স্মরণ...
ভূত-ভবিষ্যতের দর্শন
অনন্য এক দরদি তার্কিক
কীর্তিমাত্রমূর্তি’। মৃত ব্যক্তিকে স্বর্গত বা পরলোকগত না বলে অভিনব গুপ্ত এই কবিতাঘন শব্দ প্রয়োগ করেছেন ‘প্রয়াত’ বোঝাতে। এক বছর আগে ২৭ ডিসেম্বর ২০১১, অক্সফোর্ড শহরে আমার গবেষণা নির্দেশক স্যর মাইকেল ডামেট এমনই ‘কীর্তিমাত্রমূর্তি’ হয়ে গেলেন। আগেই গত বিশ বছরে আমার লেখাপড়ার জগৎকে অন্ধকার করে দিয়ে একে একে চলে গেছেন বিমলকৃষ্ণ মতিলাল, প্রণবকুমার সেন, বিশ্ববন্ধু তর্কতীর্থ পিটার স্ট্রসন। দার্শনিক হিসেবে এই পাঁচ জন, বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের পাঁচ দিকপাল, সম্পূর্ণ আলাদা পাঁচ রকমের চিন্তার পথ দেখিয়ে গিয়েছেন। আর মানুষ হিসেবে এই পাঁচ জন ছিলেন মস্তিষ্ক এবং হৃদয়, দু’দিক থেকেই অবিশ্বাস্য রকমের উঁচু ও গভীর। যেন পাঁচটা হিমালয়, একই সঙ্গে পাঁচটা মহাসাগর। মাইকেল ডামেটের কীর্তিস্মৃতিতর্পণ করতে বসেছি। মামুলি অর্থে এই অশীতিপর গণিত-ভাষা-দার্শনিকের প্রয়াণকে ঠিক ‘অকালমৃত্যু’ বলা চলে না। বরং অন্তত গত পঞ্চাশ বছর ধরে যে ভাবে সমস্ত শুভানুধ্যায়ীর সতর্কীকরণ অগ্রাহ্য করে অনবরত ধূমপান করতেন, আমরা যে অনেক আগেই তাঁকে হারাইনি, এটাই ভাগ্যের কথা। আমাকে শেষ চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘‘যদি আমাকে এমন প্লেনের টিকিট পাঠাতে পারো যাতে হিথরো থেকে হনোলুলু পর্যন্ত ধূমপান করতে পারি, তা হলে আমি আর হাওয়াই না আসতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ নই।’’
কিন্তু জীবনের শেষ বছরটা পর্যন্ত তিনি দর্শনশাস্ত্রের ও তাঁর সমসাময়িক সমাজের কয়েকটি দুরূহতম সমস্যা নিয়ে যে ভাবে গ্রন্থরচনা করে চলেছিলেন তাতে মনে হয় কখনও মারা যাবেন না ধরে নিয়েই ‘অজরামরবৎ’ তিনি বিদ্যার উপাসনা করতেন।
আজ বিশ্বজোড়া তাঁর বিদ্যাবংশের গবেষণার মাধ্যমে তাঁর চিন্তার তরঙ্গগুলি শঙ্করাচার্য বা কান্টের ভাবশরীরের মতো অমর থাকবেই। উপরন্তু ‘মৃত্যু’ মানে যদি ‘অত্যন্ত বিস্মৃতি’ হয়, তা হলে খুব শিগগির মাইকেল ডামেটের মৃত্যুর সম্ভাবনা কম।
শিল্পী: সুমিত্র বসাক
যদিও তাস খেলার ইতিহাস, ভোট দ্বারা নির্বাচন পদ্ধতির গাণিতিক সমস্যা, প্রমাণিত না হলে সত্য/মিথ্যা কোনওটাই নয় (কাজে কাজেই নির্মধ্যমনীতি লঙ্ঘনকারী) অ-ধ্রুপদী স্বজ্ঞাবাদী লজিক, এবং দেশান্তরে অভিবাসী নিপীড়িত শরণার্থীদের সমস্যা নিয়েও তিনি পৃথক পৃথক প্রামাণিক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, ডামেটের প্রধান