সচিন কি কট শ্রীনি বোল্ড ধোনি, বিতর্ক
চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামের মেন গেট দিয়ে ঢুকতেই বাঁ ধারে ওই ক্রিকেট-কেল্লা। কেল্লা বলতে ঘেরা দেওয়া যে প্রকাণ্ড একটা জায়গা-টায়গা বোঝায় তা নয়। তবে গভীরতা-স্থাপত্য-অভিনবত্ব সব মিলে কেল্লাসদৃশ তো নিশ্চয়ই। লাল ইটের প্রাচীর। গুগল সার্চ মারলেই দেখা যাবে কত বাই কত ফুট। চোখের দেখায় মনে হচ্ছে অন্তত বারো ফুট লম্বা, পঁচিশ ফুট চওড়ায় হতেই পারে। যার উপরে বড় করে লেখা তিনটে অভিব্যক্তি। পর পর।
কমিটমেন্ট।
কনসিসটেন্সি।
ক্লাস।
আর এক পাশে পুরো কেরিয়ার-স্ট্যাটস। টেস্টে কত রান। ওয়ান ডে-তে কত। টেস্ট ক্রিকেটে কোথায় কোথায় কী সেঞ্চুরি। রাহুল শরদ দ্রাবিড়কে এই বিশাল লাল ইটের প্রাচীরে যে ভাবে সংবর্ধিত করে রেখেছে কর্নাটক ক্রিকেট সংস্থা, বিশ্বে আর দ্বিতীয় কোনও নজির নেই। ওই ব্যাটিং-কেল্লাটা থেকে মুখ ঘুরিয়ে ওপরে তাকালেই সেই ব্যাঙ্কোয়েট ঘরটা, যেখানে দ্রাবিড় অবসর নেওয়ার সাংবাদিক সম্মেলনটা করেন। থ্রি পিস স্যুটে লিখিত বিবৃতি-সহ। পাশে বোর্ড প্রেসিডেন্ট শ্রীনিবাসনকে নিয়ে। সব কিছু যেখানে পিকচার পারফেক্ট। যেখানে লোকে অস্ট্রেলিয়ায় শেষ সিরিজের ব্যর্থতা ভুলে ব্যস্ত থেকেছে অবসৃত সেনানীর মন পরিবর্তনে, রাহুল চলে যেও না এই আর্তনাদে। তারও আগে ইংল্যান্ডে শেষ ওয়ান ডে খেলেছেন রাহুল তুমুল গণ-আবেগে মূর্ছিতপ্রায় হয়ে। চিরকাল তাঁর কর্ণের নিয়তি বলেই ক্রিকেটমহল জানত। বিদায়বেলায় কোথায় সেই যুদ্ধ-বিভ্রাট। বরং তাঁর রথ তো গড়গড়িয়ে চলল। চূড়ান্ত বিচারে জয়ী হিসেবেই জনমানসে থেকে গেলেন দ্রাবিড়।
বরঞ্চ যাঁকে অর্জুন মনে করা হয়ে থাকে, সেই সচিন রমেশ তেন্ডুলকরের গাণ্ডীব হস্তচ্যুত। রোববার সকাল সকাল সচিনের অবসরের খবরটা চিন্নাস্বামীতে আছড়ে পড়ার সময় গুলিয়ে যাচ্ছিল অন্তে কি তা হলে সব ঘুরে গেল? ললাটলিপি বদলাবদলি হয়ে গেল অর্জুন আর কর্ণের?
নইলে যে ক্রিকেটমাঠ তাঁর প্রার্থনাস্থল। যে ক্রিকেটজনতার মনোরঞ্জনের জন্য তাঁর ক্রিকেট খেলার বাড়তি গরজ, তাঁদের অলক্ষ্যে এ ভাবে প্রেস বিবৃতি দিয়ে তাঁকে অবসরের সিদ্ধান্ত জানাতে হবে কেন? কেন যে তেন্ডুলকর পাকিস্তান ম্যাচের মাহাত্ম্য সবার চেয়ে ভাল বোঝেন, তিনি দুম করে পাক সিরিজ শুরু হওয়ার মাত্র দু’দিন আগে জানাতে যাবেন এত বড় সিদ্ধান্তের কথা?
