পর্যটন গড়ার লক্ষ্যে উৎসবের আয়োজন। অথচ উপেক্ষিত থাকছে পর্যটনই। দীর্ঘ ছ’বছর ধরেই এই অভিযোগ রয়েছে পুরুলিয়া জেলার মানুষের। কিন্তু সপ্তম বারের ‘জয়চণ্ডী পাহাড় পর্যটন উৎসব’-এর মুখে বোধহয় সেই প্রশ্নের উত্তর মেলার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
কাল, শুক্রবার শুরু হচ্ছে ওই উৎসব। তার আগে পুরুলিয়ার জয়চণ্ডী পাহাড়কে ঘিরে পর্যটন কেন্দ্র গড়ার প্রাথমিক কাজ জোরকদমে শুরু হয়েছে। জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, জয়চণ্ডী পাহাড়কে ঘিরে পযর্টন পরিকাঠামোর উন্নতির জন্য ৭৬ লক্ষ টাকার প্রকল্প জমা পড়েছে। ইতিমধ্যেই ২৬ লক্ষ টাকা মঞ্জুর করেছে রাজ্য সরকার। রঘুনাথপুরের মহকুমাশাসক প্রণব বিশ্বাস জানান, জমি চিহ্নিত করা-সহ পর্যটনকেন্দ্র গড়ার প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। উৎসব কমিটির সম্পাদক সুকুমার মণ্ডল জানান, পাহাড়ের সৌন্দর্যায়নের লক্ষ্যে সবুজায়নের কাজও চলছে। রাস্তা, জলের ব্যবস্থা করতে নির্দিষ্ট প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে প্রশাসনকে। সব মিলিয়ে জয়চণ্ডী পাহাড়কে ঘিরে একটা উদ্যোগ এলাকার মানুষের চোখে পড়ছে।
পাহাড় লাগোয়া আদ্রা-আসানসোল রেলশাখায় ছবির মতো জয়চণ্ডীপাহাড় স্টেশন। পাশ দিয়ে রঘুনাথপুরের বুক চিরে চলে গিয়েছে বরাকর-পুরুলিয়া রাজ্য সড়ক এবং রঘুনাথপুর-আদ্রা সড়ক। এহেন যোগাযোগ ব্যবস্থার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা পাথুড়ে পাহাড় জয়চণ্ডী পযর্টক ও ট্রেকিং দলের কাছে দীর্ঘ দিন ধরেই আকর্ষনীয়। শীতের শুরু থেকেই পাহাড়ে আনাগোনা শুরু হয়ে যায় পর্যটক ও ট্রেকারদের। সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবির শু্যটিংয়ের অনেকটা অংশই জুড়ে ছিল এই পাহাড়। বস্তুত, এখানে যে পর্যটন উৎসব হচ্ছে, তার স্লোগানই হল ‘আসুন হীরক রাজার দেশে’। |
এ ভাবেই উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠেন জয়চণ্ডী পাহাড় লাগোয়া এলাকার মানুষেরা। ফাইল চিত্র। |
পর্যটনকে ঘিরেই পুরুলিয়া বাংলার এক নম্বর জেলা হয়ে উঠতে পারে, একাধিকবার বলছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অযোধ্যা পাহাড়ের পাশাপাশি পাকবিড়রা, তেলকুপি ও জয়চণ্ডীকে নিয়ে একটি পৃথক ‘ট্যুরিজম সার্কিট’ গড়ে তোলার কথা জেলায় এসে ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। শুধু তাই নয়, জঙ্গলমহলের তিন জেলাকে পযর্টনে যুক্ত করে ঝাড়গ্রাম থেকে বিষ্ণুপুর, জয়চণ্ডী হয়ে অযোধ্যার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা প্রস্তাবিত করিডরের।
ঘটনা হল, রঘুনাথপুর শহরের প্রান্তে জয়চণ্ডী পাহাড়ে পর্যটনকেন্দ্র গড়ার লক্ষ্যে ছ’বছর আগে শুরু হয়েছিল ‘জয়চণ্ডী পাহাড় পর্যটন উৎসব’। মূলত সিপিএম সাংসদ বাসুদেব আচারিয়ার উদ্যোগে উৎসব শুরু হলেও পর্যটনকেন্দ্র গড়ার বিষয়টিই এত দিন উপেক্ষিত ছিল। জয়চণ্ডীপাহাড় স্টেশনের সার্বিক উন্নয়ন বা পাহাড়ে যুব আবাস নির্মাণের জন্য মন্ত্রীকে নিয়ে এসে আবাসের শিলান্যাস করানো হলেও এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, পর্যটনকে ঘিরে সুসংহত পরিকল্পনা তৈরির দিকটি বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে অবহেলিত থেকেছে।