কাজ ছিল সত্যতা, আধুনিক লজিকের জনক গট্লব্ ফ্রেগে-র দর্শন এবং মানে-বিষয়ক দার্শনিক সমস্যা নিয়ে। তাঁর ছাত্রবয়সে অক্সফোর্ডে চলছিল গাণিতিক-বৈজ্ঞানিক উৎকট প্রত্যক্ষবাদী দর্শনের বিপরীত প্রতিক্রিয়া। দৈনন্দিন সাদামাটা ভাষা নিয়ে চুলচেরা বিচারের রমরমা। ‘‘দার্শনিকরা ভাষার মায়াজালে প্রতারিত হয়ে বোতলে আটকে পড়া মাছির মতো ঘুরছেন— অথচ শব্দের মানে কোনও মানসিক বা গূঢ়তর অতিজাগতিক তত্ত্ব নয় দৈনন্দিন প্রয়োগ ও ব্যবহারের রকমসকমই হল শব্দের অর্থ” পরমার্থতত্ত্বের মৌচাকে এই সব আত্মসমালোচনার ঢিল মেরে দার্শনিক লুডউইগ হ্বিটগেনস্টাইন কেমব্রিজে মারা গেলেন। এ দিকে ফ্রেগের ‘পাটিগণিতের ভিত্তিসমূহ’ নামক বইয়ের প্রাঞ্জল ইংরেজি অনুবাদ করেও, প্লেটো-অ্যারিসটট্ল-এর প্রগাঢ় পণ্ডিত জে এল অস্টিন তখন মাত্র বাক্য উচ্চারণ করার দ্বারা, শুধু জগৎকে বর্ণনা করা নয়, আদেশ করা, প্রশ্ন করা, প্রতিজ্ঞা করা, অভ্যর্থনা করা, আশীর্বাদ করা, বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে বিয়ে করা (ও তালাক দেওয়া), এমনকী মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার মতো কাজও আমরা কী ভাবে করে থাকি, তার বিশ্লেষণ ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শ্রেণিবিভাগ করাই দর্শনের কাজ এই মতাদর্শের একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করে চলেছেন। ডামেট অস্টিনকে শ্রদ্ধা করতেন, কিন্তু তাঁর উচ্চাশা ছিল লজিকের মূল ভিত পর্যন্ত খুঁড়ে সত্তাশাস্ত্র তথা মেটাফিজিক্সকে ভাষা দর্শনের মানে-তত্ত্বের মাধ্যমে একটা স্পষ্ট যৌক্তিক কাঠামো দেবেন।
“ডামেট সিগারেট না খেতে খেতে অন্তত একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন” এই অতীতবিষয়ক বাক্যটিকেই ধরা যাক। বাক্যটি সত্য কি মিথ্যা আমরা কোনও দিন নিশ্চিত জানতে পারব না। তবু যে অতীত ঘটনাটির সুবাদে এই বাক্যটি সত্যি (যদি সত্যি হয়ে থাকে) অথবা যে ঘটনাবলির সুবাদে বাক্যটি মিথ্যে (যদি মিথ্যে হয়ে থাকে)— সেই ঘটনা বর্তমানে ঘটছে না বলেই অস্তিত্বহীন অলীক তো নয়। তথাগত বুদ্ধের বাঁ কানের পেছনে তিলটার থাকা বা না থাকার মতো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া ভূতকাল বিষয়েও আমরা, অধিকাংশ মননশীল মানুষই, বাস্তববাদী। কোনও একটা বিষয়ে বাস্তববাদী হওয়ার এই অর্থটাই প্রথম আবিষ্কার করেন মাইকেল ডামেট। আমাদের জানা না জানার ওপর ওই জাতীয় পদার্থের ‘থাকা না থাকা’ নির্ভর করে না, এটা তো বাস্তববাদের পুরনো লক্ষণ। নতুন ভাবে ডামেট বললেন এক জাতীয় বাক্যের বিষয়ে— আমাদের প্রমাণ করার বা অভিজ্ঞতাসিদ্ধ সাক্ষ্যযুক্তি দেওয়ার ক্ষমতা না থাকলেও, বাক্যটির বস্তুত সত্য হওয়ার শর্ত জানাই তার মানে জানা— এই দৃষ্টিরই নাম ‘বাস্তববাদ’ (রিয়ালিজম্)।
