জন্য এমন বেঞ্চ পাতা ছিল না। আড্ডা চলত ফুটপাথে রাখা সিমেন্টের স্ল্যাবে পিছন ঠেকিয়ে। যাঁর বরাতে সেটুকুও জুটত না, তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই চালিয়ে যেতেন। হাত বাড়ালেই ছিল পটলের চা-তেলেভাজার দোকান। আড্ডা জমানোর পক্ষে সেই দোকানের অবদানও প্রায় ঐতিহাসিক।
সকাল থেকে শুরু হয়ে দফায় দফায় আড্ডা চলত মাঝরাত পেরিয়ে। শুধু মুখগুলি বদলে যেত বয়সের সঙ্গে মানিয়ে। বিভিন্ন সময়ে এই আড্ডায় দেখা মিলেছে মোহিত মৈত্র, অমর মুখোপাধ্যায়, শম্ভু ভট্টাচার্য, হেমাঙ্গ বিশ্বাস থেকে শুরু করে সরোজ দত্ত, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পর্যন্ত অনেকের। দাদা অমরের সুবাদে আড্ডায় এসেছেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়। কয়েকবার দেবব্রত বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী, নির্মলেন্দু চৌধুরীও। আসলে সেই কাল যে গণনাট্যেরও রমরমার।

সমসময়ের বাম-রাজনীতি থেকে গণ-সংস্কৃতি সব কিছু নিয়ে তৈরি হয়েছিল এই আড্ডা-বৃত্ত। বোঝাই যায়, এখানে যাঁরা ভিড় জমাতেন, তাঁরা সকলেই স্থানীয় নন। কিন্তু আলোচনার উৎকর্ষ এবং জমায়েতের চরিত্র তাঁদের টেনে আনত এখানে। শীতের রাতে কাঠের আগুন জ্বেলে গোল হয়ে বসে গা-গরম করে চালিয়ে যেতেন আড্ডাধারীরা।
এই আড্ডার সদস্য ছিলেন চিত্রকর অশোক গুপ্ত। “অশোক গুপ্তের আঁকা বুলগানিন, ক্রুশ্চভের প্রতিকৃতি নিয়ে সে এক বিরাট কাণ্ড!”বলছিলেন গোপাল ঘোষ। সেবার বুলগানিন, ক্রুশ্চভের এলেন কলকাতায়। তখনও ভিআইপি রোড হয়নি। তাই দমদম থেকে শ্যামবাজার হয়ে এই সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ধরেই যেত ভিআইপি-দের কনভয়। মস্কো-র বারান্দা থেকে অশোক গুপ্তের আঁকা রাশিয়ার দুই নেতার বড় বড় ছবি ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই ছবি চোখে পড়ে ওই দুই বিদেশি অতিথির। রাজবল্লভপাড়ার মোড়ে এক মিনিট থেমে যায় তাঁদের কনভয়। “ছবি দেখে এতটাই অভিভূত হয়েছিলেন তাঁরা”, গর্বিত স্মৃতিচারণ এই প্রবীণ ‘মস্কো’ সদস্যের।
সোভিয়েতের ভাঙনের মতো এই মস্কো-র আড্ডাও চেহারা-চরিত্রে আজ অনেকখানি ভেঙেছে। নতুন থেকে নতুনতর প্রজন্মের হাত ধরে বদলেছে আলোচনার গতি-প্রকৃতি। কিন্তু সেই পুরনো বেঞ্চে নতুন মুখের মেলা আজও বসে। এই আড্ডার নেশা এতটাই প্রবল যে, এ পাড়া ছেড়ে চলে যাওয়া কেউ কেউ নিত্য বাস ভাড়া দিয়েও বছরের পর বছর এখানে হাজিরা দিয়ে চলেছেন। তাঁদেরই একজন দিলীপ রায়। যাঁর নিজের কথায়: “বরানগর থেকে রোজ আসতে-যেতে আমি এত দিনে কয়েক লক্ষ টাকা শুধু বাসভাড়াই দিয়েছি। তবু আসছি। আসব।”
নাম-মাহাত্ম্যে আরও এক মস্কো আছে উত্তর কলকাতার আড্ডা জগতে। সেটি আহিরিটোলায়। সেখানে জনৈক শ্যামদা-র রেস্তোরাঁতেও বামপন্থীরা বসতেন বলে লোকমুখে ওই আড্ডাস্থলের নাম হয়ে গেছে মস্কো কেবিন। শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ে এখন উঠে যাওয়া কফি হাউসও ছিল আর এক উল্লেখযোগ্য আড্ডার ঠিকানা। সেই সভা আলো করে থাকতেন মূলত নাট্য-ব্যক্তিত্বেরা।
