চাষিদের স্বার্থে ঘোষণা। অথচ চাষিদেরই একাংশ সেই ঘোষণার বিরুদ্ধে পথ অবরোধ করলেন। শুক্রবার বলরামপুরের পাইকারি সব্জি বাজারের ঘটনা।
এই পাইকারি বাজারে ‘কমিশন এজেন্ট’দের (আড়তদার) কাছে সব্জি বিক্রি করতে আসা চাষিদের বস্তা বা ঝুড়ি ওজন করতে বাজারেরই কিছু শ্রমিক সাহায্য করেন। সেই কাজ বাবদ শ্রমিকেরা চাষিদের কাছ থেকে কিছু পরিমাণ সব্জি বিনামূল্যে নেন। কিন্তু বৃহস্পতিবার বলরামপুর নিয়ন্ত্রিত বাজার সমিতির পক্ষ থেকে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে প্রচার করা হয়, এ বার থেকে ওজনের কাজে সাহায্য করার বিনিময়ে বিনামূল্যে চাষিদের থেকে কোনও সব্জি নিতে পারবেন না ওই শ্রমিকেরা। বিতর্ক ও বিভ্রান্তির সূত্রপাত এই ঘোষণাকে ঘিরেই। যে ঘোষণাকে ঘিরে শুরু হয়েছে সিপিএম-তৃণমূল চাপানউতোরও।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, শুক্রবার ভোরে অন্য দিনের মতোই বাজার বসলেও শ্রমিকেরা হাত গুটিয়ে বসে থাকেন। ফলে বেলা গড়িয়ে গেলেও বাজারে সব্জি কেনাবেচার কাজ হয়নি। শ্রমিকদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে এই বাজারে ওজেন সাহায্য করার জন্য বিনামূল্যে সব্জি পাওয়ার প্রথা চলে এলেও আচমকা তাঁদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। প্রতিবাদে শ্রমিকেরা বাজারের সামনের বলরামপুর-বরাবাজার রাস্তা অবরোধ করেন। বাজারে বেচাকেনা বন্ধ দেখে সব্জি নিয়ে আসা চাষিদের একাংশও অবরোধে যোগ দেন। তাঁদের ক্ষোভ ছিল, শ্রমিকেরা হাত গুটিয়ে নিলে এত পরিমাণ সব্জি কী ভাবে বিক্রি হবে? প্রায় আধ ঘণ্টা অবরোধ চলার পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে অবরোধ ওঠে। বলরামপুর নিয়ন্ত্রিত বাজার সমিতি সূত্রে জানা যাচ্ছে, এই পাইকারি বাজারে প্রতিদিন দেড় থেকে দু’হাজার মণ সব্জি বেচাকেনা হয়। বলরামপুর, বাঘমুণ্ডি, আড়শা, মানবাজার ২ ব্লক এবং ঝাড়খণ্ডের কিছু এলাকার চাষিরাও এখানে রোজ সব্জি বিক্রি করতে আসেন। বাজার সমিতির সচিব মিহির পতি বলেন, “আমাদের কাছে অভিযোগ আসছিল, শ্রমিকদের একাংশ এক দিকে চাষিদের কাছ থেকে ওজন করতে সাহায্য করার নামে বিনামূল্যে সব্জি নিচ্ছেন। আবার যাঁরা ক্রেতা (আড়তদারদের কাছ থেকে পাইকারি দরে যে ব্যবসায়ীরা সব্জি কেনেন), তাঁদের কাছ থেকেও টাকা নেওয়া হচ্ছে। এই টাকার পরিমাণ মণ প্রতি ছ’টাকা। যার মধ্যে আড়তদারের চার টাকা ও শ্রমিকদের দু’টাকা। তাই ঘোষণা করে বলা হয়েছিল, ক্রেতাদের কাছ যেহেতু কমিশন এজেন্ট ও শ্রমিকদের জন্য অর্থ আদায় করা হয়, তাই আর চাষিদের সব্জি নেওয়া যাবে না।” এই ঘোষণার জেরে এ দিন কেনাবেচা ব্যাহত হয়েছে মেনে নিলেও বেলার দিকে বিক্রিবাটা স্বাভাবিক হয়েছে বলেই মিহিরবাবুর দাবি।
কমিশন এজেন্টদের বক্তব্য, কাঁচা সব্জি যত তাড়াতাড়ি বেচাকেনা হয়, ততই ভাল। দেরি হলে বাজারে প্রভাব পড়ে। এ দিন সমিতি খুব কড়াকড়ি না করায় বিষয়টি মিটে গিয়েছে স্বীকার করে ঘনশ্যাম কুমার, ঝাড়ু দত্ত প্রমুখ কমিশন এজেন্টরা বলেন, “চাষিরা শ্রমিকদের ওজনে সাহায্য করার জন্য সব্জি দেন। এটা এখানকার দীর্ঘদিনের প্রথা। এতে আমাদের কিছু বলার নেই। কিন্তু শ্রমিকদের ওজন করার পারিশ্রমিক তো ক্রেতাদের কাছ থেকেই আদায় করা হয়।” এজেন্টদের আরও ক্তব্য, মণ প্রতি দু’টাকা দরে শ্রমিকেরা আর কাজ করতে চান না।
নিয়ন্ত্রিত বাজার সমিতির সমিতির সভাপতি, পদাধিকার বলে অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) হৃষিকেশ মুদি। তাঁর কথায়, “আমাদের বক্তব্য খুব পরিষ্কার। চাষিদের পরিশ্রমের ফসল এ ভাবে বিনামূল্যে নেওয়া যাবে না। শ্রমিকদের না পোষালে তাঁরা তাঁদের দাবি জানাবেন। তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে।”
এই সিদ্ধান্তের পিছনে অবশ্য ‘রাজনীতি’ খুঁজে পেয়েছে সিপিএম। দলের বলরামপুর জোনাল কমিটির সদস্য তথা সিটুর জেলা কমিটির সদস্য ত্রিলোচন দাসের দাবি, “এই বাজারে সাড়ে তিনশো থেকে চারশো শ্রমিক কাজ করেন। তাঁদের প্রায় সকলেই আমাদের সমর্থক। তাই শাসকদলের অঙ্গুলিহেলনে সমিতি এখানকার দীর্ঘদিনের প্রথা ভেঙে নিয়ন্ত্রিত বাজার সমিতি এই ঘোষণা করেছে।” পদাধিকার বলে বাজার সমিতির সদস্য স্থানীয় বিধায়ক হিসেবে রাজ্যের মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতো নিজেও। সিপিএমের অভিযোগ উড়িয়ে তিনি বলেন, “বাজার সমিতি চাষিদের স্বার্থেই এই ঘোষণা করেছে। সমিতির যা অবস্থান, তা আমি প্রচারপত্র তৈরি করে চাষিদের জানাতে বলব। চাষি, শ্রমিক বা এজেন্ট কেউই যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন, প্রয়োজনে তা নিয়েও আলোচনা হতে পারে।” |