খাতায়-কলমে সচিনের ওয়ান ডে কেরিয়ার শুরু ১৯৮৯-এর গুজরানওয়ালার পাকিস্তান দিয়ে। শেষ ২০১২-র মীরপুরে সেই পাকিস্তানকে খেলে। কিন্তু সেটা তো শুকনো অঙ্কের শেষ। সবাই জানত, এ বারের পাকিস্তান সিরিজ ছাড়বেন না তেন্ডুলকর। পাকিস্তান থেকে প্রস্তুতি নেবেন মাইকেল ক্লার্কের দলের জন্য। এমনিতে ওয়ান ডে ক্রিকেটে তিনি যে শৃঙ্গের ওপরে দাঁড়িয়ে তাকে মাউন্ট এভারেস্ট বললেও যথেষ্ট বলা হয় না।
সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলা--৪৬৩। বিশ্বরেকর্ড!
সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরি৪৯। বিশ্বরেকর্ড!
সবচেয়ে বেশি রান১৮৪২৬। বিশ্বরেকর্ড!
চিন্নাস্বামীর সেই প্রাচীর। ছবি: উৎপল সরকার
তা বলে অবসর এখুনি নিতে চান এমন ইঙ্গিত তো কাউকে দেননি। ভারত সফরে আসা পাকিস্তানি সাংবাদিকদের ধারণা ছিল, দিল্লিতে সিরিজের শেষ ওয়ান ডে ম্যাচে একটা বড় রান করে অবসর নেবেন। বলবেন, দ্যাখ পাকিস্তানের সঙ্গে স্টাইলে শুরু করেছিলাম। পাকিস্তানের সঙ্গেই আবার মাতিয়ে দিয়ে সরে গেলাম।
পাক সাংবাদিকদের অনুমান যদি ভুলও হয়, তাঁর অবসর নেওয়ার ভঙ্গিটাও কি অদ্ভুত নয়? ওয়ান ডে ক্রিকেটের সর্বকালীন রাজাধিরাজ তিনি এত বড় সিদ্ধান্ত প্রেস কনফারেন্স ডেকে করবেন না? সর্বজনসমক্ষে আসবেন না? অন্তত টিভি চ্যানেলে? সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমী মানুষকে বলবেন না তাঁর মনের কথা? তা নয়, এই সচিন কেমন যেন লুকোছাপায় ভরা। দিনভর মোবাইল বন্ধ করে বসে থাকা। শুনলাম মুম্বই ছেড়ে মুসৌরিতে চলে গিয়েছেন হোটেলিয়ার বন্ধুর বাংলোয়। দ্রুতই না কি বিদেশ চলে যেতে পারেন।
গত ক’মাসের রান না পাওয়া একটা লোকের মানসিক রথচক্র এই পরিমাণ মেদিনীগ্রাস করাতে পারে? নাকি নেপথ্যে অন্য কারণ রয়েছে?
তেন্ডুলকরের দীর্ঘ কেরিয়ারে কমপক্ষে দশটা আউটের সিদ্ধান্ত রয়েছে যা নিয়ে ধোঁয়াশা থেকে গিয়েছে। ইডেনেরটা যেমন। তেরো বছর পর আজও কেউ জানে না শোয়েব আখতার কি রান আউট করার জন্য সে দিন তেন্ডুলকরকে ইচ্ছাকৃত ‘অবস্ট্রাক্ট’ করেছিলেন? আর তেমনই তীব্র ধোঁয়াশা শুরু হল নাটকীয় ওয়ান ডে অবসর নিয়ে।
জনপ্রিয় তত্ত্ব: সচিন অপমানিত হয়ে পরিস্থিতির চাপে সরে যেতে বাধ্য হলেন। অবিকল ভিভিএস লক্ষ্মণের মতো গেল তাঁর উইকেটটা। তফাতের মধ্যে লক্ষ্মণ ফোন করে ধোনিকে পাননি। এখানে নাকি ধোনি শুরু থেকেই পরিস্থিতি জানতেন।
বিতর্কের পরম্পরা
রোববার বিকেলের বেঙ্গালুরুতে ভারত অধিনায়কের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেও তাঁর মুখ খোলানো যায়নি। ধোনি বললেন, “আনন্দবাজারকে যদি আলাদা করে বলি, অন্যরা আমায় ধরবে। তাদের কী জবাব দেব? যা বলার সোমবার প্রেস কনফারেন্সে বলব।” কিন্তু পাশে দাঁড়ানো যুবরাজ-গম্ভীররা যেমন বিদীর্ণ বোঝাই যাচ্ছে। তিনিধোনি তো বেশ অবিচলিত।
তা হলে কি ধোনি আগাম জানতেন? বোর্ড বা সচিন কেউ আগেই জানিয়েছিল?