তিনটি বড় বড় দার্শনিক বিতর্কের দৃষ্টান্ত নেওয়া যাক।
বাহ্য জগৎ বিষয়ে বাস্তববাদ বনাম ভাববাদ। বাস্তববাদ বলে: জগৎটা বস্তুত এমনই যে আমরা কেউই যখন তাদের দেখি না বা তাদের কথা ভাবি না, তখনও জগতের বাহ্য জড় পদার্থগুলি থাকে, তাদের নিজস্ব সত্তা ও স্বার্থ বজায় রেখে। ভাববাদ এর ঠিক উল্টো কথা বলে, ‘‘আমারই চেতনার রঙে পান্না সবুজ হয়, আমরা ‘লাল’ বলতে কী বুঝি তার ওপর নির্ভর করে গোলাপের লাল হওয়া।’’ ডামেট এই বিতর্ককে ঢেলে সাজলেন। ‘ও ঘরে টেবিলের ওপর জলের গ্লাস আছে’ এই বাক্যটি ‘বোঝা’ বলতে যদি আমরা ধরি, কী করে বাক্যটিকে সমর্থক ইন্দ্রিয়জপ্রত্যক্ষমূলক প্রমাণ দিয়ে সিদ্ধ করতে পারি তা জানা তা হলে বাহ্য জগৎ বিষয়ে আমরা বাস্তববাদী নই।
দেহাতিরিক্ত অন্তরাত্মাতে বিশ্বাস বনাম অনাত্মবাদী বাহ্য আচরণমাত্রে বিশ্বাস। যাঁরা বলেন ‘তপতী রেগে আছে’ এই মানসিক অবস্থা বিষয়ক বাক্যটিকে ভ্রুকুঞ্চন, রূঢ় ভাষা, তর্জনগর্জন, মুখরক্তিমা, এ সব বাহ্য আচরণ দ্বারা প্রমাণ করা যাক না যাক এটা হয় সত্যি অথবা মিথ্যে এমনকী তপতীরও স্বীকৃতি-অস্বীকৃতির অপেক্ষা না রেখেই তপতীর অন্তর-আত্মার মধ্যে ক্রোধ নামক অবস্থাটি থাকা না থাকার সুবাদে তাঁরা মনের বিষয়ে বাস্তববাদী। আর যাঁরা ‘ক্ষণিকা’য় রবি ঠাকুরের মতো অথবা মার্কিন আচরণবাদী মনোবৈজ্ঞানিকদের মতো বলেন, ‘বাইরে যা পাই সম্ঝে নেবো তারই আইন কানুন চাইনে রে মন চাইনে’, তাঁরা হলেন মনকে বাহ্য আচরণে পর্যবসিত করে মনের অবস্থা বিষয়ক ভাবগুলি বিষয়ে অ-বাস্তববাদী। অ-বাস্তববাদ অনেক সময়েই এ-রকম পর্যবসানবাদের (রিডাকশনিজম্-এর) আকার নেয়। যেমন প্রাচীন বৌদ্ধ মত আত্মবিষয়ক কথাকে দেহ, বিজ্ঞান, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার এই পাঁচটা ব্যাপারের ক্ষণিক অবস্থার ধারাপ্রবাহের বিষয়ক কথাতে পর্যবসিত করে, স্থায়ী আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করত।