আসলে আড্ডা ব্যাপারটা যেহেতু সমমনস্কদের সঙ্গ ছাড়া কিছুতেই জমে না, তাই এক একটি আড্ডাস্থল একেকভাবে পরিচিত হয়ে গিয়েছে তার সদস্যদের নিরিখে। মস্কো-র বামপন্থীদের আড্ডার সঙ্গে শ্যামবাজারের কফি হাউসের নাটুকে আড্ডা এইভাবেই আলাদা মাত্রা পায়। ঠিক যেমন ’৫০-এর কলেজ স্ট্রিটে দুই প্রকাশকের দফতরে নিয়মিত আড্ডা বসত তারকা-লেখকদের। প্রকাশনার মহলে প্রবীণ সবিতেন্দ্রনাথ (ভানু) রায়ের স্মৃতিচারণে এমন আড্ডার ছবি রয়েছে। সেইসব সান্ধ্য মজলিশে তিনি দেখেছেন প্রবোধ সান্যাল, প্রমথনাথ বিশী, কালিদাস রায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীতি চট্টোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সজনীকান্ত দাসের মতো ব্যক্তিদের।
কবি-সাহিত্যিকদের আরও কিছু আড্ডা ছড়িয়ে ছিল শহরের এদিক-ওদিক। উদাহরণ: সুনীল-শক্তি-শরৎ-দীপক মজুমদারদের নিয়ে গড়া কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর ‘কলকাতা শাসন করা’ আড্ডা। কিংবা পাইকপাড়ায় অপেক্ষাকৃত বয়স্ক সাহিত্যিকদের আড্ডা। রসে-বশে-নেশায়-পেশায় জমজমাট হলেও সেগুলিকে একেবারে রকে বসা আড্ডা বললে হয়তো পুরোপুরি ঠিক বলা হবে না।
পঞ্চাশের দশকেই উত্তর কলকাতায় তখনকার পরিচিত সাংবাদিকদের একটি আড্ডা বসত হাতিবাগানের কাছে ফড়িয়াপুকুরে অধুনালুপ্ত নগেন্দ্র কেবিনে। সেখানে খবরের কাগজে না-লেখার যোগ্য বিষয় নিয়েই চর্চা হত বেশি। কিন্তু মজলিশের মেজাজে সেই আড্ডা ছিল সব দিকেই বর্ণময়।
এখান থেকে কিছু দূরে বলরাম ঘোষ স্ট্রিটের উপর দাবার আড্ডা কিন্তু আজও সমান সজীব। রাজা আসে, রাজা যায়। বদলায় রাজ্যপাট, দিনকাল। তবে এই পাড়ার বিস্তীর্ণ রকে মন্ত্রী-গজ-ঘোড়া-নৌকোর কিস্তিমাত আজও সমান তালে চলেছে। বর্ষে বর্ষে, দলে দলে গভীর রাত পর্যন্ত দাবাপ্রেমীদের ভিড় জাগিয়ে রেখেছে এক পুরনো ঘরানা।
খেলা ঘিরে এমন আরও কয়েকটি আড্ডা আছে উত্তরে। শ্যামপুকুরের লাহা কলোনিতে ফুটবল ক্লাব শ্যামপুকুর ইউনিয়ন ঘিরে তৈরি হওয়া আড্ডা অনেক চেনা মুখের সাক্ষী। সেখানেও রকে সিমেন্টে বাঁধানো দাবার ছক বুঝিয়ে দেয়, হৃদয়ের কোন গভীরে এর অবস্থান! কিছু দিন হল আরও গোটা দুয়েক দাবার আড্ডা গজিয়ে উঠেছে রাজবল্লভপাড়ার ফুটপাথেও।
বাগবাজার মোড়ের কাছে রামকান্ত বসু স্ট্রিটে সিএবি-র প্রাক্তন কর্তা গৌতম দাশগুপ্তের পৈতৃক বাড়ির উঁচু রোয়াকে আজও যে আড্ডা বসে, তার বয়স কত? গৌতমবাবু বলেন, “আমার বাবাও এই রকে বসে আড্ডা দিয়েছেন। এখন সময় পেলেই আমিও বসি।” এখানেও খেলাই মুখ্য। সকাল থেকে দফায় দফায় আড্ডা চলে। মূল অধিবেশন অবশ্যই সন্ধ্যায়। শেষ হতে রাত দশটা-সাড়ে দশটা। হাতে নয়, মুখে আলোচনা ফুটবল, ক্রিকেট, মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ইত্যাদি।
কিন্তু আড্ডা মানেই তো শুধু ভাবগম্ভীর রাজনীতি, সাহিত্য, নাটক কিংবা ফুটবল-দাবা নয়। আড্ডা তো নির্ভেজাল ফিচলেমিরও ভাণ্ডার! নইলে পটলডাঙার ‘চাটুজ্যেদের রোয়াক’ অমন তীর্থক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে? বাংলা সাহিত্যে ওইরকম একটি আড্ডাতীর্থ উপহার দিয়ে রকের আড্ডাকে বলতে গেলে অস্কার পাইয়ে দিয়েছেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। ভাবুন তো, মধ্যমণি টেনিদাকে নিয়ে পটলডাঙার সেই চারমূর্তির রকবাজি! মাঝে মাঝেই রাগে অথবা অনুরাগে টেনিদার সেই ‘ডি-লা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস ইয়াক্ ইয়াক্’ হুঙ্কার! রক গরম করার এমন উপাদান কি সহজে মেলে?
