ছাপা, কিন্তু কালি নেই।
কাগজ কিংবা কাপড়ও নেই।
তবু এটা ‘ছাপা’-ই।
প্রযুক্তির এই নতুন বিস্ময়ের পোশাকি নাম ‘থ্রি-ডি প্রিন্টিং’ বা ত্রিমাত্রিক মুদ্রণ। আর এই তিন মাত্রার অন্যতম ‘জাদুকর’ অমিত বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুস্মিতা বোস নামে দুই বাঙালি বিজ্ঞানী।
ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির এই দুই গবেষক এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এই প্রযুক্তির গবেষণায় ডুবে রয়েছেন। বিজ্ঞানীদের একাংশ বলছেন, নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় জন্ম নেওয়া এই প্রযুক্তিকে বিশ্ব দরবারে অনেকটাই পরিচিতি দিয়েছেন এই বাঙালি দম্পতি।
থ্রি-ডি প্রিন্টিং বিষয়টা ঠিক কী?
সোজা ভাষায়, কাগজের উপর শুয়ে থাকা সারি সারি অক্ষরমালা নয়। এমন ছাপা সে, যার দৈর্ঘ্য আছে, প্রস্থও আছে, আবার আছে উচ্চতাও। সেই সঙ্গে ছুঁয়ে দেখা বাস্তবের সঙ্গে অবিকল মিল, হুবহু এক প্রতিকৃতি। বড়দিনের ছুটিতে কলকাতায় ফিরে বিষয়টা আরও সহজে ব্যাখ্যা করলেন অমিত-সুস্মিতা। কাগজ-কলম নয়, গোটা ব্যাপারটা বোঝালেন একটি মাথার খুলি নিয়ে!
হাতে মাথার খুলি নিয়ে অমিত বললেন, “এটা কিন্তু থ্রি-ডি প্রিন্ট।” এমনটাও সম্ভব!
সুস্মিতা বললেন, “সাধারণ প্রযুক্তিতে ছাপতে গেলে দরকার হয় কালির। থ্রি-ডি প্রিন্টিংয়ের ক্ষেত্রেও বিষয়টা অনেকটা একই রকম। তবে এখানে কালি হিসেবে সাধারণত ব্যবহার করা হয় ধাতু, সেরামিক কিংবা পলিমার। যদিও দরকারে অন্য রাসায়নিকও ব্যবহার করা যেতে পারে।”
কী ভাবে?
সুস্মিতার কথায়, “ধরুন আপনি একটা ছোট্ট রড বা লাঠির প্রতিলিপি করবেন। ছাপা হবে ত্রিমাত্রিক। রডের নকশা কম্পিউটারে আছে। দরকার এ বার বিশেষ ধরনের ‘কালি’র। আর এখানেই অভিনবত্ব। থ্রি-ডি প্রিন্টিং-এ কালির বদলে যে রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে রডটা বানাতে চান, সেটা ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ সেটাই কালি।” ধরা যাক, রডটি আপনি বানাতে চান টাইটেনিয়াম ধাতু দিয়ে। এ বার টাইটেনিয়ামকে গলিয়ে সেটাকেই ব্যবহার করা হল কালির জায়গায়। বাকিটা একই রকম। কম্পিউটারের প্রিন্ট লেখায় গিয়ে হালকা করে মাউসে ক্লিক। ব্যস! রডের ত্রিমাত্রিক প্রতিলিপি তৈরি। |
খুলির ত্রিমাত্রিক প্রিন্ট হাতে অমিত-সুস্মিতা। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী |
পশ্চিমের দেশগুলোতে ত্রিমাত্রিক মুদ্রণের পরিচিতি অনেক দিনের। কিন্তু ব্যবহার ছিল সীমিত। এই সীমাটাই বাড়ানোর কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল অমিত-সুস্মিতার। ত্রিমাত্রিক মুদ্রণকে হাতিয়ার করে এই দুই বাঙালি তৈরি করেছেন শরীরের বিভিন্ন অংশের হাড়। ভবিষ্যতে হাড় প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে যা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। ধরা যাক, দুর্ঘটনায় মাথায় চোট পেয়েছেন কেউ। ভেঙে গুড়ো-গুড়ো মাথার পিছনের দিকের হাড়। স্ক্যান করা হল। পাওয়া গেল মাথার ছবিটা। এ বার ওই ক্ষতটার কী হবে?