সংখ্যা বিষয়ক বাস্তববাদ বনাম তদ্বিরোধী গণনাসাপেক্ষতা-বাদ। এক, দুই, তিন থেকে শুরু করে অসীম পর্যন্ত যে প্রাকৃতিক সংখ্যাগুলির দ্বারা আমরা সাধারণ জিনিসপত্রের গণনা করি সেগুলি আমরা কোনও দিন কিছু না গুনলেও এবং জগৎ থেকে চৈতন্য মুছে গেলেও (প্লেটো প্রস্তাবিত) নিত্যসিদ্ধ বিমূর্ত জগতে থাকে এ কথা যাঁরা বলেন তাঁরা সংখ্যা বিষয়ে বাস্তববাদী। যাঁরা বলেন, না, পাটিগণিতের বাক্যগুলি, যথা ‘পাঁচ আর তিনে আট হয়’, সত্য হয় কেবল এই অর্থে যে আমাদের কাছে এগুলিকে প্রমাণিত করবার একটা সর্বসম্মত পদ্ধতি আছে, প্রমাণীকরণ থেকে আলাদা এদের কোনও সত্য মিথ্যা হওয়ার শর্ত থাকতেই পারে না, তাঁরা হলেন গাণিতিক বচন বিষয়ে অ-বাস্তববাদী। আমাদের গণনা কলনার সচেতন সযৌক্তিক ক্রিয়াই সংখ্যাসম্বন্ধী ‘সত্য’গুলিকে ‘বানায়’। অ-বাস্তববাদীদের এটাই বক্তব্য।
এই ভাবে দর্শনের অনেকগুলি মূল সমস্যাকে এক একটি নির্দিষ্ট বিবাদাস্পদ বিষয়ে বাস্তববাদী বনাম অ-বাস্তববাদী মানে-তত্ত্বের মধ্যে বিতর্ক হিসেবে মাইকেল ডামেটই সর্বপ্রথম সাজলেন।
অতীত ও অনাগত জিনিসও, যতই ক্ষণিকের জন্য হোক, অস্তিত্ববান বলেই মনে করতেন সর্বাস্তিবাদী প্রাচীন ভারতীয় বৌদ্ধ তত্ত্ববিদরা। বসুবন্ধু তাঁদের খণ্ডন করে কী কথা বলেছিলেন অভিধর্মকোষভাষ্যে, ডামেট তা পড়ে উঠতে পারেননি। কিন্তু আজ যখন ডামেট নিজেই এক জন অতীতের বাসিন্দা হয়ে গিয়েছেন তখন অতীত কালে কথিত বাক্যগুলি কী অর্থে এখনও দ্বিকোটিক ভাবে সত্য অথবা মিথ্যা, ভবিষ্যতে পুরাতত্ত্ববিদ্রা তার বিষয়ে কী প্রমাণ দেবেন না দেবেন তার ওপর নির্ভর করে অথবা না করে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলতে আমাদের পথপ্রদর্শক হবে ডামেটেরই লেখা শেষ দিককার বই ‘সত্য এবং অতীত’, যা কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে জন ডিউই বক্তৃতামালা হিসেবে তিনি দিয়েছিলেন একুশ শতকের প্রথমে। ওঁর কাছে গবেষণা শেষ করার এগারো বছর পরেও আমি যখন ‘ভবিষ্যৎ কি আছে না নেই?’ এই বিষয়ে দীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা করি, তখন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে তিনি দীর্ঘ চার পৃষ্ঠা টাইপ করা মন্তব্য পাঠিয়েছিলেন। আসলে এক দিকে ঈশ্বরবিশ্বাসী হয়েও, ভবিষ্যৎ বিষয়ে বাস্তববাদী হওয়া মানেই যা হওয়ার তা ঠিক হয়েই আছে এ-রকম একটা পূর্বনির্ধারণবাদী তিনি হতে চাননি। এক জন সর্বজ্ঞ ঈশ্বর কী করে এখনও যা উন্মুক্ত ঘটবে কি ঘটবে না এমন ভবিষ্যৎ বিষয়ে নিশ্চিতজ্ঞানবান হতে পারেন, এই সমস্যা তাঁকে শেষ পর্যন্ত ভাবাত। লৌকিক কথাতে তো আমরা ‘কেউ জানে না’ বোঝাতেই বলি, ‘ভগবান জানে’। অথচ যা হওয়ার তা যদি ভগবান আগে থেকেই জানেন তা হলে আমরা যে এত ঝঞ্ঝাট করে স্বাধীন ভাবে ঠিক