ধোনি এ বার সভয়ে সরে গেলেন, “ওরে বাবা এটার উত্তরও তো একটা ডেফিনিট উত্তর।”
ভারত অধিনায়কের এমন কাটিয়ে দেওয়া মনোভাব আর সচিনের রহস্যজনক ভাবে সরে যাওয়া দুইয়ে মিলে কিন্তু মনে হচ্ছে জনপ্রিয় তত্ত্বটাই সম্ভবত ঠিক যে, সচিন কট শ্রীনি বোল্ড ধোনি!
ঠিক এ মুহূর্তে যাচাই করার কোনও উপায় নেই অন্তরালে যা ঘটেছে শোনা যাচ্ছে, সম্পূর্ণ সত্যি কি না? তবে পরম্পরা নাকি এ রকম:
১) ক্ষিপ্ত বোর্ড ধোনিকে বলে তুমি ওয়ান ডে ক্যাপ্টেন হিসেবে থাকবে। কিন্তু টেস্টে তোমায় রাখতে পারব কি না জানি না। এখুনি তুমি ২০১৫ বিশ্বকাপের জন্য সম্ভাব্য নকশা জমা দাও। মোটামুটি কাদের মাথায় রেখে পরীক্ষা চালানো হবে।
২) ধোনি সেই তালিকা দেন নির্বাচকদের কাছে। মৌখিক না লিখিত ভাবে সেটা খুব পরিষ্কার নয়। তবে আলাদা করে বলেন, সচিনকে ভবিষ্যতের সেই রূপরেখায় একেবারেই চান না। একটা সময় গিয়ে যেমন রাহুল আর সৌরভকে তিনি চাননি।
৩) ধোনির এই ভাবনায় সিলমোহর দেন বোর্ড প্রেসিডেন্ট শ্রীনিবাসন। দ্রুত নির্বাচকদের ডাকেন।
৪) এর পর দুই নির্বাচক সন্দীপ পাটিল আর রজার বিনি বোর্ডের তরফে কথা বলেন সচিনের সঙ্গে। তাঁকে বলেন, তোমাকে আমরা পাকিস্তান সিরিজটা দিচ্ছি। কিন্তু ওটা খেলে উঠেই অবসর নিতে হবে। আমরা নতুন ওয়ান ডে টিম তৈরি করব। আশা করি তুমি বুঝবে।
৫) সচিন রেগে যান। বলেন, আমি অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে টেস্ট সিরিজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে চাই। তার জন্য টানা ওয়ান ডে খেলা দরকার। আপনারা যদি শুধু পাকিস্তান সিরিজ দেন, আমার শেষ ইন্টারন্যাশনাল প্র্যাক্টিস হচ্ছে ৬ জানুয়ারি। আর অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে প্রথম টেস্ট ম্যাচ শুরু ২২ ফেব্রুয়ারি। দেড় মাসের গ্যাপ হয়ে যাবে।
৬) সচিন প্রস্তাব দেন, তিনি ইংল্যান্ড ওয়ান ডে সিরিজ খেলে উঠে না হয় অবসর নেবেন। যা শেষ হচ্ছে ২৭ জানুয়ারি। সেক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম টেস্টের সঙ্গে তাঁর শেষ আন্তর্জাতিক অনুশীলনের ব্যবধান কমে নামছে তিন সপ্তাহে।
৭) এই প্রস্তাবটা নির্বাচকেরাই নাকচ করে দেন না শ্রীনি-ধোনি মিলে, এখানটায় ধোঁয়াশা রয়েছে। তবে ইংল্যান্ড ওয়ান ডে সিরিজ খেলতে না দেওয়াই নাকি শেকড়। এর পরেই সচিন সিদ্ধান্ত নেন, দু’টো না দিলে একটাও নয়। পাকিস্তানও খেলব না। যা হয়, হবে।
হঠাৎ অবসর এক দিনে
বিশ্বরেকর্ড
ম্যাচ
৪৬৩
রান
১৮৪২৬
সেঞ্চুরি
৪৯
গড়
৪৪.৮৩
হাফ সেঞ্চুরি
৯৬
সর্বোচ্চ রান
২০০*