হ্যাঁ, গল্প হলেও সত্যি। টেনিদা, পটলডাঙা, রোয়াক সব সত্যি। বলতে পারেন, বেশিটাই ঠিক। টেনিদা মানে ২০, পটলডাঙা স্ট্রিটের বাসিন্দা প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। আজ তাঁর বয়স হত তিরানব্বই। তাঁদের বাড়িতে ভাড়াটে হয়ে এসে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় টেনিদাকে যে রকে বসিয়ে প্রায় অমরত্ব দিয়ে গেছেন, সেটি অবশ্য আসলে ১৮, পটলডাঙা স্ট্রিটে মুখুজ্জেদের রক, চাটুজ্জেদের নয়। চাটুজ্জে-টা গল্পের গরু। তবে তাতে কী বা আসে যায়!
আমহার্স্ট স্ট্রিট থেকে বৈঠকখানার পথে যেতে পটলডাঙার ওই সরু গলিতে সেই রকের আড্ডা এখন কার্যত প্রাণহীন। কিন্তু কিছুটা বাস্তব, কিছুটা লেখকের কল্পনা মিশিয়ে রকের ফিচেল আড্ডার যে সপ্রাণ ছবি টেনিদা ও তাঁর দলবলকে ঘিরে বাঙালির মনে আঁকা হয়ে গিয়েছে, তা চির অমলিন। বাঙালির রকের আড্ডার নস্টালজিয়া তাই কোথায় যেন সেই স্মৃতির পূজার সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। মন বলে ওঠে, সেদিন ভেসে গেছে! হয়তো খুব ভুল নয় কথাটা। পাড়ায় পাড়ায় সেই রকগুলো সত্যিই গেল কোথায়! যেখানে যেটুকু আছে, তাতেই বা ক’জন আজ নিত্য বসার ফুরসত পান?
কিন্তু কেন? খুঁজতে গেলে পাওয়া যাবে এক আর্থ-সামাজিক তত্ত্ব। পুরনো পাড়া কালচার ভেঙেচুরে যাচ্ছে অনেক দিন ধরে। পাড়ার রকওয়ালা বাড়িগুলির জায়গায় দ্রুত মাথা তুলছে বহুতল ফ্ল্যাট। পাশাপাশি বদলে গিয়েছে কাজের জীবন। সকাল থেকে রাত এখন কেরিয়ারের পিছনে লেগে থাকার দিনলিপি। এমনকী পাড়া ছেড়ে ভিন্দেশে পাড়ি। রকে আড্ডার সময় কোথায় এই প্রজন্মের? পুরনো ‘রকবাজদের’ (এই বিশেষণ কিন্তু নিন্দার্থে নয়) অনেকের মুখেই এইসব ব্যাখ্যা শোনা যায় এখন। অনেকে এ-ও বলেন, সত্তরের দশকের গোড়ায় রাজনীতির অস্থির সময়টাও অনেকগুলি রকের আড্ডার শেষ ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে।
হয়তো ভুল, হয়তো ঠিক এই সব মূল্যায়ন। কিন্তু স্মৃতির পাতা ঘেঁটে কলকাতার একজন প্রবীণ আড্ডাবাজ চণ্ডী লাহিড়ী আমাদের শুনিয়েছেন আরও ‘করুণ’ এক কাহিনি। পঞ্চাশের দশকে শহরের কয়েক জায়গায় রক থেকে মেয়েদের দেখে শিস দেওয়ার অভিযোগে তৎকালীন পুলিশ কমিশনার উপানন্দ মুখোপাধ্যায় নাকি রকে বসা ছেলেদের শায়েস্তা করতে বিশেষ বাহিনী গড়েছিলেন। সেই পুলিশ-দল রকে বসা যুবকদের লম্বা চুল দেখলেই কাটিয়ে দিত। আর সেই পুলিশ কর্তার উদ্যোগেই বহু বাড়ির রক এবং খোলা বারান্দায় বড় বড় ধারালো গজাল ও কাচ ভাঙা পুঁতে দেওয়ারও ব্যবস্থা হয়েছিল সেই সময়। রকের কফিনে পেরেকের বোধহয় সেই সূচনা!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.