ঝুমকোলতা ও তিন্নির গল্প
তিন্নি একটা গল্প লিখবে। স্কুল ম্যাগাজিনে দিতে হবে গল্পটা। ম্যাগাজিন সম্পাদিকা রঞ্জুদির কাছে লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ হতে আর মাত্র দু’দিন বাকি। কিন্তু কিছুতেই তিন্নি ভেবে পাচ্ছে না, কী নিয়ে ও গল্পটা লিখবে। ওর বন্ধু রিম, বিপাশারা কী সুন্দর চট করে গল্প, কবিতা লিখে সপ্তাহখানেক আগেই জমা দিয়েছে রঞ্জুদির কাছে। অথচ তিন্নি? ভূত, প্রেত, গোয়েন্দা, রহস্য কত বিষয়ই তো ওর মাথার মধ্যে গিজগিজ করে সব সময়, তবু লিখতে বসে কিছুতেই কলম যে কেন এগোচ্ছে না!
নিজের ঘরে বসে তিন্নির বাবা মলয়বাবু তখন অফিসের পেন্ডিং কাজগুলো শেষ করছিল। তিন্নি ছুট্টে যায় বাবার কাছে। বলে, ‘বাবা, আমাকে বলে দাও না, কী ভাবে গল্প লিখতে হয়!’ কাজের সময় মেয়ের এমন অবাঞ্ছিত আবদার শুনে বাবা বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘এগুলো কখনও শেখানো যায় না, তিন্নি। যার যার মনের ভাবনা থেকে আসে, অনুভূতি থেকে আসে। আর তোমার যদি এমন ভাবনা মনে না আসে, তবে গল্প লিখতে হবে না, ছেড়ে দাও। বরং ফালতু সময় নষ্ট না করে স্কুলের হোমওয়ার্ক রেডি করো। তোমার পড়াশোনা নিয়ে আমি একটুও স্যাটিসফায়েড নই। যাও ডিস্টার্ব কোরো না এখন।’ বাবার এমন নিরুৎসাহী মন্তব্যের সঙ্গে মৃদু ধমক শুনে তিন্নি হতাশ হয়ে ফিরে আসে।
তিন্নির মা রত্না ঘরে ঢুকেই বুঝতে পারে মেয়ের কিছু একটা হয়েছে। হাত থেকে গরম দুধের গ্লাসটা সামনের টেবিলের ওপর রেখে বলে, ‘কী ব্যাপার, গোমড়া মুখ করে বসে আছিস কেন, কিছু হয়েছে?’ তিন্নি উত্তর না দিয়ে আরও যেন শক্ত হয়ে বসে থাকে। রত্না মেয়ের পিঠে হাত রেখে আদর করে বলে, ‘বল মা, কেউ কিছু বলেছে তোকে?’ চোখ ছলছল করে তিন্নির। মায়ের কাঁধে মাথা রেখে তিন্নি বলে, ‘মা, আমি একটা গল্প লিখতে চাই। আমাকে একটু হেল্প করবে? আমাকে বলে দেবে, কী ভাবে গল্প লিখতে হয়?’ মেয়ের প্রশ্ন শুনে হেসে ফেলে রত্না। বলে, ‘তাই বলি আমার তিন্নি দু’দিন ধরে এত উদাস কেন, এত ভাবুক কেন? কিন্তু তিন্নি আমার তো এখন অনেক কাজ পড়ে আছে। রাতের খাবার সব তৈরি করতে হবে। অফিস থেকে ফেরার পর তোর বাবার টিফিনটাও দেওয়া হয়নি, সেটাও করে দিতে হবে। আমি এ সব নিয়ে কখন ভাবব বল তো? বরং তুই নিজে চেষ্টা করে দেখ এক বার। কত তো বিষয় আছে লেখার, ঠিক পারবি। তবে, না পারলে অযথা সময় নষ্ট করিস না। সামনেই কিন্তু তোর পরীক্ষা। রেজাল্ট খারাপ হলে তোর বাবা ওই নিয়ে নিত্য অশান্তি করবে।’ রত্না আর সময় নষ্ট করে না। চলে যায় রান্না ঘরে।
ছবি: সুমন চৌধুরী