করি, নির্ধারণ করি কোন কাজটা করব আর কোন কাজটা করব না যে স্বাধীনতার ভিত্তিতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের রাজনীতি ও কর্তৃত্ব-দায়িত্বের ন্যায়অন্যায় বিচার, দণ্ডপুরস্কারযোগ্যতা, আমাদের আচরণ ও জীবনকে চালনা করছে সেই স্বাধীনতাই তো একটা ভাঁওতা, একটা ‘মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদে’ দাঁড়িয়ে যাবে! আজকাল আমরা গভীর দার্শনিক চিন্তাকে ততটা পাত্তা দিই না। শুধু নীরস নয়, নেহাত অপ্রয়োজনীয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির তুলনায় ‘নিরর্থক’ (এর থেকে কোনও অর্থ রোজগার হয় না) বলে তাচ্ছিল্য করি। অনেক দার্শনিকও তাই সত্তাশাস্ত্র বা প্রমাণশাস্ত্রের সমস্যার সমাধান পদার্থবিদ্যা বা মস্তিষ্কস্নায়ুবিজ্ঞানের কাছে আশা করেন। গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানে যথেষ্ট ব্যুৎপন্ন ও শ্রদ্ধাশীল হয়েও ডামেট কিন্তু চাইতেন বিশুদ্ধ দার্শনিক বিশ্লেষণের দ্বারা আমাদের যুক্তিনিয়মগুলির ও বিশ্বপ্রকৃতি তথা মানবপ্রকৃতির তত্ত্বনির্ণয়ের সাধনাতে ব্যাপৃত থাকতে।
এর থেকে যদি কেউ ভেবে নেয় যে, ডামেট চারপাশের সমাজ ও মানুষের, রাষ্ট্রের ও ব্যক্তির দুঃখ-দুর্দশা বা অন্যায়-অত্যাচারের প্রতি উদাসীন গজদন্তমিনারবাসী এক জন বুদ্ধিজীবী ছিলেন তা হলে মারাত্মক ভুল করা হবে। ১৯৭৩ সালে প্রথম ফ্রেগের ভাষাদর্শনের ওপর প্রায় সাতশো পৃষ্ঠার বই প্রকাশ করার সময়ে তিনি লিখেছিলেন যে, এই বইয়ের কাজ আরও দশ বারো বছর আগে শেষ করতে পারতেন। কিন্তু দার্শনিক পুস্তক ছাপানোর থেকে অনেক বেশি জরুরি যে কাজ ইংল্যান্ডের সমাজে অশ্বেতাঙ্গ কালো ও খয়েরি চামড়ার মানুষদের ওপর যে অকথ্য নির্যাতন ও অবিচার চলেছিল বিশেষত কনজার্ভেটিভ পার্টির রাজত্বকালে তার বিরুদ্ধে দলবদ্ধ ভাবে, ও পত্নীর সঙ্গে একসঙ্গে লেখালিখি ও প্রতিবাদ করবার জন্য তিনি দার্শনিক গ্রন্থরচনার কাজ স্থগিত রেখেছিলেন। ১৯৮১ সালে ওই মহাগ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় তিনি চরম নৈরাশ্যের সঙ্গে লিখেছিলেন: ‘‘দুঃখের বিষয়, পরিস্থিতি এখন ঠিক যতটা ভবিষ্যদ্বাণী করা যেত ততটাই আরও খারাপের দিকে নেমে গেছে। আজ কালো আর সাদা মানুষরা দুটো আলাদা ব্রিটেনে বাস করে। অধিকাংশ সাদা লোকেদের কোনও ধারণাই নেই সেই জীবনের, যা কালো মানুষদের পক্ষে দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার বিষয়। দিনে দিনে যে আরও ঘন ঘন জাতিবর্ণবৈষম্যমূলক হত্যাকাণ্ড এবং কালো মানুষদের জমি বাড়ি সম্পত্তির ওপর হামলা বেড়েই চলেছে, সে বিষয়ে, সাদা পুলিশের কালো দরিদ্র জনতার ওপর ক্রমবর্ধমান পাশবিক অত্যাচার বিষয়ে শ্বেতাঙ্গ ইংরেজরা সম্পূর্ণ উদাসীন এবং অজ্ঞ।’’