সর্বোচ্চ রান ২০০* (বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা- গ্বালিয়র, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১০)
আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রথম ১৯৮৭ বিশ্বকাপে। ভারত-ইংল্যান্ড সেমিফাইনালে বল বয়।
১৯৮৮ সালে ভারত-পাক প্র্যাক্টিস ম্যাচে পরিবর্ত ক্রিকেটার হিসেবে প্রথম মাঠে।
১৯৯২ সালে থার্ড আম্পায়ারের মাধ্যমে আউট হওয়া প্রথম ব্যাটসম্যান।
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে সব চেয়ে বেশি শতরানের পার্টনারশিপ (২০)।
বিশ্ব জুড়ে সব চেয়ে বেশি স্টেডিয়ামে (৯০) খেলেছেন।
রোববার সচিনের এ ভাবে আচমকা সরে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে ইতিমধ্যেই আখ্যা দেওয়া হচ্ছে ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্স বলে। টেস্ট ক্রিকেট এর পরেও খেলবেন। কিন্তু সেখানে তো এ বার চাপও সাংঘাতিক বেড়ে থাকল। সবচেয়ে বড় কথা, পাঁচ বছর পর পাকিস্তানি ক্রিকেট হানাদার মযার্দাযুদ্ধে জিততে এসেছে। তিনি মিস্টার ইন্ডিয়া হাত-পা গুটিয়ে ফৌজি শিবির থেকে চলে যাবেন লোকালয়ে! হয় নাকি? কখনও তো হয়নি!
তাঁর অবসর নেওয়ার যে সাংঘাতিক প্রভাব সকাল থেকে জমতে শুরু করেও বেলা বাড়ার সঙ্গে চ্যানেলের ব্রেকিং নিউজ থেকে হারিয়ে যাবে তা-ই বা কে ভেবেছিল? ভারতীয় সামাজিক অভ্যুত্থানের অভূতপূর্ব এক দৃশ্য এ দিন আরও যখন প্রভাবশালী হয়ে বিজয়চক, ইন্ডিয়াগেট আর রাইসিনা হিলে আছড়ে পড়ছিল, তত তেন্ডুলকর সরে যাচ্ছিলেন জাতীয় আড্ডায় তাঁর বরাবরের অবস্থান পয়লা নম্বর বিষয় থেকে। ভারত-পাক সিরিজের ঔজ্জ্বল্যটাই পুরোপুরি চলে গেল, এ কথা সারা দিন ক্রিকেটমহল বললেও কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা বরাবরের সেই উথালপাতাল করে দেওয়া প্রতিক্রিয়া কোথায়? এ তো বরাবরের ফার্স্ট বয়ের হঠাৎ করে সেকেন্ড হয়ে যাওয়া।
মন্দ ভাগ্য? বেশি দূর নিজের ক্রিকেটকে টেনে নিয়ে যাওয়ার ট্যাকটিক্যাল ভুল? সময়কে অগ্রাহ্য করতে চাওয়া? না কি পর্দার আড়ালের ন্যক্করজনক রাজনীতি যা তেন্ডুলকরকেও পেড়ে ফেলল?
কোনটা? আসলে একটা হলেও যথেষ্ট। ইন্ডিয়া কালারে দাপুটে সেই দশ নম্বর জার্সিটা চিরকালের মতো হারিয়ে গেল সেই যন্ত্রণার চেয়েও যা ট্র্যাজিক। অর্জুনের তো যুদ্ধ জিতে শেষ করার কথা। তাঁর তো রথচক্র মাটিতে আটকানোর কথা নয়।
না কি সত্যিই বদলে গিয়েছে রাহুল-সচিনের কাহিনির শেষটা? সময় বলবে।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.