পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণকাণ্ডের মূল অভিযুক্তকে এখনও ধরতে পারেনি পুলিশ। তবে ঠাকুরপুকুরের পরিত্যক্ত বাসে মহিলার নির্যাতনকারীকে ধরে দিয়েছিলেন এলাকার মানুষই। সকলের সামনে তাকে প্রিজন ভ্যানেও তোলা হয়। কিন্তু এখন পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, পুলিশের হাত থেকেই সে পালিয়ে গিয়েছে।
ঠাকুরপুকুর থানা থেকে ওই অভিযুক্তের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে অবশ্য উঠেপড়ে লেগেছেন পুলিশ কর্তাদের একাংশ। মঙ্গলবার ডিসি (এসডব্লুডি) সুব্রত মিত্র বলেছিলেন, স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযুক্তকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার আগেই সে পালিয়ে যায়। বুধবার তিনি বলেন, “কাল যা বলেছি, তার পরে আর কোনও কথা বলব না।” একই সুরে এ দিন কথা বলেছেন এলাকার পুলিশ অফিসারেরাও। তবে এ ব্যাপারে এ দিন কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) জাভেদ শামিম, ডিসি (ডিডি-স্পেশাল) সন্তোষ পাণ্ডে কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
কী ঘটেছিল সোমবার রাতে?
ঠাকুরপুকুরের কদমতলার বাসিন্দারা অভিযোগ করেছিলেন, রাত পৌনে ১১টা নাগাদ ডায়মন্ডহারবার রোডে একটি পরিত্যক্ত বাসে মাঝবয়েসী ওই মহিলার উপর নির্যাতন করে এক যুবক। অভিযুক্তকে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেন বাসিন্দারা। তাঁদের মধ্যেই ছিলেন অলিভিয়া রহমান ও সানি সিকদার। তাঁরা বলেন, “অভিযুক্ত যুবক ও মহিলাকে প্রিজন ভ্যানে তুলে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। কিছু ক্ষণ পরই দেখা যায়, যুবকটি ওই রাস্তা দিয়েই হেঁটে যাচ্ছে। তাড়া করেও তাকে আর আর ধরা যায়নি।” |
পুলিশের একাংশের বক্তব্য, ওই রাতে মহিলা এবং অভিযুক্ত যুবককে প্রিজন ভ্যানে তোলা হয়। যুবকটির পরনে ছিল সোয়েটার। প্যান্টের বদলে সে লুঙ্গির মতো করে একটি চাদর পরেছিল। স্থানীয় বাসিন্দারা যুবকটির সাইকেল, প্যান্ট, মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ পুলিশের হাতে তুলে দেন। ভ্যানেই ওই যুবককে তার প্যান্ট পরতে বলা হয়। থানায় নিয়ে যাওয়ার পর ভবঘুরে ওই মহিলার সঙ্গে কথা বলে পুলিশ। পুলিশের দাবি, ওই সময়ে মহিলার আচরণ কিছুটা অসংলগ্ন ছিল। পুলিশ জানায়, মহিলার কথাবার্তা ঠিকমতো বোঝা যায়নি। দুর্গন্ধযুক্ত, নোংরা এবং ময়লা পোশাক থাকায় মহিলাকে থানার এক পাশে বসিয়ে রাখা হয়। পরে তাঁকে মেডিক্যাল পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয় এসএসকেএম হাসপাতালে। ইর্মাজেন্সির দায়িত্বে থাকা চিকিৎসক রাত তিনটে নাগাদ তাঁকে পরীক্ষা করেন বলে পুলিশের দাবি। পুলিশ জানায়, ওই মহিলা নিজেও ধর্ষণের অভিযোগ করেননি। ডাক্তারি পরীক্ষাতেও ধর্ষণের চিহ্ন মেলেনি। তাই যুবকের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ দায়ের করা হয়।
এই ব্যাপারেও ক্ষোভ জানিয়েছেন এলাকার মানুষ। তাঁদের অভিযোগ, “যুবকটি ধর্ষণই করেছে। মহিলা মানসিক ভারসাম্যহীন। তাই তাঁকে দিয়ে পুলিশ নিজের মতো করে বয়ান লিখিয়েছে।” তাঁদের প্রশ্ন, ঘটনার পর ওই মহিলাকে কেন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করিয়ে গোপন জবানবন্দি নেওয়া হল না? ঘটনার দু’দিন পরে বুধবার পুলিশ জানিয়েছে, আদালতে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে গোপন জবানবন্দি করানোর আর্জি জানানো হয়েছে। শীঘ্রই ওই জবানবন্দি নেওয়া হবে।
কী করে পুলিশের হাত থেকে পালাল অভিযুক্ত যুবক?