বছর তিরিশেক আগেই ডামেট নিজের ইংরেজ রাজনৈতিক নেতাদের অমানবিক বর্ণবৈষম্যের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করার দিকে সখেদ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। লিখেছিলেন, ‘‘বর্তমান ইংল্যান্ডে পরবাসী কৃষ্ণাঙ্গরা সম্মান এবং আশার ন্যূনতম জায়গাটুকুর থেকেও বঞ্চিত বোধ করে। এ যাবৎ তারা অত্যন্ত ধৈর্যশীল থেকেছে। যে সমাজ তাদের দুঃখদুর্দশার প্রতি একান্ত উদাসীন, বহু অবিচার এবং আক্রমণের শিকার হয়েও সেই সমাজে তারা থেকেছে প্রায় সর্বদাই আইন-অনুবর্তী সহনশীল নাগরিক।... এক বার যদি ওদের ধৈর্যচ্যুতি হয় অবস্থা হয় খুব দ্রুতগতিতে খারাপ হয়ে পড়বে অথবা চেতনা ফিরে এসে সমাজ আর একটু মানবিক ও সুষম (অতিথিবৎসলও) হয়ে উঠতে পারে।’’ এর কুড়ি বছর পর ‘অন ইমিগ্রেশন অ্যান্ড রিফিউজিস’ নামক এক স্বতন্ত্র গ্রন্থে ডামেট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্সকে সাবধান করে উচ্চারণ করেন: ‘‘যারা নিজের দেশের সহজাত নাগরিক নয় তাদের প্রতিও একটি রাষ্ট্রের কর্তব্য ও দায়িত্বের পশ্চাতে রয়েছে একটি সরল সহজ ভিত্তিসূত্র। তারা প্রত্যেকেই সহজীবী মানুষ।’’ (পৃ ৪৯)
যে ইউরোপ ধর্মপ্রচারের নাম করে গায়ের জোরে আর ব্যবসায় মুনাফা করার অজুহাতে আমেরিকা এশিয়ায় উপনিবেশ স্থাপন করে, আর নিজেদের দ্বারা নির্যাতিত অবাঞ্ছিত ইহুদিদের প্যালেস্টাইনের ‘পুণ্যভূমি’তে বসিয়ে দিয়ে এক দিকে ভেদনীতি ও যুদ্ধবাজিকে ধূমায়িত রেখে অন্য দিকে ইহুদি-মুসলমানের শান্তিস্থাপনের নাটক করে চলেছে, তাদের দিকে ফিরে তিনি যেন চণ্ডীদাসের মতো বলে উঠেছেন, ‘শুনহ মানুষ ভাই’, কাঁটাতার আর বন্দুকধারী সিপাই বসিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে মেক্সিকোর বিধ্বস্ত অর্থনীতি থেকে পালিয়ে আসা যথার্থ আদি আমেরিকানদের অন্তত শরণার্থীর প্রাপ্য দরদটুকুও যদি তোমরা না দেখাও, তা হলে ধিক তোমাদের বিদ্যাবুদ্ধি বিজ্ঞান উন্নতিতে, ধিক তোমাদের যুদ্ধবিরোধিতার ছুতোতে বানানো পারমাণবিক অস্ত্রাগারে, ধিক তোমাদের সভ্যতার অহংকারে।