অমিত-সুস্মিতার কথায়, “আমরা ছবিটার থ্রি-ডি প্রিন্ট করে ফেললাম। কালির জায়গায় ব্যবহার করা হল হাড়ের অন্যতম উপাদান ক্যালসিয়াম ফসফেট এবং পলিমারের মিশ্রণ। সাধারণত কাগজ বা কাপড়ে ছাপা হয় একটা স্তরেই। থ্রি-ডি প্রিন্টিংয়ের ক্ষেত্রে ওই রাসায়নিক মিশ্রণ জমতে থাকে স্তরে-স্তরে। আর তাতেই চেহারা নেয় একটা ঘনবস্তুর। যার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা রয়েছে। যাকে দেখতে হুবহু আসলের মতো। ছুঁতেও! এ ভাবেই প্রিন্ট করে পাওয়া গেল ক্ষত সমেত হুবহু মাথার খুলিটাই। স্পষ্ট হয়ে গেল ভেঙে যাওয়া অংশটার চেহারা।”
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ঠিক একই ভাবে প্রিন্ট করা হল ভাঙা অংশটাকেও। তাতে রাখা হল রক্তনালী যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ছিদ্র। যদি ক্যালসিয়াম ফসফেট দিয়েই তৈরি হয়, সে ক্ষেত্রে প্রয়োজন মতো যোগ করা হল প্রোটিন, আয়ন। এবং শেষে লাগিয়ে দেওয়া হল ভাঙা জায়গাটায়। অনেকটা ঠিক ‘পাজল’-এর টুকরোর মতো।
ইঁদুরের দেহে দারুণ ভাবে কাজ করেছে এই প্রযুক্তি, জানালেন সুস্মিতা। “শরীর খুব ভাল ভাবে মেনে নিয়েছে আগন্তুককে। কৃত্রিম হাড়ের পাশ দিয়ে গজিয়েছে নতুন কোষ। রয়েছে রক্তনালীও।” মানুষের দেহে এর প্রয়োগ অবশ্য এখনও বাকি।
কিন্তু সুস্মিতা-অমিতের মস্তিষ্ক প্রসূত এই প্রযুক্তি সাড়া ফেলে দিয়েছে পশ্চিমী দুনিয়ায়। আর এতটাই সাড়া ফেলেছে যে তাঁদের দরজায় কড়া নেড়েছে খোদ নাসা।
কেন? বাঙালি ওই দম্পতির কাছে কী চায় নাসা?
অমিত জানান, নাসা প্রথমে তাঁদের কাছে এমন কিছু রাসায়নিক পাঠিয়েছিল, যা চাঁদে পাওয়া যায়। বলা হয়েছিল, এটাকে ব্যবহার করে থ্রি-ডি-তে কিছু একটা বানিয়ে দেখান। চ্যালেঞ্জ নেন অমিতরা। সফলও হন। র্যাপিড প্রোটোটাইপিং জার্নালে বেরিয়েছে তাঁদের সেই গবেষণাপত্র। এর পর নাসা তাঁদের আসল উদ্দেশ্যর কথা খুলে বলে মাঝেমধ্যেই আন্তর্জাতিক মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রে যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা যায়। বা দেখা যায় মহাকাশযানের একটা অংশ ভেঙে পড়েছে। কিংবা ভবিষ্যতে যদি ভিন্ গ্রহে মহাকাশ যান পাঠানো হয়, অবতরণের সময় ঝুঁকি থেকেই যায়। তখনও ভেঙে পড়তে পারে যানের কোনও অংশ। এ সব সামলাতেই নাসা এখন তাঁদের সাহায্য চায়।
কী ভাবে?
পরিকল্পনাটা এমন মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হবে ত্রিমাত্রিক মুদ্রণ যন্ত্র।
কম্পিউটারে থাকবে প্রয়োজনীয় অংশের ডিজাইন। আর মজুত থাকবে কাঁচা মাল। যাকে ‘কালি’ হিসেবে ব্যবহার করে চোখের নিমেষে তৈরি করে ফেলা যাবে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশটি। শুধু যন্ত্রাংশ নয়, চাঁদে ‘বেস’ তৈরি করতেও কাজে লাগানো যেতে পারে এই প্রযুক্তিকে। সব মিলিয়ে এই
প্রযুক্তি মহাকাশ অভিযানের খরচ অনেকটাই কমিয়ে দেবে বলে দাবি সুস্মিতা-অমিতের।
গবেষণার পাশাপাশি যাঁরা দুই ছেলেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখান, বাংলাও পড়ান। দেশে ফেরাটাও রুটিনমাফিক।
আসলে মাতৃভূমির প্রতি তাঁদের টানটাও যে মাত্রাহীন। |