পুলিশের একটি সূত্রে জানা গিয়েছে, অভিযুক্ত যুবক মদ্যপ ছিল। হিন্দি এবং বাংলায় প্রশ্ন করলে সে-ও অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছিল। তদন্তের কারণে, অভিযুক্তের মোবাইল ফোন, ম্যানিব্যাগ রেখে দেন পুলিশকর্মীরা। পুলিশের বক্তব্য, মহিলার কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না-পাওয়ায় তখন অভিযুক্ত মদ্যপ যুবককে লক-আপে ঢোকানো হয়নি। তার দিকে সে ভাবে নজরও রাখেননি কর্তব্যরত পুলিশকর্মীরা। তাঁদের গা ছাড়া মনোভাবের সুযোগে ওই যুবক পালিয়ে যায় বলে পুলিশের একাংশ জানায়।
|
এই প্রিজন ভ্যান থেকেই অভিযুক্ত পালিয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ। |
পুলিশের কাছ থেকে পালাবার পর কিছু বাসিন্দা থানায় জানান, তাঁরা যুবকটিকে রাস্তা দিয়ে যেতে দেখেছেন। তাঁদের অভিযোগ, পুলিশ জেনেশুনে অভিযুক্তকে ছেড়ে দিয়েছে। অভিযোগ শুনে প্রমাদ গোনে পুলিশ। তড়িঘড়ি মিটমাটের চেষ্টা করা হয়। কদমতলার বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, পুলিশ একটি কাগজে এলাকার কয়েক জনকে স্বাক্ষর করতে বলে। তাতে লেখা ছিল, স্থানীয় বাসিন্দাদের হাত থেকেই অভিযুক্ত পালিয়ে গিয়েছে। কিন্তু সই করতে রাজি হননি বাসিন্দারা। এর পরেই যুবককে ধরতে উঠেপড়ে লাগে পুলিশ।
লালবাজার সূত্রের খবর, অভিযুক্ত যুবকের নামও স্পষ্ট ভাবে জানা যায়নি। তবে থানায় জমা রাখা মোবাইল ফোন থেকে কিছু নম্বর মিলেছে। এলাকার এক বাসিন্দা ধরা পড়ার পরে অভিযুক্তের ফটো মোবাইলে তুলেছিলেন বলে পুলিশকে জানান। ওই ফটোটিও সংগ্রহ করেছে পুলিশ। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, অভিযুক্তের বাড়ি বিহারে। তাকে খুঁজতে সেখানে রওনা হয়েছে কলকাতা পুলিশের তদন্তকারীরা। স্থানীয় সূত্রের খবর, ঠাকুরপুকুরের রামকৃষ্ণনগরের মাঝিপাড়ায় ভাড়া ঘরে থাকে বিহারের মোতিহারির বাসিন্দা ঠিকামজুর সোনালাল মহতো। দিন দশেক আগে তাঁর কাছে এসেছিল বছর ২৮-৩০ বয়সী অভিযুক্ত ওই যুবক। এ দিন ওই ঘরে গিয়ে দেখা যায়, সেটি তালাবন্ধ রয়েছে। প্রতিবেশী রাজু মাহাতো জানান, মঙ্গলবার সকাল থেকেই বেপাত্তা সোনালালরা। পুলিশও বেশ কয়েক বার তাদের খোঁজে গিয়েছিল বলেও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে।
এ দিনও থানা থেকে অভিযুক্তকে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগে ঠাকুরপুকুর থানার সামনে বিক্ষোভ দেখান অন্না হাজারের ৩০-৪০ জন সমর্থক। ঠাকুরপুকুর থানার সামনে কালো পতাকা নিয়ে বিক্ষোভ করেন তাঁরা। থানায় স্মারকলিপিও জমা দেওয়া হয়।
|