সিনেমা সমালোচনা ২...
শীতের মরসুম ভূতের দখলে
যেখানে বাঘের ভয় থেকে যেখানে ভূতের ভয়...। রয়েল বেঙ্গল রহস্যের পরই ভূতের ভয়ে হাত দিয়েছেন সন্দীপ রায়। আর, গত বছর বড়দিন থেকে (রয়েল বেঙ্গল তখনই রিলিজ করেছিল) এ বছর বড়দিনের মধ্যে ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ বলে একটা ঘটনাও ঘটে গিয়েছে। সুতরাং ভূত যে একটা বড় ভবিষ্যৎ, সে নিয়ে এই মুহূর্তে অন্তত খুব সন্দেহ নেই।
ভূত কয় প্রকার ও কী কী? এ ছবির তারিণী খুড়োর মতে চার প্রকার। শুধু তারিণী খুড়োর মতই বা কেন? আজ অবধি যত ভূত-সাহিত্য লেখা হয়েছে, সেখানে চার প্রকার ভূতই দেখা গিয়েছে। আহা, ভূতের রাজা চটবেন না আশা করি। আমরা এখানে ভূতেদের শ্রেণিচরিত্রের কথা বলছিনেকো। ব্যক্তিচরিত্রের কথাও না। যত রকম মানুষ, যত রকম জীব, তত রকমই তো ভূত! সে হিসেবে হাজার হাজার কোটি কোটি ভূত আছে। তারা প্রত্যেকেই অনন্য, অদ্বিতীয়। তারিণী খুড়ো কেবল ধরিয়ে দিচ্ছেন দৃশ্যত ভূত চার প্রকার ১) অশরীরী আত্মা, মানে যাকে চোখে দেখিনি শুধু বাঁশি শুনেছি। ২) ছায়ামূর্তি, ভূত-কথকতায় বিশেষ জনপ্রিয়। ভূত সম্পর্কীয় অধিকাংশ ওরাল হিস্ট্রি ‘ওই যে ছায়ার মতো কে যেন একটা সরে গেল’ জাতীয় বাক্যবন্ধ ছাড়া অচল। ৩) কঙ্কাল। ৪) নিরেট ভূত অর্থাৎ যার একটা পূর্ণাঙ্গ অবয়ব আছে।
অনাথবাবুর ভয় (সত্যজিৎ রায়), ব্রাউন সাহেবের বাড়ি (সত্যজিৎ রায়) আর ভূত ভবিষ্যৎ (শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়) গল্পগুলো অনেকেরই বহু বার করে পড়া। সুতরাং আলাদা করে বলে দেওয়ার দরকার করে না যে, তিনটে গল্পেই পুরোদস্তুর নিরেট ভূতের কারবার। কিন্তু তিনটে গল্পের মেজাজ এক নয়। এখানে ভূতের ভয়ে ডরনা জরুরি হ্যায়, ডরনা মানা ভি হ্যায়! ‘জরুরি হ্যায়’ পর্বে আছে সত্যজিতের দু’টো গল্প। ‘মানা হ্যায়’-এর জন্য আছেন শরদিন্দু। দেখুন দেখুন, ভূতের আর এক রকম শ্রেণিবিভাগও করা যায় কিন্তু এ থেকে! ভয়াল, ভয়ঙ্কর ভূত আর ভালমানুষ ভূত, ভালবাসার ভূত। ভয়াল ভূতকে আবার দুই প্রকারে ভাঙা যায়। অর্থাৎ কিছু ভূত আছে, যাদের দেখে ভয় হতে বাধ্য! তাদের চেহারাও ভয়ঙ্কর, কাজকর্মও ভয়ঙ্কর। আবার কিছু ভূত আছে তারা আলাদা করে হয়তো ভয়ঙ্কর নয়, কিন্তু যারা তাদের দেখছে তারা ভয়ই পাচ্ছে। অনাথবাবু বা ব্রাউন সাহেবের গল্প এই দ্বিতীয় দলে পড়ছে। অর্থাৎ ভয়ের গল্প হলেও ভয়টা যারা ভূত দেখছে, একান্তই তাদের। ভূত যে তাদের আলাদা করে ভয় দেখিয়েছে বা হাঁউ মাঁউ খাঁউ বলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এমনটা নয়!
ব্রাউন সাহেবের গল্পের কথাই ধরা যাক! ব্রাউন সাহেবের ডায়েরিতে সাইমনের ভূতের কথা পড়েই তো ছুটে গিয়েছিল রঞ্জন (আবির চট্টোপাধ্যায়)। গল্পে ছিল ব্যাঙ্গালোর (এখন বেঙ্গালুরু), এখানে কালিম্পং। ভেবে দেখুন, যে সাইমনের ভূতকে দেখে অত আনন্দ পেতেন ব্রাউন সাহেব, তাকে দেখে রঞ্জন আর তার বন্ধু অনীক (ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়) মায় মিস্টার ব্যানার্জি (বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী) পর্যন্ত কী ভয়ই না পেলেন!