শেষ দিকে ডামেট চেয়েছিলেন স্পষ্ট করে দেখাবেন, সত্যতা বিষয়ে তাঁর দার্শনিক যুক্তিতর্ক আর সংখ্যালঘু জাতিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে তাঁর জীবনব্যাপী সংগ্রামের গল্প, দুইয়ের মধ্যে যোগাযোগ কোথায়। কিছু দিন আগে আমি এই পত্রিকাতেই, মহাভারতের উক্তি মনে রেখে সত্য আর সমতার সম্পর্ক দেখাতে চেয়েছিলাম। সত্য কাকে বলে, তার ডেফিনিশন খোঁজার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহারিক ও সামাজিক জীবনে মিথ্যাচার সহ্য না করাও ডামেটের ব্রত ছিল। শিক্ষক হিসেবে ছিলেন বেশ রাগী ও কঠোর সমালোচক। অথচ অক্সফোর্ডের এগজামিনেশন স্কুলস-এর সামনে বা পাশে ‘লজিক লেন’ (বেনারসের অন্তত একটি গলির নাম ‘ন্যায়-গলি’ হলে ভাল হত!) নামক রাস্তায় জ্বলন্ত সিগারেট হাতে ডামেটবাবুর প্রাণখোলা হা হা হাসিও শোনা যেত আকছার। তীক্ষ্নতম বুদ্ধি আর উদারতম হৃদয়, স্বজাতিবর্গের প্রতি কঠোর আত্মসমালোচনার বিনম্র অহংকার ও ভারতীয় দর্শনের প্রতি সশ্রদ্ধ কৌতূহল, আন্তর্জাতিক আতিথেয়তা ও বিবিধবৈচিত্রময় সমাজে বহু মতামতের বিতর্কের মধ্য দিয়ে সত্যের ও কালের স্বরূপ সন্ধান এই সব কিছু মিলে মাইকেল ডামেট ছিলেন তাঁর নিকটতম ছাত্রছাত্রীদের কাছেও এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব। ভেতরে ভেতরে ফ্রেগের থেকেও ভালবাসতেন আসলে হ্বিটগেনস্টাইনকে। তাঁর পূজিত গণিত-দার্শনিক ফ্রেগে ব্যক্তিগত জীবনে এক জন ইহুদিবিদ্বেষী ছিলেন, এ কথা জানতে পেরে তাঁর বুক ভেঙে গিয়েছিল।
বিমলকৃষ্ণ মতিলালের গুণগ্রাহী ডামেট আমাকে অনুপ্রেরিত করেছিলেন ভারতীয় দর্শনের তর্ককর্কশ বিশ্লেষণী দিকটি আরও ভাল ভাবে অধ্যয়ন করে বিশ্বের দর্শনের দরবারে উপস্থাপিত করার জন্য। তা এখনও করে উঠতে পারিনি। কিন্তু এক দিকে যথার্থ বাক্যের লক্ষণ ও মানে-তত্ত্বের গবেষণা, অন্য দিকে উৎকট বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সত্য ও সমতার পরস্পরের সম্পর্ক অন্বেষণ করতে গিয়ে একটুও সাফল্যের অহংকার ভেতরে জাগলেই দু’দশ পাতা ডামেটের লেখা পড়লে তা চূর্ণ হয়ে যায় আজও। ছাত্রের বুদ্ধিদর্প নাশ করে কীর্তিমাত্রশরীর মাইকেল ডামেট আজও আমাদের অধ্যাপনা করে চলেছেন। সাদা চুল মাথা থেকে সরিয়ে সিগারেটের ছাই একটু ফেলে দিয়ে চকচকে তীব্র চোখে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আমার যুক্তিতে বড় বড় ফুটো দেখিয়ে হোহো করে হেসে বলছেন ‘অরিন্দম, আর একটু ধীরে ধীরে ভাবো, সমস্যাটার মূল জায়গাটাই এখনও ধরতে পারোনি!’

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াই, মানোয়া’য় দর্শনের শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.