পযর্টক ও ট্রেকিংয়ে আসা লোকজনের জয়চণ্ডী সম্পর্কে বরাবরের অভিযোগ, এখানে পযর্টকদের জন্য কোনও ব্যবস্থাই নেই। রাস্তা সঙ্কীর্ণ, যাতায়াতের বিষয়ে কোথা থেকে কী তথ্য পাওয়া যাবে, কেউ জানেন না। কোনও নির্দেশিকা চোখে পড়ে না। পাহাড়ে বা পাহাড়তলিতে নেই কোনও অতিথি নিবাস নেই। থাকতে হলে কাছাকাছির মধ্যে একমাত্র ভরসা পুরশহর রঘুনাথপুর। সেখানেও দরের হোটেল নেই। সরকারি অতিথিশালা (পিডব্লিউডি-র) একটি। থাকার ব্যবস্থা বলতে ছোটখাটো লজ।
এত দিন সিপিএমের হাতে উৎসব পরিচালনার রাশ থাকায় অভিযোগ ছিল তাদের দিকেই। তবে দু’বছর হল উৎসব কমিটির খোলনলচে পাল্টেছে। সাংসদ বাসুদেববাবু উৎসব কমিটির সভাপতি থাকলেও সিপিএমের প্রাক্তন জোনাল সম্পাদক তপন লাহিড়ীর পরিবর্তে কমিটির সম্পাদক হয়েছেন পেশায় ব্যবসায়ী সুকুমার মণ্ডল। এই দুই বছরেই পাহাড়ে পর্যটনকেন্দ্র গড়ার ধারাবাহিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই অবস্থায় নতুন সরকারের আমলে পর্যটনকেন্দ্রের জন্য প্রাথমিক বরাদ্দ এসে যাওয়ায় স্থানীয় পর্যটনের সুদিন ফেরার আশায় রয়েছেন অনেকে।
প্রশাসন সূত্রের খবর, এই বিষয়ে মূল উদ্যোগ রঘুনাথপুরের মহকুমাশাসক প্রণব বিশ্বাসের। বিভিন্ন দফতর ও উৎসব কমিটিকে সঙ্গে নিয়ে সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রথমে পাহাড় লাগোয়া এলাকায় সরকারি জমি চিহ্নিত করে সবুজায়নের কাজ শুরু হয়েছে। প্রশাসন সূত্রের খবর, উৎসব প্রাঙ্গণে ২০ একর জমি চিহ্নিত করে গাছ লাগানোর কাজ শুরু হয়েছে। বন দফতরের দেওয়া গাছ ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে ওই জমিতে লাগাচ্ছে স্থানীয় শাঁকা ও আড়রা গ্রাম পঞ্চায়েত। সুকুমারবাবুর কথায়, “গাছ লাগানো ছাড়াও উৎসব প্রাঙ্গণে যাওয়ার রাস্তার সংস্কার বা এলাকায় জলের ব্যবস্থা করা জন্য নির্দিষ্ট প্রস্তাব পুরসভা ও প্রশাসনের কাছে আমরা জমা দিয়েছি। প্রাথমিক কাজ শুরুও হয়েছে।”
মহকুমাশাসক বলেন, “পাহাড়ে প্রায় ৩০০ একর সরকারি জমি রয়েছে। যে ২৬ লক্ষ টাকা জেলায় এসেছে, তা দিয়ে আমরা ওখানে কটেজ, ডর্মিটরি, ক্যাফেটারিয়া গড়ার পরিকল্পনা নিয়েছি। জেলাশাসকের উদ্যোগে ওই পরিকল্পনা রূপায়ণের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যেই জেলাশাসক নিজে পাহাড়ে এসে জমি পরিদর্শন করে গিয়েছেন।”
জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, রাজ্য পর্যটন দফতর ছাড়াও অন্য দফতর (বিশেষ করে পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদ) থেকে জয়চণ্ডীতে পর্যটনের সার্বিক বিকাশের লক্ষ্যে অর্থ চাওয়া হবে। রঘুনাথপুরের তৃণমূল বিধায়ক পূর্ণচন্দ্র বাউরি বলেন, “জয়চণ্ডীর পরিকাঠামো গড়া নিয়ে আমরা বেশ কিছু পরিকল্পনা নিয়েছি।” |