যেখানে ভূতের ভয়
পরাণ, বিশ্বজিৎ, আবির, ভাস্বর
আবার ভূত ভবিষ্যৎ-এ কী দেখলাম? লেখক প্রতাপ সরকার (শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়) প্রথমটা একটু ভয় পেলেও দ্রুত সেটা কাটিয়ে উঠলেন! নন্দদুলালের ভূতকে (পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়) নন্দবাবু বলে ডাকতে লাগলেন! এমনকী মাঝেমধ্যে ফস করে দেশলাই জ্বালিয়ে ভূত ভাগিয়ে দিতেও শুরু করলেন!
সুতরাং যা বলছিলাম, ভূতের ভয় ব্যাপারটাও বড় আপেক্ষিক!
সন্দীপ তাঁর ছবিতে তিনখানি ভুতুড়ে গল্প বলিয়েছেন তারিণী খুড়োর মুখ দিয়ে। অর্থাৎ সত্যজিতের আরও একটি চরিত্র এ ছবিতে উপস্থিত। এটাতেও পরাণই অভিনয় করেছেন (কৌশলে তারিণী খুড়োর সঙ্গে নন্দদুলালের চেহারার সাদৃশ্যের কথাও উল্লেখ করা আছে)। পরাণ প্রথমে ভয়ের গল্প দু’টো বলে নিয়েছেন, অর্থাৎ অনাথবাবু আর ব্রাউন সাহেবের গল্প। জানা গল্পের ক্ষেত্রে ক্লাইম্যাক্সের জন্য টানটান উত্তেজনা থাকে না। বইয়ের পাতা থেকে মনের মধ্যে যে কল্পনা জন্ম নিয়েছিল, সিনেমার পর্দায় তার প্রতিফলন কতটা কী ভাবে হল, সেটাই দেখবেন দর্শক। বই থেকে ছবি হয়ে উঠতে গিয়ে তার কতটা ভাঙাগড়া হল, সেটাও নজর টানবে।
সন্দীপ অবশ্য খুব একটা ভাঙাগড়ার রাস্তায় যাননি। অনাথের গল্পে ট্রেনের বদলে বাস বা ব্রাউনের বাড়ি কালিম্পংয়ে এনে ফেলাটা নেহাতই বহিরঙ্গের বদল। গল্পের মূল চলন বইকেই অনুসরণ করেছে। সে কারণেই বোধহয় প্রথম দু’টি গল্পেই সংলাপের আধিক্য একটু বেশি লেগেছে। বইয়ে অনাথের বর্ণনা ছিল, “ভদ্রলোককে হঠাৎ দেখলে মনে হবে তিনি যেন পঞ্চাশ বছরের পুরনো কোনও নাটকের চরিত্রে অভিনয় করার জন্য সেজেগুজে তৈরি হয়ে এসেছেন।” দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়কে চমৎকার মানিয়েছে তাতে! সেই সঙ্গে স্থানীর ক্লাবের প্রেসিডেন্ট চরিত্রটি নতুন সংযোজন। গল্পে বিক্ষিপ্ত ভাবে স্থানীয় বাসিন্দাদের কথাবার্তার উল্লেখ ছিল। এখানে তাঁদেরই এক জন চরিত্র হয়ে এসেছেন। সেটা এক দিকে বাস্তবসম্মত হয়েছে বটে, কিন্তু অন্য দিকে লেখকের চরিত্রটা (শুভ্রজিৎ দত্ত) কিছুটা নিষ্প্রভ, কম গুরুত্বের হয়ে গিয়েছে। ব্রাউনের গল্পেও আবির-ভাস্বর-বিশ্বজিতের চরিত্রগুলো তাদের আন্তঃসম্পর্ক, রসায়ন, ম্যানারিজম আর একটু জায়গা পেলে ভাল লাগত। বই বন্ধ করে চোখ বুজে লাল মখমলের হাই-ব্যাকড চেয়ারে বসা সাইমনের চেহারা কল্পনা করেছি কত বার! কম্পিউটার গ্রাফিক্সে সেই আমেজ কিন্তু পেলুম না! আর এই দু’টো গল্পেই ক্যামেরার (শশাঙ্ক পালিত) কাছ থেকে আরও বেশ খানিকটা চিত্রভাবনার দাবি ছিল। না রং, না আলো, না ফ্রেম মন ভরল না।
তিন নম্বর গল্পে এসে কিন্তু মোড়টা ঘুরে গেল। শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় আর পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনবদ্য যুগলবন্দিতে তৈরি হল আদ্যন্ত উপভোগ্য এক কমেডি। দু’জনের কমিক টাইমিং হাঁ করে দেখতে হয়! পর্দার তিনটি আখ্যানের মধ্যে সবসেরা নিঃসন্দেহে এটাই। তারিণী খুড়োর এক খুদে শ্রোতার ভাষায়, “জমেছে!” বড়দিনের মরসুম অতএব এ বার ভূতের দখলে!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.