দরজার আন্দোলিত পর্দাটার দিকে স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে তিন্নি। তবে কি গল্পটা শেষ পর্যন্ত দেওয়াই হবে না? মা, বাবা তাকে একটুও সাহায্য করবে না লিখতে? বন্ধুদের থেকে সে কি এতটাই পিছিয়ে যে, একটা গল্পও লিখতে পারে না? বন্ধুরা যখন ম্যাগাজিন নিয়ে ওদের প্রকাশিত লেখা দেখে ক্লাসের মধ্যেই আনন্দে মেতে থাকবে আর তারিয়ে তারিয়ে ম্যাগাজিনের নতুন পাতার গন্ধ নেবে, তখন কী কষ্টটাই না লাগবে! সেই সঙ্গে লেখা না দিতে পারার লজ্জাও কি কম হবে? একটা অব্যক্ত মানসিক অস্থিরতায় মুহূর্তে চঞ্চল হয়ে ওঠে তিন্নি। লেখার কাগজগুলো দূরে সরিয়ে রেখে স্কুলের হোমওয়ার্ক শেষ করে রাত বারোটা অবধি জেগে।
পর দিন সকালে বিছানায় শুয়েই তিন্নি বাইরের কলরব শুনতে পায়। আর সেটা যেন ঠিক ওদের বাড়ির গেটের সামনে থেকেই আসছে। ঝট করে বিছানা থেকে উঠে তিন্নি বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। পাড়ার বেশ কয়েক জন পরিচিত কাকু, জেঠু আর নবারুণ সঙ্ঘের ছেলেরাও রয়েছে সেই জটলার মধ্যে। তিন্নির কৌতূহল বাড়তে থাকে। ভিড় ঠেলে একটু একটু করে এগোতে থাকে ও। তিন্নি দেখতে পায়, ওর বাবা কেমন রণমূর্তি ধারণ করে আছে। বার বার তেড়ে যাচ্ছে সেই ভিড়ের ভিতর। মা একটু ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে পাড়ার সব বউ-মেয়েদের সামনে হাত নেড়ে নেড়ে কী যেন বলছে আর সবাই কেমন নিবিষ্ট ভাবে ওর মায়ের কথাগুলো গিলছে। একটা রহস্যের গন্ধ পায় তিন্নি। ‘কী হয়েছে গো জেঠু? এখানে এত ভিড় কেন?’ পাশের বাড়ির অমলজেঠুর হাত ধরে জিজ্ঞাসা করে তিন্নি। চরম বিস্মিত অমলজেঠু বলে, ‘সে কী খুকি, তুমি এখনও কিছু জানো না? এই কাকভোরে তোমার সাইকেল চুরি করতে এসে এক জন চোর ধরা পড়েছে। তাই নিয়েই তো এত কাণ্ড!’ ‘আমার সাইকেল চুরি করতে এসেছিল? কই, আমিও একটু দেখব চোরটাকে। জানো জেঠু, আমি কখনও চোর দেখিনি।’ আবদারের সুরে কথাগুলো বলে তিন্নি আরও খানিকটা এগিয়ে যায় ভিড়ের ভিতর। ‘একে কোনও ভাবেই ছাড়া যাবে না। থানায় ফোন কর, পুলিশের হাতে তুলে দিলে তখন বুঝবে ঠ্যালা। আবার বলছে আমি চোর নই, আমাকে তোমরা ছেড়ে দাও! যত্ত সব ড্রামা।’ এক নিশ্বাসে তর্জনগর্জন করে বলে যাচ্ছে প্রতিবেশী সুমিতকাকু।
তিন্নি দেখে, ওর থেকে বছর চার-পাঁচ বয়সে বড় একটা ছেলে কী ভাবে হাঁটু মুড়ে ধুলোর মধ্যে বসে আছে আর জড়ো হওয়া মানুষগুলোর দিকে অসহায় ভাবে তাকিয়ে আছে। হাত দুটো পিছমোড়া করে বাঁধা। ছেলেটার চোখের আর্তি দেখে শিউরে ওঠে তিন্নি। দু’হাত দিয়ে চাপা দেয় নিজের চোখ দুটো। একছুট্টে ভিড়ের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে বারান্দার কোলাপসেবল গেট ধরে সিঁড়ির উপর বসে পড়ে তিন্নি। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে ক্রমশ। বারান্দার কোণে লতিয়ে ওঠা ঝুমকোলতা ফুলগাছের দিকে হঠাৎ নজর পড়ে ওর। ডান হাত দিয়ে চোখটা একটু মুছে নিয়ে তিন্নি দেখে গাছে ফুল নেই একটাও অথচ কাল সন্ধ্যাতেও তো...। তিন্নি দৌড়ে যায় ঘরে। কাল রঞ্জুদির কাছে নিশ্চিত জমা দিতে পারবে গল্পটা।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.